৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের একটি বেদনাময় দিন। ১৯৭২ সালের এই দিন সকালে এক অজানা ফোন কলের আহ্বানে জহির রায়হান তাঁর অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়েছিলেন ঢাকার মিরপুরে। মিরপুর তখনও অরক্ষিত। অবাঙালি অধ্যুষিত এই এলাকা তখন ছিল রীতিমতো বিপজ্জনক। মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা ছিল একাত্তরের বিভীষিকাময় বধ্যভূমি। দেশের স্বাধীনতার বিজয় অর্জনের ৪৫ দিন পর কুহকের ডাকে সেই বধ্যভূমিতে গিয়েছিলেন জহির রায়হান। আর ফিরে আসেননি। এসব কথা কম বেশি আমাদের সকলেরই জানা।
প্রতিবছর এই দিনটিতে আমাদের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির এই অগ্রপুরুষকে অনেক বেদনার সাথে মনে পড়ে। আশ্চর্যজনক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন মানুষটি। মাত্র ৩৮ (১৯ আগস্ট ১৯৩৩–৩০ জানুয়ারি ১৯৭১) বছরের জীবনে তিনি বহুমুখী এত সৃষ্টিশীলতার পরিচয় রেখে গেছেন তা রীতিমত অবিশ্বাস্য। এ–বয়সে অনেকে মাত্র কাজ শুরু করেন। তাঁর হাতে ছিল সোনার কাঠি। যেখানেই সেটি ছুঁইয়েছেন সোনার ফসল ফলেছে। বাংলাদেশের সিনেমাকে সঠিক ঠিকানাটি দেখাতে সমর্থ হয়েছিলেন তিনি। ঐ বয়সেই পরিণত হয়েছিল এদেশের (পুরো পাকিস্তানের বললেও বোধ করি অতিশয়োক্তি হবে না) চলচ্চিত্রের অভিভাবককে। প্রথম পরাবাস্তববাদী চলচ্চিত্র (কখনো আসেনি), প্রথম চেম্বার সিনেমা (কাঁচের দেয়াল), প্রথম রঙিন ছবি (সংগম), প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি (বাহানা), প্রথম পৌরাণিক ছবি
(বেহুলা), প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র (জীবন থেকে নেয়া) তাঁর হাতে তৈরি। অসমাপ্ত চলচ্চিত্র লেট দেয়ার বি লাইট ছিল বহুভাষিক একটি প্রচেষ্টা যার প্রেক্ষাপট ছিল আন্তর্জাতিক।
মূলধারার সিনেমার একটি রূপরেখা তিনি তৈরি করেছিলেন। নিজের প্রযোজনায় এবং অন্যদের প্রযোজনায় নিজের উদ্যোগে সহকারীদের পরিচালনায় নির্মাণ করেছিলেন বেশ কয়েকটি মেইনস্ট্রিম সিনেমা যার সবগুলোই দর্শকনন্দিত। গড়ে তুলেছিলেন এদেশের প্রথম ও একমাত্র চলচ্চিত্র সমবায়–সিনে ওয়ার্কশপ। এই সমবায়ে সংযুক্ত করেছিলেন একাধিক পরিচালক, অভিনয়শিল্পী, সংগীতকার, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, চিত্রগ্রাহক এবং অন্যান্য কলাকুশলী। সিনে ওয়ার্কশপ থেকে নির্মিত হয়েছিল বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র।
চলচ্চিত্রের বিভিন্ন শাখায় ছিল তাঁর অনায়াস চলাচল। প্রযোজনা ও পরিচালনার পাশাপাশি কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গান রচনা এবং চিত্রগ্রহণসহ অন্যান্য কারিগরি ক্ষেত্রেও ছিল তাঁর সহজাত দক্ষতা।
রাজনীতিতে তাঁর সম্পৃক্ততা কৈশোরকাল থেকে। প্রগতিশীল রাজনীতির আদর্শে বিশ্বাসী জহির রায়হানের মতাদর্শের প্রভাব তাঁর বিভিন্ন সৃষ্টিকর্মে বিশেষ করে সাহিত্যে নিবিড়ভাবে খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৫২–এর ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন অগ্রবর্তী সৈনিক। ১৯৬৯–এর গণ অভ্যুত্থানের আন্দোলনেও তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। বস্তুত এর উপর ভিত্তি করে তিনি নির্মাণ করেন তাঁর অগ্নিগর্ভ চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়া, যে ছবি সে আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। উজ্জীবিত করেছিল সে সময়ের বাঙালি জাতিকে যারা স্বাধীনতার জন্যে পাগলপারা হয়ে উঠেছিল। এ–ছবি এ–জাতিকে এখনও উদ্বেলিত করে। কিংবদন্তী এক চলচ্চিত্র। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এরকম ঘটনা খুব বেশি নেই।
১৯৭১–এর মুক্তিযুদ্ধেও জহির রায়হানের ছিল প্রত্যক্ষ ভূমিকা। ১৯৭১ সালে কলকাতায় গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা শিল্পী সংসদ। জহির রায়হান ছিলেন এর সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি আবদুল জব্বার খান। শিল্পী সংসদের অধীনে জহির গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ লিবারেশন ফিল্ম ফ্রন্ট। ফ্রন্ট থেকে চারটি প্রামাণ্যচলচ্চিত্র নির্মিত হয়। স্টপ জেনোসাইড ও এ স্টেট ইজ বর্ণ নির্মাণ করেন জহির নিজে। লিবারেশন ফাইটার্স নির্মাণ করেন আলমগীর কবির এবং বাবুল চৌধুরী নির্মাণ করেন ইনোসেন্ট মিলিয়নস। এই দুটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয় জহির রায়হানের তত্ত্বাবধানে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনসমর্থন আদায়ের আন্দোলনেও তিনি বিভিন্নভাবে সক্রিয় ছিলেন। স্বাধীনতার পর অনেক কাজের পরিকল্পনা ছিল তাঁর। ধীরে বহে মেঘনার পরিকল্পনা করেছিলেন। পরে ছবিটি পরিচালনা করেন আলমগীর কবির। কিন্তু লেট দেয়ার বি লাইট ছবিটি শেষ করা হলো না আর তাঁর।
লেখালেখি ও রাজনীতির পাশাপাশি জহির সম্পৃক্ত ছিলেন পত্রিকা সম্পাদনাতেও। যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন সাহিত্য পত্রিকা অনন্যা ও যাত্রিক। এককভাবে সম্পাদনা করতেন খাপছাড়া। ১৯৭০ সালে প্রকাশ করেন ইংরেজি পত্রিকা এক্সপ্রেস। সাহিত্য ও বিনোদনের পাশাপাশি এসব পত্রিকায় রাজনীতি ও সমাজ সচেতনতার উপস্থাপনাও ঘটতো।
সাহিত্যিক জহির রায়হান লিখেছেন কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প ও উপন্যাস। তাঁর রচনাশৈলী ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বাক্যগঠন, শব্দচয়ন, শব্দ প্রয়োগ এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট অভিনবত্ব পরিলক্ষিত হয় তাঁর লেখালিখিতে। দুটি ছোটগল্প সংকলন, সাতটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। দুই খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচনাবলী ড. আশরাফ সিদ্দিকীর সম্পাদনায়।
বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী জহির রায়হান ছিলেন আশ্চর্যজনক কর্মপটু। মাত্র ৩৮ বছরের স্বল্পায়ুর জীবনে তিনি দক্ষতা দেখিয়ে গেছেন রাজনীতি, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বর্ণস্পর্শী দক্ষতার পরিচয় এবং স্বাক্ষর রেখে গেছেন।