চট্টগ্রামের ভাষার স্বতন্ত্র পরিচয় লিপিবদ্ধ হওয়া জরুরি

রিজোয়ান মাহমুদ | সোমবার , ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৪:২৬ পূর্বাহ্ণ

যে কোনো জনপদে মানুষের আবেগ অনুভূতি ও উপলব্ধির জায়গা প্রথমে স্থানিক। ভাষা সংস্কৃতি ও জীবনের গল্প স্থানিক ও মৌলিক। মানুষ সর্বদা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যেই বাস করে। সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক পরিপালন যেহেতু ভাষার ভিতর দিয়ে ঘটে সেহেতু একটা স্থানিক সাংস্কৃতিক আধিপত্য সর্বদা থেকে যায় প্রতিটি স্থানিক মানুষের আবেগ অনুভূতিতে। সেটি শুধু চট্টগ্রাম বা একটা অঞ্চলের নয়। প্রতিটি স্থানিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব অধিকারও বটে, এটি। জন্ম বেড়ে ওঠা শৈশবের বড় একটা অংশ মায়ের সান্নিধ্যে কাটাতে হয় প্রতিটি জনপদের মানুষকে। স্থানিক সংস্কৃতির রূপ পরিবর্তন ঘটতে পারে যদি কখনো গ্রামগুলো ধীরে ধীরে আধুনিকতার ছোঁয়ায় শহর হয়ে ওঠে। পুরো দেশের চেহেরা যেমন গ্রামের পরে একেকটি মহকুমা শহর এসে ঠেকে ঠিক তেমনি একেকটা বড় শহরও স্থানিক বিভূতি নিয়ে গড়ে উঠতে পারে স্থানিক শহর সংস্কৃতি ও ভাষা কাঠামোতে। সর্বোপরি, একটা দেশ রাষ্ট্রের ইউনিফর্ম সংস্কৃতি বিল্ড হতে পারে। জনপদের মানুষ মূলত সুবিধাভোগী এবং ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চায়। এই চাওয়ার মানস প্রবণতা মানুষকে শহরমুখী করবে, নির্ঘাত। অতঃপর শহরের আয়তন নানাবিধ সুযোগ সুবিধা নিয়ে বেড়ে উঠবে নাগরিক সংস্কৃতি। অর্থাৎ গ্রামের স্থানিকতা খানিক পরিবর্তিত হয়ে ধীরে ধীরে অঞ্চলভেদে শহরাঞ্চল সংস্কৃতি ও ভাষা গড়ে ওঠবে। মানুষ শেষ পর্যন্ত স্থানমুখি। বেলাশেষে ফিরতে চায় নিজ গাঁয়ে, নিজ জন্মস্থলে।

বাংলাদেশের ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলে। বিশ্বের ১০০ টি কথ্য ভাষার তালিকায় স্থান পায় বাংলা ভাষায় লিখিত ও কথ্যরূপ চাটগাঁইয়া ভাষা। চট্টগ্রামের ভাষা মূলত ইন্দোআর্য ভাষাগোষ্ঠীর একটি সহযাত্রিক ভাষা। মূল বাংলা ভাষার সাথে চট্টগ্রামের কিছু শব্দগত সম্বন্ধ বিদ্যমান থাকায় একে প্রায়ই বাংলার উপভাষা মনে করা হয়। চাটগাঁইয়াদের নাড়ীর স্পন্দন সঞ্চারিত আবেগ অনুভূতির জায়গা বিশেষ দখল নিয়েছে চট্টগ্রামের ভাষা।

এই ভাষার নির্দিষ্ট বর্ণ আবিস্কৃত না হলেও মৌলিক কথ্যরীতি ও চারিত্রিক স্বাতন্ত্র্যে এক অভিনব যোজন ক্ষমতা রয়েছে ভাষাপ্রবাহে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষ উদারতা ও মহানুভবতায় নজির স্থাপন করেছে সর্বত্র। একটি অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবন ঘটে ভাষার ভিতর দিয়ে। ঠিক তেমনি জন মানসের রুচিসূচি ও সাহিত্য নিয়ে বৃহত্তর একটা লোকঅঞ্চল গড়ে ওঠা অস্বাভাবিক নয়। ভারতবর্ষ ২৯ টি রাজ্য ও আটটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজ্যসংঘ। রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি আবার জেলা ও ক্ষুদ্রতর প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত। অথচ প্রায় ১৫০ কোটি মানুষের দেশ ভারত একটা ইউনিফর্ম ভারতরাষ্ট্র। এবং প্রত্যেক অঞ্চলে নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে সাহিত্য ও সাহিত্যিক তৈরি হয়ে আসছে। প্রত্যেক জনপদের মানুষের সুখদুঃখ গাথা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ দর্শনঋদ্ধ আঞ্চলিক সাহিত্য তৈরি হচ্ছে। ভারত বহুভাষীর দেশ হলেও রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আনুগত্য ভারত কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের দিকে। ভারতের ঐক্য দেশপ্রেম এবং রাষ্ট্রের প্রতি সম্মিলিত আনুগত্য প্রকাশ। শক্তিশালী দেশপ্রেম ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও দেশটিকে এভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। সেই সাথে প্রাদেশিক আঞ্চলিকতাকেও ভুলে যায়নি। হিন্দি ভারত সরকারের ঘোষিত রাষ্ট্র ভাষা হলেও কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারে নি। এর প্রধানতম কারণ ভাষা বিচ্ছেদের চেয়ে মিলনাগ্রাসী মনোভাবে চর্চিত। ভারতে অন্তত ২৩ টি সাংবিধানিক স্বীকৃত সরকারি ভাষা রয়েছে। রাজ্য সরকার স্বাধীনভাবে তাদের নিজ নিজ দাপ্তরিক ভাষা ব্যবহার করে। হিন্দি ও ইংরেজি সাধারণত কেন্দ্রীয় সরকারের একটি আনুষ্ঠানিক ভাষা। অধিকন্তু ভারতীয় ভাষা ইন্দোইউরোপীয় ৭৫ শতাংশ, ইন্দো আর্য, দ্রাবিড় ২১ শতাংশ, অস্ট্রোশিয়াটিক ১., শতাংশ, চীন তিবেটান ০.৮ শতাংশ। উর্দু কন্নড় ওডিয়া মালয়ালম থেকে শুরু করে মুণ্ডারি ভাষা পর্যন্ত অন্তত ২২ টি স্বাধীন ভাষায় সাহিত্য রচিত হয় তাদের নিজস্ব বর্ণমালায়। উল্লিখিত এই স্থানীয় প্রাদেশিক স্বীকৃত ভাষার মধ্যে তেলেগু কন্নড় হিন্দি উড়িয়া অসমীয়া তামিল কাশ্মীরি ভাষার সাহিত্য অনেক উঁচুমানের। উদাহরণস্বরূপ, কবি হলধর নাগ, উড়িয়া রাজ্যের কোশলি ভাষায় সাহিত্য রচনা করে ২০১৬ সালে পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত হয়েছেন। একজন অসাধারণ লোক কবি, বিস্ময়কর প্রতিভা। তাঁকে ভারতের বিভিন্ন নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। সে দিক থেকে বাংলাদেশ ৮ টি বিভাগ ৬৪ জেলায় বিভক্ত। প্রত্যেক জেলার মানুষ ভিন্ন ভিন্ন স্থানীয় ভাষাতে কথা বলে। মাঝেমধ্যে কথন ভঙ্গির কোনো কোনো জায়গায় স্বর উচ্চারণে সাদৃশ্য পাওয়া গেলেও মৌখিক ভাষার স্বাতন্ত্র্য লক্ষণীয়। বাংলাদেশের প্রথম জেলা চট্টগ্রাম জেলা, ১৬৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অন্যান্য অনেক মৌখিক ভাষার দেশ হলেও স্থানিক ভাষালিপি তৈরি না হওয়ার কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র একভাষী রাষ্ট্র অভিধায় বিবেচিত এই দেশ। এছাড়াও বাংলাদেশ অঞ্চলভেদে মৌখিক বাংলা উচ্চারণে যথেষ্ট রূপভেদ লক্ষ্য করা যায়। সুক্ষ্মভাবে যদি বলা যায় তো চট্টগ্রাম অঞ্চল ও সিলেট অঞ্চলের ভাষা মূল বাংলা ভাষা থেকে অনেকটাই ভিন্ন। অনেক পূর্বে সিলেট অঞ্চলে সিলেট নাগরী লিপি সিলেট ভাষার লিখিত রূপ ছিল। বর্তমানে অনভ্যস্ততার কারণে সেটি আর লেখা হয় না। সিলেটে নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষায় অর্থাৎ নাগরী আবহে অনেক আগে থেকে সংগীত সাহিত্য কবিতা তৈরি হয়েছে এখন বাংলা হরফে সিলেটের অনুভূতি বোঝা ও ধরা হচ্ছে। চট্টগ্রমের ভাষার যেহেতু নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই তাই বাংলা অক্ষরে দীর্ঘদিন থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে চট্টগ্রামি কবিতা গল্প ছড়া। কমপক্ষে একশ বছর আগে থেকে মানুষের মুখে মুখে উল্লেখযোগ্য গান ছড়া এবং ঘটনা প্রবাহের ধারাক্রম গল্প লোককথা চট্টগ্রাম বাসীর প্রাণের আবেগে মথিত হয়েছিল স্থানিক শিল্পের নির্যাসে। সেটি আবার নতুন করে উজ্জীবিত হচ্ছে এসময়ে এসে। বারোমাইশ্যা নামক চট্টগ্রামের ভাষায় একটা উপন্যাসও রচিত হয়েছে গতশতকের ত্রিশের দশকে সাহিত্যিক চিত্ত সিংহ এর হাত ধরে। প্রিয় কথাসাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদের কর্ণফুলী উপন্যাসের চরিত্র চিত্রিত হয়েছে চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহারে। উভয় বাংলার জনপ্রিয় ছড়কার সুকুমার বড়ুয়া কোয়াল খাইয়ে ছড়াগ্রন্থের নামকরণ চট্টগ্রামের বিশুদ্ধ আঞ্চলিকতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আবার গানের কথা বলতে গেলে চট্টগ্রামের ভাষার মানবিক ও দৈহিক আবেদনের শক্তি পরখ করা সহজ হয়ে উঠে। কী অসাধারণ সুরতাল প্রেমরস ও আদিরসে ভরা একেকটা গান। জীবন নদীর ফুল ফল পাখি ও প্রকৃতি নিয়ে ছড়া গান কবিতা প্রতিদিন কিছু না কিছু রচিত হচ্ছেই।

গান ও ছড়া শুনতে শুনতে চট্টগ্রামের বাইরে অনেকেই এখন চট্টগ্রামে ভাষা বুঝতে চেষ্টা করে। সুরের কারণে আনন্দে উদ্বেলিত মশহুর হয়ে উঠে সব শ্রেণির মানুষ। সংস্কৃতির আদান প্রদান হচ্ছে বৃহত্তর সিলেটের সাথে চট্টগ্রামের। উত্তর বঙ্গের সাথে চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জেলাশহরের।

সম্প্রতি চট্টগ্রামি ভাষার আধুনিক কবিতা কর্ণফুলীর মাঝি ‘উপরোক্ত শিরোনামে একটি কবিতা সংকলন বেরিয়েছে। নোঙরনদীতীরের আবছায়া বসতবাটি নিয়ে লাল ও হলুদ রঙের প্রচ্ছদে শোভিত সংকলনটি সবার নজর কেড়েছে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও আলোচনা হচ্ছে ছোট পত্রিকাটি নিয়ে। বাংলাভাষা থেকে ধার করা শব্দ নিয়ে প্রকাশিত কবিতাগুলো বাড়তি মনোযোগের বিষয় হয়ে উঠেছে। সংকলনটির সম্পাদক আশির দশকের বিশিষ্ট কবি স্পর্শ পত্রিকার সম্পাদক আবু মুসা চৌধুরী। ২৮ জন কবির কবিতা নিয়ে সাজানো পত্রিকাটি চট্টগ্রামের যথার্থ উত্তরাধিকারকে চিহ্নিত করে। কবিতাগুলো ধারণ করেছে সময়ের যথার্থ মানবিক আবেগ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, রাজনীতি ও সমাজের বিবিধ উৎসারণ। জব্বরের বলী খেলার ভেতরে বিরূপ প্রকৃতির ফোর্স জলের তোড়ে ভেসে যাওয়া মানুষের করুণ আহাজারির গল্প। অসাধারণ ভাতকাব্য গল্প এবং মেয়ে ছেলের চরিত্র চিরায়ত প্রেমের এক নিপুণ শব্দকর্ম যেন। এমনকি এই সংকলনের বিষয় হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক অনুষ্ঠিত হওয়া বিশ্ব ফুটবলের ঘটনা প্রবাহ। চট্টগ্রামের কবিদের আবেগ পানসে নয়, তরল ও গরল নয়, বোঝা গেছে। কবিতা বিষয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল ও পরিণত। চট্টগ্রামের ভাষা মূলত বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের দ্বিতীয় মাতৃভাষা। এ ভাষা প্রকৃতিতে সংস্কৃতি ও জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেকখানি উৎরে গেছে। গভীর বেদনাবহ ও আক্ষেপের বিষয় ভাষাটির স্বতন্ত্র পরিচয় লিপিবদ্ধ না হওয়া এবং গভীর অন্ধকারে থেকে যাওয়া। তবে মৌখিক ভাষা হিসাবে অনেক জনপ্রিয় চট্টগ্রামের ভাষা সংস্কৃতি।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধএক দেশ দুই নীতির হংকং
পরবর্তী নিবন্ধসর্বজনীন পথিকৃৎ গাউছুল আজম শাহ্‌সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.)