এক দেশ দুই নীতির হংকং

এম. সোহেল খান | সোমবার , ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৪:২৫ পূর্বাহ্ণ

হংকংকে বলা হয় এক দেশ দুই নীতির দেশ। ১৯৯৭ সাল থেকে হংকং চীনের একটি অঙ্গরাজ্য হলেও হংকং একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। হংকং এর পতাকা, মুদ্রা ও সরকার ব্যবস্থা সবই চীন থেকে আলাদা। হংকং এর পুরো নাম হংকং স্পেশাল এডমিনিস্ট্রেটিভ রিজিয়ন বা হংকং এস. . আর। ব্যাংকে চাকরির সূত্রে আমার প্রায় সাত বছর পরিবারসহ হংকং এ থাকার সুযোগ হয়েছিল। ২০০০ সালে আমি প্রথম হংকংএ যাই। বিমান বন্দরে নেমে, বিমান বন্দরের বিশালত্ব দেখে অবাক না হয়ে পারিনি। কারণ এই ছোট একটা দেশে এত বড় বিমান বন্দর আশা করিনি।

হংকং এর মোট আয়তন প্রায় ২৭৫৫ বর্গকিলোমিটার। হংকং আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নাম চেক্‌ লেপকক্‌। এই বিমান বন্দর বৃটিশরা চীনের কাছে হস্তান্তরের পূর্বে নির্মাণ করে। এই বিমান বন্দর বিশ্বের ব্যস্ততম বিমান বন্দরগুলির মধ্যে অন্যতম। এই বিমান বন্দরে বছরে প্রায় ৫৩ মিলিয়ন যাত্রী ওঠানামা করে। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং আধুনিক বিমান বন্দর। বিমান বন্দরে শপিং মল এ বিশ্বের সব নামিদামী ব্রান্ডের দোকান এবং নামিদামী প্রায় সব ফুড চেইন এর দোকান আছে। বিমান থেকে নেমে প্রথমে ট্রেনে পরে চলন্ত পথ অতিক্রম করে সহজে ইমিগ্রেশন অতিক্রম করে আগমনী হলে এসে পৌঁছলাম। বিমান বন্দর মূল শহর থেকে অনেক দূরে লেন্‌টাউ দ্বীপে অবস্থিত। বিমান বন্দর থেকে শহরে ট্রেন, বাস ও টেক্সিতে যাওয়া যায়। আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করার জন্য আমার অফিস থেকে দুইজন সহকর্মী এসেছেন তাঁরা সময় বাঁচানোর জন্য ট্রেনে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। এয়ারপোর্টের ভিতর ঝামেলা ছাড়াই লাগেজ নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। অতি আধুনিক দ্রুত ট্রেন। আমরা প্রায় ২০ মিনিটের মধ্যে শহরের সেন্ট্রাল স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। স্টেশন থেকে অফিসের গাড়ি নিয়ে আমাদের জন্য ৫ তারকা মানের যে হোটেল বুক করা ছিল ওখানে উঠলাম। আমি বাসা না নেওয়া পর্যন্ত আমাদের এই হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করা হল। ৫ তারকা মানের হোটেল হলেও হোটলের বদ্ধ রুমে আমাদের ভাল না লাগাতে আমরা তিনদিনের মধ্যে বাসা নিয়ে হোটেল ছেড়ে দিলাম। হংকং পৌঁছে পরের দিন আমি অফিসে যোগদান করলাম। আমাদের অফিসে সহকার্মীদের মধ্যে বেশির ভাগই হংকং এর স্থানীয় বাকীরা ভারতীয়, বাংলাদেশি এবং পাকিস্তানি। সহকর্মীরা অত্যন্ত আন্তরিক হওয়াতে আমার এডজাস্ট করতে বেশি সময় লাগল না। হংকং এ ব্যাংকের অফিস সময় সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। শনি ও বরিবার বন্ধ হলেও শনিবার সকাল ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত আংশিক কাজ চলত।

হংকং এর জনসংখ্যা প্রায় ৭৪ লক্ষ, প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনঘনত্ব প্রায় ৬ হাজার, জিডিপি প্রায় ৪১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, নেটওয়ার্থ প্রায় ৩৫৫ বিলিয়ন ডলার। জনপ্রতি বার্ষিক আয় প্রায় ৪৯ হাজার মার্কিন ডলার। বিলিওনিয়ার সংখ্যার দিক থেকে হংকং বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধনী শহর। রোলস রয়েস গাড়ির সংখ্যার দিক থেকে হংকং বিশ্বে প্রথম। হংকং এ প্রায় ১২০০ আকাশ চুম্বি অট্টালিকা আছে। তারপরও হংকং এর প্রায় ৪০ শতাংশ খোলা জায়গা আছে। হংকং এর উল্লেখযোগ্য বিল্ডিংগুলো হল ব্যাংক অফ চায়না টাওয়ার, এইস, এস, বি, সি বিল্ডিং, কসকো টাওয়ার ইত্যাদি। হংকং জাপানের পর বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর। হংকং এর মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৮১ বছর। হংকং এর পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অত্যন্ত উন্নত। তাই ৭০ শতাংশ মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি থাকা সত্ত্বেও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে। হংকং এর মানুষের আইকিউ লেভেল ১০০ এর উপরে যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। বিশ্বের সব চেয়ে উন্নত সাবওয়ে হংকং এ এবং বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ চলন্ত সিঁড়ি হংকং এ, যা সেন্ট্রাল থেকে মিডলেভেল পর্যন্ত। এটার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬০০ফুট। সুপেয় পানির অপচয় রোধে হংকং টয়লেট এর ফ্লাশ এর কাজে সমুদ্রের পানি ব্যবহার করে। ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় রোধে যা আমরাও অনুসরণ করতে পারি। হংকং আইল্যান্ড, লামা আইল্যান্ড ও লেন্‌টাউ আইল্যান্ড নিয়ে হংকং এস, , আর গঠিত। হংকং এর একদিকে দক্ষিণ চীন সাগর অন্যদিকে গণ চীন অবস্থিত। হংকং এর আবহাওয়া অনেকটা বাংলাদেশের মত তবে শীতকালে একটু ঠাণ্ডা বেশি। এখানকার মানুষ অত্যন্ত কর্মঠ। নারীপুরুষ উভয়ে কাজ করে। হংকং এ বাংলাদেশিরা মোটামুটি ভাল অবস্থানে আছে যার বেশিরভাগ ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও অন্যন্যা চাকরিজীবী। কিছুসংখ্যক ছাত্র হংকং এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়াশুনা করে। হংকং এ প্রচুর বাংলাদেশি মালিকানাধীন কোম্পানি আছে। বিশ্বের প্রায় সব বড় বড় গার্মেন্টস ব্রান্ডের বায়িং অফিস হংকং এ অবস্থিত। হংকং এর ব্যাংকিং ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। বিশ্বের সব বড় বড় ব্যাংকের শাখা হংকং এ আছে। হংকং এর মুদ্রার নাম হংকং ডলার। যা বর্তমানে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১২ টাকা। হংকং এর দর্শনীয় উল্লেখযোগ্য স্থান গুলি হলডিজ্‌নী ল্যান্ড, ওশান পার্ক, ভিক্টোরিয়া হার্বার, পিক ও টাইম স্কয়ার ইত্যাদি। পিক ট্রাম্পও স্টার ফেরী অনেক প্রাচীন এবং ওদের ঐতিহ্যের অংশ। বিশ্ববিখ্যাত অভিনেতা ব্রুসলী এবং জেকী চেন্‌ জন্মগতভাবে হংকং এর। আমার একবার জেকী চেন এর বাড়ি দেখার সুযোগ হয়েছিল। আর একবারের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল বিকেলে অফিস থেকে বের হয়ে হংকং এর বিখ্যাত শপিং মল প্যাসিফিক প্যালেস এর ভিতর দিয়ে গাড়ি পার্কিং এর দিকে যাওয়ার সময় দেখলাম ওয়ালস্‌ নামক বিখ্যাত বইয়ের দোকানে ভিতর সামান্য জটলা এবং টিভি ক্যামরাসহ লোকজন তখন আমি আগ্রহ নিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখলাম প্রাক্তন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ওনার লেখা বই উদ্বোধন করছেন। কিন্তু নিরাপত্তার রক্ষীর কোনো বাহুল্য না থাকায় খুব কাছ থেকে উনাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আর একবার এই বুক স্টোরেই ভারতের বুকার পুরস্কার জয়ী লেখিকা অরুন্ধতী রায় এর সাথে সাক্ষাত হয়েছে। হংকং এ ভারতীয় অনেক বিখ্যাত শিল্পীর অনুষ্ঠান দেখার আমার সৌভাগ্য হয়েছে। যেমনশাহরুখ খান, হেমা মালিনি, ঐশ্বরিয়া রায়, এশা দেওল, .আর রহমান ইত্যাদি। তাছাড়া বিখ্যাত বৃটিশ গায়ক স্যার এল্‌টন জন এর অনুষ্ঠানও দেখেছি। হংকং চমৎকার ধর্মীয় সহঅবস্থানের জায়গা। ধমর্, বর্ণ বা জাতিগত পরিচয়ে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করে। হংকং এ বেশ কয়েকটি মসজিদ আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কাউলুন মসজিদ এবং ওয়ানচাই মসজিদ। হংকং এ অন্যন্যা ধর্মের উপসানালয় আছে, যে যার ধর্ম পালন করে। এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হল কাউলুন ও ওয়ানচাই মসজিদে শুক্রবারে জুমার পর হালাল খাবারের ব্যবস্থা আছে। তাছাড়া পুরো রমজানে মসজিদগুলিতে বিনামূল্যে মুসল্লীদের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। হংকং এর লোকজন ভাগ্য গণনায় খুব বিশ্বাস করে তাই যে কোনো বড় বিল্ডিং বা স্থাপনা নির্মাণের পূর্বে ওরা একজন ভবিষ্যত গণনাকারীকে দিয়ে বিল্ডিং এর মুখ বা দরজা/জানালা কোন দিকে হলে শুভ হবে তা গণনা করে নেয় যাকে ওরা ফুংশই বলে। হংকং এর লোকজন ৪ সংখ্যাকে অশুভ মনে করে তাই বিল্ডিং বা কোনো স্থাপনার নাম্বার এ ওরা ৪ সংখ্যা ব্যবহার করে না। হংকং এর শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থাও অত্যন্ত উন্নত। তবে বেসরকারি স্কুল/কলেজ বা বেসরকারি ক্লিনিক খুবই ব্যয় বহুল। সরকারি হাসপাতালগুলির চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত তাই বেসরকারি ক্লিনিক এ যাওয়ার খুব একটা প্রয়োজন হয় না।

হংকং শহরের ব্যাপারে নিউইয়র্ক এর মত একটা কথা প্রচলিত আছেহংকং নাকি কখনো ঘুমায় না। রাতের হংকং আরও ঝল্‌মল্‌ ও উজ্জ্বল। বিনোদনের সবরকম উপকরণ হংকং এ আছে। যে যার মত আনন্দ উপভোগ করতে পারে। চীন নববর্ষ, ক্রিসমাস ও ইংরেজী নববর্ষ এখানে খুব ঝাঁকঝমক এর সাথে পালন করা হয়। তখন পুরো শহরে আলোক সজ্জিত করা হয় এবং নানারকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। হংকং এর লোকজন প্রধানত ক্যান্টোনিজ ভাষায় কথা বলে তবে ইংরেজিও বহুল প্রচলিত। হংকং এর আইন ব্যবস্থা বৃটিশ আমলের তৈরী এবং উন্নত। আমি কিছুদিন হংকং হাইকোর্ট এর জুরার থাকাতে তা কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছি। বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু হংকং, চীন এবং ম্যাকাওকে সংযুক্ত করেছে যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৫ কিলোমিটার। যার মাধ্যমে হংকং থেকে সহজে চীন ও ম্যাকাও যাওয়া যায়। হংকং এর কাছের চীনের শহর হল শেনজেন। শহরটি খুবই সুন্দর ও আধুনিক। আর ম্যাকাও হল লাস্‌ভেগাস এর মত ক্যাসিনোর শহর।

হংকং এক সময় বাংলাদেশিদের ১৪ দিনের পোর্ট এন্ট্রি ভিসা দিলেও বর্তমানে এ সুবিধা নেই। বর্তমানে বাংলাদেশিরা ভ্রমণ করতে গেলে আগে থেকে ভিসা নিয়ে যেতে হয়। আমি ও আমার পরিবার রেসিডেন্স হিসেবে প্রায় ৭ বছর থাকার সুবাদে হংকং পাসপোর্ট পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলেও হংকং ইমিগ্রেশন আমাকে বাংলাদেশ পাসপোর্ট সারেন্ডার করতে বলায় আমরা আর হংকং পাসপোর্ট নিতে আগ্রহী হইনি। হংকং বর্তমানে ধীরে ধীরে চীনের শাসনের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যা স্থানীয়রা মানতে রাজি নয়। ওরা স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার ও সমাজকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনবীনচন্দ্র সেন : যুগপথিক কবি
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের ভাষার স্বতন্ত্র পরিচয় লিপিবদ্ধ হওয়া জরুরি