বিশ্বকাপ কখনো হাসায় আবার কখনো কাঁদায়। বিশ্বকাপ কোথাও আনন্দের বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে ভাসে আবার কোথাও চোখের জলে বুক ভাসে। বিশ্বকাপ কোন দলের জন্য বিমান সাজায় আবার কোন দল আঁধারে হারায়। বিশ্বকাপ কারো স্বপ্ন পূরণ করে আবার কারো স্বপ্ন ভাঙ্গে। বিশ্বকাপ ট্রফির পাশ দিয়ে হেটে গিয়েও একদল ছুঁতে পারেনা আবার সোনালী বিশ্বকাপকে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় আরেকদল। বিশ্বকাপের অমোঘ নিয়মই যেন তেমন। হাসি, কান্না, আনন্দ, বেদনা, হতাশার মিশেলে শেষ হলো আরো একটি বিশ্বকাপ। বিদায় কাতার। দেখা হবে ২০২৬ সালে মধ্য আমেরিকায়। যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো এবং কানাডায় অনুষ্ঠিত হবে পরের বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপে সব আনন্দে কেউ হাসেন বিজয়ের উল্লাসে। কেউ ডোবেন হতাশার চোরাবালিতে। হাসি-কান্নার এই লুকোচুরি খেলা শুরু হয়েছিল ২০ নভেম্বর। শেষ হলো ১৮ ডিসেম্বর লুসাইল স্টেডিয়ামের ফাইনাল দিয়ে। জাদুকর লিওনেল মেসির ভুবন জুড়ানো হাসি দিয়ে ভাঙল কাতার বিশ্বকাপের মিলন মেলা। শুরু হলো পরের বিশ্বকাপের জন্য ।
এবারের বিশ্বকাপে সব চাইতে বড় প্রশ্ন ছিল একটি। মেসি কি পারবে বিশ্বকাপ জিততে। দীর্ঘ এক মাসের পথ পরিক্রমা শেষে ফুটবল যেন তার ঋণ শোধ করল এই জাদুকরের হাতে ট্রফি তুলে দিয়ে। আর সে সাথে আর্জেন্টিনার মিটল ৩৬ বছরের হাহাকার। সাথে আরেকটি প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছিল ফুটবল প্রেমীদের মাঝে। আর তা হচ্ছে ছোট্ট মরুভূমির দেশে প্রথম বিশ্বকাপ কেমন হবে? দেশটি কি পারবে বিশ্বকাপের মত এমন মহাযজ্ঞ সম্পাদন করতে।
কাতার যেন সে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গোল্ডেন এ প্লাস লাভ করেছে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচাইতে সুন্দর এবং আকর্ষণীয় ইভেন্ট আয়োজন করে কাতার যেন দেখিয়ে দিল অদম্য সাহস আর লক্ষ্য যদি থাকে অটুট তাহলে সবই সম্ভব। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে এবারের বিশ্বকাপের সবচাইতে বড় অর্জন যেটা ছিল সেটা হচ্ছে অবিশ্বাস্য এক ফাইনাল। যা বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচাইতে আকর্ষণীয় এবং উত্তেজনাপূর্ণ ফাইনাল। এমন ফাইনালইতো চায় দর্শকরা। ফুটবলের সব রং, রূপ, রস যেন প্রাণভরে আস্বাধন করল ফুটবল প্রেমীরা।
তবে এবারের বিশ্বকাপের ফাইনালই যে কেবল আকর্ষণীয় ছিল তা কিন্তু নয়। সেই গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিল রোমাঞ্চকর বিশ্বকাপের ইশারা। শুরুটা করেছিল সৌদি আরব। পিছিয়ে পড়ার পর ‘চ্যাম্পিয়ন’ আর্জেন্টিনাকে পাঁচ মিনিটের ঝড়ে ২-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল তারা। চারবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে একই ব্যবধানে হারিয়ে চমক উপহার দিয়েছিল এশিয়ার আরেক দল জাপান। শেষ পর্যন্ত গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়ার হতাশায় ডোবে জার্মানি। এশিয়ার দলগুলো শেষ ষোলো থেকে ঝরে গেলেও ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার দলগুলোর ভিড়ে প্রবল প্রতাপে টিকে ছিল মরক্কো। আফ্রিকার এই দেশটি রীতিমতো মাতিয়ে রেখেছিল এবারের আসর। গত আসরের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়া ও বেলজিয়ামের মতো শক্তিশালী দলকে পেছনে রেখে গ্রুপ সেরা হয়ে নকআউট পর্বে আসে তারা।
এরপর একে একে তারা ‘আউট’ করতে থাকে বড় দলগুলোকে। শেষ ষোলোয় স্পেনের পর কোয়ার্টার-ফাইনালে বিদায় করে পর্তুগালকে। গ্রুপ পর্বে ক্যামেরুন হারিয়ে দিয়েছিল ব্রাজিলকে। কিন্তু কোয়ার্টার-ফাইনালে থামে ব্রাজিলের পথচলা। বিশ্বকাপ অর্ধেক সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। এবারের বিশ্বকাপের সেরা আটেই ছিল সবচাইতে উপভোগ্য ম্যাচটি। আর সেটি ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের। কিন্তু আগুন ছড়ানো লড়াইটিতে হেরে বিদায় নেয় ইংল্যান্ড। ১৯৬৬ সালের পর ইংলিশদের আরেকটি বিশ্বকাপের আশা উড়ে যায় কর্পুরের মতো। তবে এবারের বিশ্বকাপের দুই সেমিফাইনালের স্বাদ ছিল দুই রকম।
গত বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার পথে আর্জেন্টিনাকে ৩-০ গোলে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। নভগোরোদের সেই ম্যাচের উল্টো পুনরাবৃত্তি যেন লুসাইলে। এবার ক্রোয়েটরা মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারেনি। ৩-০ গোলে মধুর প্রতিশোধ নিয়ে ফাইনালের মঞ্চে অনায়াসে উঠে যায় দুইবারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। তাতে মদ্রিচ নামের এক যোদ্ধার বিশ্বকাপ স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। দ্বিতীয় সেমিফাইনালে থামে মরক্কো রূপকথা। যদিও ২-০ গোলে জিতে ফ্রান্স। কিন্তু মরক্কোর ঝাঁকুনিতে বারবার কেঁপেছে ফরাসিরা। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচেও ক্রোয়েশিয়ার কাছে হারে তারা। তবে আফ্রিকার প্রথম দল হিসেবে সেরা সাফল্যের গল্প লিখে আফ্রিকা-আরব-মধ্যপ্রাচ্য মাতিয়ে মাথা উঁচু করে বিদায় নেওয়ার তৃপ্তি সঙ্গী মরক্কো। এরপর লুসাইলের ফাইনালতো ইতিহাস সৃষ্টি করল।
আর তাতে লিওনেল মেসির হাতে উঠল বিশ্বকাপ। আর কিলিয়ান এমবাপে বিশ্বকাপ ট্রফির পাশ দিয়ে হেটে গেলেও স্বপ্নের ট্রফি ছুয়ে দেখা হয়নি। এবারের বিশ্বকাপে ভিনিসিউস, রিশার্লিসন, জুড বেলিংহ্যাম, জামাল মুশিয়ালা, রুবেন দিয়াস আরও কত তরুণের নাম ছিল সম্ভাবনাময়দের তালিকায়। একটু-আধটু ঝলক দেখিয়ে হারিয়ে গেছে সবাই। আবার ডি মারিয়া, জিরুদ, রোনালদো, গ্রিজম্যান, ক্যাসিমিরো, মদ্রিচ, পেপে, দানি আলভেস সহ অনেকের বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেছে।
প্রথমবারের মতো এক শহরে বিশ্বকাপ আয়োজন করে শুধু ইতিহাসই সৃষ্টি করেনি, সাথে ফুটবলপ্রেমীদের মনও জয় করে নিয়েছে কাতার। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে সারা বিশ্ব থেকে আসা ফুটবলপ্রেমীদের উদযাপন অবশ্য বাঁধনহারা হয়নি। যদিও শীতকাল, কিন্তু দিনে-দুপুরে বাইরে বেরুনো কঠিন। গা জ্বালা করা রোদে সমর্থকদের থাকতে হয়েছে অন্দরে। সন্ধ্যার পর থেকে অবশ্য মোশেইরেবে, সুক-ওয়াকিতে, কর্নেশিয়ার ফ্যান জোনে, ফ্ল্যাগ প্লাজায়, কনমেবল মিউজিয়ামে সমর্থকরা পেয়েছেন অবাধে উদযাপনের সুযোগ। ম্যাচ শুরু হলে মেট্রো, বাস মুখরিত হয়েছে নানা দলের সমর্থকদের নানা ভাষার কোরাসে। গ্যালারিও ছিল সমর্থকে ঠাসা।
সব মিলিয়ে অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু, সমকামীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব, তাপমাত্রাসহ নানা ইস্যুতে সমালোচনার মুখে থাকা কাতার গোছালো আয়োজনে আড়াল করে দিয়েছে অনেক কিছু। বিশ্বকাপের জন্য ৮টি স্টেডিয়াম তৈরি করেছিল কাতার। বাটি, টুপি, ঝিনুক-মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্য ফুটিয়ে তোলা হয় সাতটি স্টেডিয়ামে। এই সাতটি টিকে থাকবে। শিপিং কনটেইনার দিয়ে বানানো স্টেডিয়াম-৯৭৪ কেবল গল্প হয়ে যাবে।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে পুরোপুরি অপসারণযোগ্য প্রথম স্টেডিয়াম এটি। সেটি এরই মধ্যে ভেঙ্গে ফেলা শুরু হয়েছে। অনাগত দিনে এর কথা তাই শুধু থাকবে কাগজে-কলমে। তবে এবারের বিশ্বকাপের সবচাইতে বড় গল্পটি লেখা থাকবে একটি পাতায়। আর সে পাতাটি সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বলতা ছড়াবে। যে পাতায় লেখা থাকবে মহাতারকা মেসির বিশ্বকাপ জয়ের গল্প। চার বছর পর ২০২৬ সালে পরের বিশ্বকাপের আয়োজক কানাডা-মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র। মেসিময় বিশ্বকাপের পর দিন থেকে শুরু হলো দিন গোণা।