হইচই করে, আড্ডা দিয়ে, প্রচণ্ড শীত আর বয়সকে উপেক্ষা করে উত্তর সাগর পাড়ের এই অতি উন্নত দেশটির এদিক–ওদিকে বেড়িয়ে দেখতে দেখতে চোখের পলকে কেটে গেল কটা দিন। ভালোয় হোক আর মন্দে দিন কাটে সবার, সময় ও দিন কারো জন্যে থেমে থাকেনা। দিন কারো জন্যে গড়িয়ে গড়িয়ে চলে, কারো টেনে টেনে। সপ্তাহ কয়েক আগে দিন পাঁচেক আমাদের দিনগুলি বেশ ভালোই কেটেছে। দেশ থেকে কেউ এলে আমাদের রুটিনে–চলা দিনগুলোয় একটু ব্যতয় ঘটে বটে, কিন্তু আমাদের ভালো লাগে।
আর সে ‘কেউ’ যদি হন চট্টগ্রাম থেকে আসা এম এ মালেক। তাহলে তো কথাই নেই। এম এ মালেকের আর কোন পরিচয় দেবার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনে। অনেকে যেমন বলেন, চট্টগ্রামে কেবল একজনই এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী ছিলেন, ঠিক তেমনটি করে বলতে হয়, চট্টগ্রামে কেবল একজনই এম এ মালেক আছেন। তার আর বাড়তি কোন পরিচয় দেবার প্রয়োজন আছে বলে অন্তত আমি মনে করিনে। চট্টগ্রামে অনেক ‘অর্থবান’, ‘বিত্তবান’ আছেন, কিন্তু ইংরেজিতে যাকে বলে, ইন রিয়েল সেন্স অব দি টার্ম ‘বড়লোক’ খুব একটা নেই। ‘বড়লোক’ যিনি, তাকে সকল অর্থে সকল বিচার্যে ‘বড়’ হতে হবে। তাকে অর্থবান ছাড়া বড় হৃদয়ের অধিকারী হতে হবে, মানুষকে সেবা করার মত মন–মানসিকতা থাকতে, সবার সাথে সুখ–দুঃখ ভাগাভাগি করার মত ইচ্ছে থাকতে হবে।
সব অর্থবানদের ক্ষেত্রে সেটি হয়না। এম এ মালেকের ক্ষেত্রে হয়। আর হয় বলেই এম এ মালেক দেশের আর দশ অর্থবানদের চাইতে ভিন্ন। এ কেবল আমার কথা নয়। এ কোন বাড়াবাড়ি নয়। যারা তাকে চেনেন, যারা তাকে জানেন, অন্তত তার সম্পর্কে যারা শুনেছেন এটি জানেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাংলা দৈনিক পত্রিকা দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক এই হাতেগোনা বড়লোকদের মধ্যে কেবল একজন নন, তিনি একেবারে অন্যতম। আর পাঁচজনকে ছাড়িয়ে তিনি আপন সৌরভে দীপ্তমান। তার অর্থ আছে, অহং নেই। বিদ্যা আছে, দেখানোর প্রবৃত্তি নেই। সমপ্রতি তার হল্যান্ড সফরকালে তার কাছে তার উপর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘অগ্রপথিক এম এ মালেক সম্মাননা স্মারক’ গ্রহণ করি।
সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় বের হলে দেশ থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের ভূতপূর্ব পরিচালক বন্ধু শফিকুল আলম খান খুদে বার্তা পাঠিয়ে মন্তব্য করেন, ‘চট্টগ্রামে সবাই দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক সাহেবকে নমঃ নমঃ করেন, ওনাকে কিছু দিতে পারলে ধন্য হন। আর আপনি সুদূর হল্যান্ডে বসে, আপনার বাসায় খোদ মালেক সাহেবের কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করছেন। এ আপনার পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।’
আসলেও তাই। বন্ধু শফিকুল আলম ঠিক বলেছেন। কেবল চট্টগ্রামে নয়, গোটা বাংলাদেশে অনেক পত্রিকা আছে, দৈনিক সাপ্তাহিক, মাসিক। ঢাকায় আছে বেশ ক‘ডজন তথাকথিত জাতীয় পত্রিকা, যার বেশির ভাগের কাটতি দৈনিক আজাদীর ধারে–কাছেও নেই। হল্যান্ড আসার আগে ঢাকায় আট বছর সক্রিয় সাংবাদিকতা করেছি, বাংলাদেশ টাইমস ও বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে। কিন্তু চোখ বন্ধ করে সেখানে আমি এমন একজনকেও খুঁজে পাইনে যাকে ঢাকাবাসী এম এ মালেককে যে দৃষ্টিতে চট্টগ্রামবাসীরা দেখেন, তেমন দৃষ্টিতে ওনারা কাউকে দেখেন।
অনেকের কাছে হয়তো মনে হতে পারে একটু বাড়িয়ে বলছি। কিন্তু মোটেও তা নয়। অনেকে ব্যক্তি–বন্দনা করেন, সে দেখি প্রায়শ নানা জায়গায়, এমন কী পত্রিকার পাতায়ও। সে তারা করেন তাদের নিজস্ব বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে। কোন কিছুর প্রত্যাশায়, কিছু প্রাপ্তির আশায়, পদের আশায়। আমার সে ধরনের আশা নেই, প্রত্যাশাও নেই। এম এ মালেক বা দৈনিক আজাদীর সাথে আমার কোন আর্থিক লেনদেন নেই। আজাদীর সাথে আমার দীর্ঘ ৩২ বছরের সম্পর্ক। তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে অনেকটা বিরতিহীন লিখে চলেছি এই কলামে। লিখতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। আনন্দ পাই বলে লিখি। পাঠক আছেন বলে লিখি। আমি বিশ্বাস করি, একজন ভালো মানুষকে, এজকন ভালো মানুষের ভালো কাজকে দশজনের কাছে তুলে ধরা লেখক হিসাবে আমার নৈতিক দায়িত্ব। তাতে অন্যেরা জানবে, অনুপ্রাণিত হবে। এই সমস্ত কারণে নিজেকে আজাদী পরিবারের একজন সদস্য ভাবতে ভালো লাগে।
এই এক–সময়কার অনেকটা নিজেকে নিজের মাঝে গুটিয়ে রাখা স্বল্পভাষী ব্যক্তিটি এসেছিলেন হল্যান্ড, স্রেফ বেড়াতে। দেশ থেকে ফোন করে বলেন, ‘লন্ডন যাচ্ছি, আপনি বললে হল্যান্ড আসবো।’ ‘সে তো আমার পরম সৌভাগ্য,’ উত্তরে বলি এবং যোগ করি, ‘আমি না বললেও আমার দরোজা আপনার জন্যে সবসময় খোলা। এনি টাইম, এনি মোমেন্ট।’ তিনি এসেছিলেন তার সহধর্মিনী কামরুন মালেকসহ। কামরুন মালেক, অর্থাৎ ভাবি মালেক ভাইয়ের কেবল স্ত্রী নন, প্রকৃত অর্থে জীবনসঙ্গিনী। যে কদিন আমাদের সাথে ছিলেন দেখেছি সর্বক্ষণ তাকে নানাভাবে সঙ্গ দিতে, গাইড করতে। এমন কী মালেক ভাই যখন কথা বলছেন, যেমন ‘আগামী বছর আমরা আবার ইউরোপ আসব,’ তখন লক্ষ্য করি পাশে বসা ভাবি নিচুস্বরে বলে উঠেন, ‘আলহামদুলিল্লা’। মালেক ভাই সাথে সাথে শুধরে নিয়ে বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’। মালেক ভাই ও ভাবি এর আগেও একবার এসেছিলেন হল্যান্ড। সাথে এসেছিলেন দৈনিক আজাদীর চিফ রিপোর্টার হাসান আকবার। সেবারও তাদের নিয়ে হল্যান্ডের কয়েকটি দর্শনীয় স্থানসহ বেলজিয়ামের ওয়াটারলু, যেখানে নেপোলিয়ান মিত্র শক্তির কাছে যুদ্ধে হেরেছিলেন, দেখতে গিয়েছিলাম।
কিন্তু এবার তাদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘোরার পাশাপাশি হল্যান্ডে ড্রয়িং রুমে হিটারের উত্তাপে নিজেদের শীত থেকে রক্ষা করে আড্ডা দেয়া হয়েছে অনেক। হয়েছে অনেক কৌতুক। মালেক ভাই বলতেও পারেন ভালো, আসর জমাতে ওস্তাদ। চল্লিশ বছর আগে আমার প্রথম দেখা মালেক ভাই আর আজকের যিনি– এ দুয়ে অনেক তফাৎ। ভালো লাগে। যাবার দিন, হোটেলে নামিয়ে বিদায় নিতে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বেশ কিছুক্ষণ। এর আগেও উনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন। কিন্তু এমন করে নয়। কিছুটা ‘ইমোশোনাল’ হয়ে পড়ি, বোধকরি দু’জনেই। বলেন, ‘খুব মিস করবো, বিশেষ করে সুমনাকে।’ এর আগে বার কয়েক ভাবি ও মালেক ভাই দুজনেই বলেন, ‘নেক্সট চাটগাঁ এলে আমাদের বাসায় থাকবেন। আপনাদের নিয়ে দূরে বেড়াতে যাবো।’ পরে শুনেছি শিহাব এবং সাদাফও একই কথা সুমনাকে বলেন।
এম এ মালেককে অনেকে ডাকেন ‘স্যার’। আমার কাছে তিনি মালেক ভাই। আমার ধারণা ‘স্যার‘ সম্বোধনে যাকে ডাকা হয়, আর যিনি ডাকেন– এই দুয়ে একটি অদৃশ্যমান সাঁকো তৈরি হয়। ‘অগ্রপথিক’ বইটি পড়ে আমার এম এ মালেকের আরো অনেক অজানা গুণের আবিষ্কার। বইটি হাতে পাবার জন্যে তার দ্বিতীয় পুত্র, দৈনিক আজাদীর নির্বাহী সম্পাদক, শিহাব মালেকের কাছে ঋণী। এবার একটু ফিরে তাকাই। শিহাব হল্যান্ড আসবেন তার স্ত্রী সাদাফকে নিয়ে। উদ্দেশ্য বেড়ানো। আসার দিন কয়েক আগে দেশ থেকে ওয়াহিদ ভাই (মালেক ভাইয়ের বড় ছেলে, পুরো নাম ওয়াহিদ মালেক) ফোন করে জানালেন, শিহাব যাচ্ছে হল্যান্ড, একটু সাজেস্ট করবেন, হল্যান্ড থেকে ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলিতে কীভাবে যাওয়া যায়। ফোনে শিহাবের সাথে কথা হয়।
ঠিক হলো, ওদের আমস্টারডাম বিমানবন্দরে রিসীভ করবো। ওদের জন্য হোটেল বুক করা হলো। প্রথমে হোটেল ম্যারিয়ট। কিন্তু ঘরের জন সুমনা বলে, ম্যারিয়ট শহরের নিরিবিলি এলাকায়, ওরা (শিহাব ও সাদাফ) বয়সে তরুণ, সেন্ট্রামের দিকে কোন হোটেল হলে ওরা অবসরে একাই ঘুরে বেড়াতে পারবে, ওদের ভালো লাগবে। বুকিং দেয়া হলো আইবিস (ডাচ উচ্চারণে ইবিস) হোটেলে। ম্যারিয়ট বুকিং ক্যানসেল করেছিলাম। কিন্তু দেখা গেল কোথায়ও হয়তো ভুল হয়ে থাকবে। আমার ক্রেডিট কার্ড থেকে একদিনের ভাড়া ১৩৫ ইউরো কেটে রেখেছে। পরে হোটেলের সাথে যোগাযোগ করলে বলে, তোমরা অন লাইনে হয়তো ক্যানসেল করতে গিয়ে কোথায়ও ভুল করে থাকবে, ফেরত দেয়া যাবেনা। যাই হোক– এয়ারপোর্টে অপেক্ষায় শিহাব ও সাদাফের জন্যে। সব যাত্রী এমন কী এমিরেটসের ক্রূরাও বেড়িয়ে পড়েছে। অনুমান করি ইমিগ্রেশন শিহাব আর সাদাফকে আটকিয়েছে। এমন সময় শিহাবের ফোন, বলে, ‘আংকেল আমাদের জেরা করছে ইমিগ্রেশনে।
ওরা যদি কথা বলতে চায়, তাহলে কি আপনাকে দেব?’ অবশ্যই, জানাই উত্তরে। ওদিকে ইতিমধ্যে লন্ডনে এসে পৌঁছা মালেক ভাই ও ভাবি স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন। তাদের ফোন করে আশ্বস্ত করি। ক্ষণিক বাদে এলো অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন। ধরতেই ডাচ ভাষায় বলে, ‘আমি ডাচ ইমিগ্রেশন পুলিশ থেকে বলছি, আপনি কি কেউ আসার আশা করছেন।’ ওপর পাশ থেকে পরবর্তী প্রশ্ন করার আগেই বলি, ‘বাংলাদেশ থেকে আসছেন আমার খুব কাছের দুই অতিথি।’ তারপর ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের জেরা– ওরা কে, কেন হল্যান্ড এসেছে, কি উদ্দেশ্য, তুমি ওদের কী করে চেন, তোমার সাথে কী সম্পর্ক, ওরা কি তোমার ফ্যামিলি মেম্বার, ওরা কি এদেশে থেকে যাবার উদ্দেশ্যে এসেছে, তুমি কী কর ইত্যাদি ইত্যাদি। বলি, ‘দেখ, ওরা খুব ওয়েল–অফ ফ্যামিলি থেকে আসা, তোমরা যদি তাদের এদেশে থাকতেও বলো ওরা থাকবে না। যে এসেছে সে এক বহুল পঠিত দৈনিক পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক।
তার বাবা বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য সাংবাদিক এবং সেই পত্রিকায় আমি নিয়মিত সাপ্তাহিক কলাম লিখি।’ আরো কিছু বলতে চাইলে ডাচ ইমিগ্রেশন পুলিশ সদস্য ‘ওকে ওকে, ঠিক আছে’ বলে ফোন রেখে দিলেন। অনুমান করি পজিটিভ। তারপরও টেনশনে থাকি। এক্সিট গেইট ছিল চার নম্বর। ক্ষণিক বাদে শিহাবের ফোন। বলে, আমরা তিন নম্বর গেইটে। ওদের সেখানেই অপেক্ষা করতে বলে এগিয়ে যাই সেদিকে। দূর থেকে তাদের দেখে চিনতে কষ্ট হলো না। দু’জনেই বারবার ধন্যবাদ জানায়।
বলে, আপনি না থাকলে বড় সমস্যা হতো। জানতে চাইলাম ওরা কী জিজ্ঞেস করেছে, কেন আটকালো। ওদের প্রশ্ন ভিসা স্পেন এম্বেসী থেকে নেয়া, হল্যান্ড কেন নামলে, কত টাকা সাথে, সব ইউরো গুনে দেখলো, দেখলো ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি ইত্যাদি। বয়সে তরুণ সেটিই বোধকরি ওদের দ্বিধায় ফেলেছে। শিহাবের সাথে এই প্রথম দেখা। দেশে গেলে ফি–বার মালেক ভাইয়ের শহরের মধ্যিখানে প্রকৃতি–ঘেরা দৃষ্টিনন্দন বাসায় যাওয়া হয়, খাওয়া হয়। কিন্তু কোনবারই শিহাবের সাথে দেখা হয়নি, দেখা হয়েছে কেবল ওয়াহিদ মালেক ও তাঁর স্ত্রীর সাথে।
(চলবে) লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট