জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২ ডিসেম্বর, ২০২২ at ১০:০৯ পূর্বাহ্ণ

আসরের নামাযের ফযীলত ও মাসায়েল

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!

আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের শ্রেষ্ঠতম ইবাদত নামায যথাযথভাবে আদায় করুন। জেনে রাখুন, নামায আল্লাহকে স্মরণ করার উৎকৃষ্ট মাধ্যম।

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “সফলকাম সেই যে পবিত্রতা অর্জন করেছে, আপন প্রতিপালকের নাম স্মরণ করেছে এবং নামায আদায় করেছে। (সূরা: ৮৭, আলআ’লা, পারা৩০, আয়াত: ১৪১৫)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা মু’মিনদের গুনাবলী ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন, আর যারা নিজেদের নামাযসমূহ পাবন্দির সাথে আদায় করে। (সূরা: ২৩ আল মু’মিনুন, পারা: ১৮, আয়াত: ০৯)

এতে দ্বিধা ও সংশয়ের কোন অবকাশ নেই যে, নামায হচ্ছে হিদায়াত ও তাকওয়া অর্জনের এক শ্রেষ্ঠতম অবলম্বন। আল্লাহর পরিপূর্ণ আনুগত্য ও সন্তুষ্টিলাভ ও উন্নত চরিত্র গঠনে নামাযের প্রভাব অতুলনীয় ও অপরিসীম।

পবিত্র কুরআনে আসরের নামাযের গুরুত্ব: নামায ইসলামের মূলভিত্তি, এর প্রতি অবিশ্বাস ও অস্বীকারকে কুফর হিসেবে গন্য করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের গুরুত্ব প্রসঙ্গে অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, তোমরা সকল নামায এবং বিশেষভাবে মধ্যবর্তী নামায হিফাজত করো আর আল্লাহর সামনে বিনয়াবনত অবস্থায় দাড়াও। (সূরা: , বাক্বারা, পারা, আয়াত: ২৩৮)

হাদীস শরীফে মধ্যবর্তী নামাযের ব্যাখ্যা: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ ও হযরত সামুরাহ ইবনে জুনদাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মধ্যবর্তী নামায হচ্ছে আসরের নামায। (তিরমিযী শরীফ)

আসরের নামায হচ্ছে দিন ও রাতের নামায গুলোর মধ্যবর্তী নামায। আসরের সময় দিন ও রাতের ফিরিস্তাগন একত্রিত হন, এ সময়ে দুনিয়াবী কাজ কর্মের ব্যস্ততা ও শারিরীক ক্লান্তিও বেশী অনুভুত হয়। এ কারণে এ নামাযের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব ও তাকীদ দেয়া হয়েছে। মধ্যবর্তী নামায সম্পর্কে সাহাবাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে কারো মতে এর দ্বারা ফজরের নামায, কারো মতে জোহরের নামায, কোনো কোনো বর্ণনা মতে মাগরীব কিংবা এশার বর্ণনা উল্লেখ করা হলেও এর দ্বারা আসরের নামায বুঝানো হয়েছে মর্মে যে বর্ণনা রয়েছে তা প্রাধান্য পেয়েছে। (মিরআতুল মানাজীহ, ১ম খন্ড, পৃ: ৪৫৪)

ফজর ও আসর নামায আদায়কারী জাহান্নামে প্রবেশ করবেনা: হযরত ওমারাহ ইবনে রুয়াইবাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এরশাদ করতে শুনেছি, ঐ ব্যক্তি কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবেনা যে সূর্য উদিত হওয়া ও অস্ত যাওয়ার পূর্ববর্তী নামায আদায় করবে, অর্থাৎ ফজর ও আসর। (মুসলিম শরীফ)

আসর নামায পরিত্যাগের পরিণাম: আসর নামায পরিত্যাগে দু:সংবাদ রয়েছে, হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত বুরায়দা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আসর নামায পরিত্যাগ করল তার আমল বিনষ্ট হয়ে গেল। (বুখারী শরীফ)

এ হাদীসের মর্ম হলো অর্থাৎ তার কাজের বরকত শূন্য হয়ে যাবে। আর যদি আসর নামায ছেড়ে দেওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে যায় তার সব নেক আমল বাজয়াপ্ত হয়ে যাবে। [মিরআতুল মানাজীহ, ১ম খন্ড, পৃ: ৪৩৩ কৃত: হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (.)]

আসর নামায বর্জনকারীর জন্য নানাবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার অশনি সংকেত রয়েছে, হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যার আসর নামায চলে গেলো তার ঘরবাড়ী ও ধনসম্পদ যেন লুণ্ঠিত হয়ে গেলো। (বুখারী, মুসলিম)

হযরত মাওলা আলী (রা.)’র প্রতি রাসূলুল্লাহর তিনটি উপদেশ: হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হে আলী! তিনটি বিষয়ে বিলম্ব করো না। নামাযের সময় যখন উপস্থিত হয়, জানাযা যখন প্রস্তুত হয়ে যায় এবং কন্যা যখন সমসম্প্রদানের পাত্র পাওয়া যায়। (তিরমিযী)

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে নামাযের ওয়াক্ত আরম্ভ হতেই নামায পড়ে নেয়াটা উত্তম ও আল্লাহর সুন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। কন্যার জন্য উপযূক্ত পাত্র যদি পাওয়া যায় অকারনে বিলম্ব করা অনুচিত। কারণ এতে বিভিন্ন প্রকার ফিৎনা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।

প্রথম ওয়াক্তে নামায আদায়ে রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি: হযরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, প্রথম ওয়াক্তে নামায আদায়ে রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি আর শেষ ওয়াক্তে রয়েছে আল্লাহর ক্ষমা। (তিরমিযী)

আসরের নামাযের রাকা’আত সংখ্যা: আসর নামায আট রাকা’আত। সুন্নাতে গায়রে মুয়াক্কাদাহ চার রাকা’আত, ফরজ চার রাকা’আত, মোট আট রাকাআত।

আসরের নামাযের সময়: যোহরের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার সাথে সাথে আসরের ওয়াক্ত শুরু হয় সূর্যাস্ত পর্যন্ত আসরের সময় বাকী থাকে। (বাহারে শরীয়ত, ৩য় খন্ড, পৃ: ১২৯)

মাসআলা: আসরের নামায বিলম্ব করে পড়া মুস্তহাব তবে এতটুকু বিলম্ব করবেনা যাতে সূর্যের মধ্যে হলদে রং এসে যায়। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলে আসর ও এশার নামায বিলম্ব না করা মুস্তাহাব, অন্যান্য নামাযের ক্ষেত্রে বিলম্ব করা মুস্তাহাব। (বাহারে শরীয়ত, ৩য় খন্ড, পৃ: ১৩১)

মাসআলা: আরাফাতের ময়দানে জোহর ও আসরের নামায জোহরের সময় পড়ে নিবে। মুযদালাফায় মাগরীব ও এশার নামায এশার সময় পড়ে নিবে। (বাহারে শরীয়ত, ৩য় খন্ড, পৃ: ১৩১)

আসরের ওয়াক্ত সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞাতব্য: আসরের সময় কমপক্ষে ১ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট এবং বেশী হলে দুই ঘণ্টা ৬ মিনিট পর্যন্ত হয়ে থাকে। তার ব্যাখ্যা নিম্নরূপ: অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ পৌনে চার মাস ১ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট পর্যন্ত থাকে। বৎসরের মধ্যে এটাই আসরের সবচেয়ে কম সময়। এপ্রিল মে মাসে প্রায় পৌনে দু’ঘণ্টা সময় থাকে, মে মাসের শেষের দিকে এবং জুন মাসে প্রায় দু’ ঘণ্টা সময় থাকে। আবার আগষ্ট সেপ্টেম্বর মাসে পৌনে দু’ঘন্টা সময় থাকে, আর অক্টোবরের শেষের দিকে ১ ঘণ্টা ৩৭ মিনিটের কাছাকাছি সময় থাকে। [বাহারে শরীয়ত, ৩য় খন্ড, পৃ: ১২৯, কৃত: মুফতি আমজাদ আলী (.)]

মাসআলা: আসরের সুন্নাত নামায শুরু করল এমতাবস্থায় জামাআত শুরু হল তখন দু’রাকাআত সুন্নাত পড়ে জামাতে শামিল হবে। বাকী দু’রাকাআত সুন্নাত পূনরায় পড়ার প্রয়োজন নেই। (ফাতওয়াএ রজভীয়্যাহ, মু’মিন কী নামায)

মাসআলা: আসরের নামাযের পর নফল নামায পড়া নিষেধ। (দুররুল মোখতার, আলমগীরি)

আসর নামাযের সুন্নাতে গায়রে মুয়াক্কাদাহ এর প্রত্যেক রাকাআতে সূরা ফাতিহার পর অন্য সূরা পড়তে হবে। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড: , পৃ:১৫)

ফরজ নামাযের পর দুআ মুনাজাত করা শরীয়ত সম্মত: আসর নামাযসহ পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাযের পর দুআ মুনাজাত করা শরীয়ত সম্মত কুরআন সুন্নাহ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আমল দ্বারা প্রমানিত। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে প্রশ্ন করা হয়েছে, কোন সময়ের দুআ আল্লাহ সবচেয়ে বেশি শুনেন? নবীজি এরশাদ করেন, রাতের শেষের দিকের দুআ এবং প্রত্যেক ফরজ নামাযের পর। (তিরমিযী, হাদীস: ৩৪৯৯)

এ ছাড়াও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে সাহাবীগনের জন্য হাত উঠিয়ে দুআ মুনাজাত করার কথা মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে। ফরজ সালাতের পর রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুক্তাদীদের দিকে ফিরে দুআ পাঠ করার বর্ণনা হাদীস দ্বারা প্রমানিত।

আসরের ফরজ সালাতের পূর্বে চার রাকাআত সুন্নতের ফযীলত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আসরের ফরজ সালাতের পূর্বে চার রাকাআত সালাত আদায় করবে আল্লাহ তা’আলা তার উপর রহমত বর্ষন করবেন। (আবু দাউদ, হাদীস: ১২৭১)। আল্লাহ তা’আলা আমাদের অন্তরে নামাযের ভালোবাসা সৃষ্টি করুন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের প্রতি যত্নবান হওার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ আবদুল করিম খোকন

পটিয়া, সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ২০২২ : সকল প্রতিবন্ধিকতা চোখে দেখা যায় না
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রতিষ্ঠা-আন্দোলনের’ একটি অজানা অধ্যায়