আমাদের প্রিয় চট্টগ্রাম সবুজ অরণ্যে ঘেরা, পাহাড়, নদী, সমুদ্রের অপূর্ব মেলবন্ধনে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান। বাণিজ্যিক রাজধানী প্রাচ্যের রানী খ্যাত এই বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অপরূপ সৌন্দর্যে যে কোনো দেশি–বিদেশি পর্যটক অভিভূত হয়ে পড়ে। ব্যস্ত নগরীর যান্ত্রিকতার ভীড়ে ও চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে ছোট ছোট টুকরো সবুজের সমারোহ। যা আমাদের শত ব্যস্ততার মধ্যে ও কিছুটা মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। উল্লেখযোগ্য স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে ডিসি হিল, সিআরবি, ফয়’স লেক। কিন্তু বর্তমান সময়ে অনেকটা অবহেলিত আমাদের প্রিয় সবুজ বিনোদনকেন্দ্রগুলো। আগে ছুটির দিনে এসব বিনোদন কেন্দ্রে শিশু, কিশোর, বয়োবৃদ্ধ সকলে ছুটে যেতেন প্রকৃতির বুকে প্রাণভরে শ্বাস নিতে। দিন দিন এই সুন্দর মনোরম সবুজের মায়াঘেরা স্থানগুলো কেমন যেন সৌন্দর্য হারাতে বসেছে। নানারকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী মানুষের জন্য এই সমস্ত স্থানে পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে যেতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি আমরা। কখন কোন দুর্ঘটনা ঘটে। বর্তমানে এসব স্থানে সুস্থ পরিবেশ বজায় নেই।
একসময় ফয়’স লেক শিশুদের প্রিয় স্থান ছিল। স্কুল ছুটির দিন আসলেই শিশুরা বাবা মায়ের কাছে আবদার করতো ফয়’স লেক যাবো। চিড়িয়াখানা সাথে নানান ধরনের রাইডস এসব দেখে শিশু কিশোররা বেশ আনন্দ পেত। বর্তমানে তেমন লোকসমাগম নেই। পর্যাপ্ত তদারকি না থাকায় অনাদর অবহেলার কারণে আগের সেই মনোলোভা সৌন্দর্য হারিয়েছে ফয়’স লেক। একসময় দেশ বিদেশের পর্যটকদের ভিড় থাকতো ফয়’স লেক বিনোদন কেন্দ্রে। ফয়’স লেক এর আর এক আকর্ষণ কৃত্রিম পানির ফোয়ারা।
বর্তমানে চিড়িয়াখানার অবস্থা বিশেষ ভালো না। রাইডসগুলোর মধ্যেও কয়েকটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। ফয়’স লেকে স্পিডবোট নিয়ে ঘুরলে পাহাড় এবং নানা প্রজাতির পাখি চোখে পড়ে। আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে আমরা আমাদের প্রকৃতির সাথে সাথে নানা ধরনের পাখির সাথে ও পরিচয় করাতে পারি। চিত্ত বিনোদন এর সাথে সবুজ বাংলাকে আমাদের শিশুদের সামনে তুলে ধরার দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাই নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঘেরা ফয়’স লেক এর উন্নয়ন কাজ এবং টিকিটের দাম সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে যেন থাকে সে দিকে কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি দেয়া উচিত।
আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে আমাদের সবুজেঘেরা শ্যামল বাংলাকে তুলে ধরতে হলে এই টুকরো সবুজের যথাযথ যত্ন নেওয়া অতি–আবশ্যক।
নগরীর প্রাণকেন্দ্রে আর এক টুকরো সবুজ ডি সি হিল। একসময় ডি সি হিল ছিল নানা অনুষ্ঠানে উৎসবমুখর। সবুজের বুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার অন্যতম স্থান। শতবর্ষী গাছের সুশীতল বাতাসে প্রাণ জুড়ানো সেই দিনগুলো অনেকটা হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে নানা বিধিনিষেধের কারণে ডি সি হিল আর অবাধ চলাচলের জন্য স্বস্তিদায়ক নেই। কেমন যেন প্রাণহীন হয়ে গেছে ডি সি হিল।
চট্টলার ফুসফুস খ্যাত সি আর বি তে শতবর্ষী গাছের সমারোহ আর পাহাড়ি রাস্তা, অরণ্য ঘেরা মায়াময় একটি স্থান। কিন্তু বর্তমানে শান্ত পরিবেশ অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। পরিবেশের সৌন্দর্য অনেকটা হ্রাস পেয়েছে হকার ও গাড়িওয়ালাদের দৌরাত্ম্যে।
চট্টগ্রাম শহরের এই সুন্দর সবুজ মায়াবী বিনোদন কেন্দ্রগুলো যদি এমন অনাদর অবহেলিত হয় তাহলে আমরা চট্টগ্রামবাসীর কাছে অবাধ বিনোদনের জায়গা কোথায়? বড় অবহেলিত আমরা চট্টগ্রামবাসী। সুস্থ বিনোদনের তেমন সুব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আমরা আগামী প্রজন্মের কাছে এই সবুজ দেশ, মনোরম প্রকৃতির ছবি, আমাদের সংস্কৃতি কিভাবে তুলে ধরব?
আজকের প্রজন্ম ক্রমশ ঝুঁকে পড়ছে নগরীর আনাচে কানাচে গড়ে ওঠা রঙিন নিয়নবাতি আলোয় রাঙানো এসির ঠাণ্ডা হাওয়া সমৃদ্ধ রেস্তোরাঁগুলোর দিকে। অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে নানা ধরনের বিদেশি খাবারের দিকে। আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের ঐতিহ্য।
অভিভাবক ও অসহায় হয়ে শিশু কিশোরদের আবদার মেটাতে এইসব জায়গায় ভিড় করছে। বর্তমান প্রজন্ম দেশীয় সংস্কৃতি বিমুখ হওয়ার পেছনে আমরাও কি কম দায়ী?
ডিসি হিল, সিআরবি, ফয়’স লেক এর মতো স্থানগুলোর পরিকল্পিত উন্নয়ন একান্ত প্রয়োজন। সিআরবি, ডিসি হিলের মতো স্থানে সারা বছর বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। সবুজ বাঁচাতে, সংস্কৃতি রক্ষার্থে এই সুন্দর স্থানগুলোর সংরক্ষণের প্রতি কর্তৃপক্ষের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া উচিত।
আমাদের চট্টগ্রামে সবুজ মায়ার শীতল ছায়ায় পাখির কোলাহলে বেড়ে উঠুক আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম। আমরা যেন বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারি এই সবুজ বিনোদন কেন্দ্রে।
চট্টগ্রামের মানুষের বিনোদনের জায়গা খুবই অপ্রতুল। তাই যেটুকু আছে তার সঠিক পরিচর্যা করা একান্ত কর্তব্য। এটুকু সবুজ বেঁচে থাকুক যথাযথ যত্ন আর ভালোবাসায়। আমরা শত ব্যস্ততার মাঝেও এমন সবুজ মায়ায় বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই।
আসুন এই দেশের সবুজ শ্যামল রূপের ঝলক কিছুটা হলেও যেন আগামী প্রজন্মকে উপহার দিতে পারি এই প্রচেষ্টা করি। বাংলাদেশের রূপ প্রকৃতি নির্ভর। সবুজের মাঝে সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার রয়েছে সকলের। তাই কর্তৃপক্ষের এগিয়ে আসতে হবে যথাযথ পরিচর্যা গঠনমূলক পরিকল্পনা নিয়ে। শিশুদের খেলার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বড়দের সকাল সন্ধ্যা হাঁটাহাঁটির সুব্যবস্থা রাখা জরুরি। এবং ডিসি হিল মুক্ত মঞ্চে কিংবা সিআরবি শিরীষতলায় শুধু বছরান্তে কয়েকটি অনুষ্ঠান পালনে সীমাবদ্ধ না রেখে সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একাধিক অনুষ্ঠানমালা আয়োজন করে এই প্রজন্মকে দেশের সংস্কৃতি ঐতিহ্য তুলে ধরতে হবে। আগামী প্রজন্ম দেশকে জানবে,দেশের সংস্কৃতিকে ধারণ করবে দেশকে ভালোবাসবে। চট্টগ্রাম আমাদের শেকড়, আমাদের অহংকার। এ দেশ আমাদের ভালোবাসার।
লেখক : কবি, গল্পকার