ছোট্ট শিশুটির অসহায় দৃষ্টি আমাকে ঘুমোতে দেয়না, চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার অপলক চাহনি। তার তীব্র আর্তনাদ আমার কানে বাজে, বার বার মনে হয় ছোট্ট আদুরে গলায় সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলছে মা আমাকে বাঁচাও,একটু বেরিয়ে এসে দেখে যাও আমি কোথায়, আমি যে আর পারছি না! আমি তোমার খুব কাছে মা, সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছি তোমার কাছে ছুটে যাওয়ার! সাত বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে মারজানা হক বর্ষা ক্লাস ওয়ানএ পড়ে। একটা চিপস আর চকলেট খেতে চেয়েছিলো, তাইতো মায়ের কাছ থেকে মাত্র ২০ টাকা নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলো। সেই ২০ টাকায় তার শেষ যাত্রা হলো! একসময় বর্ষার বাসার খুব কাছেই আমি থাকতাম। তাকে কখনও দেখেছি কিনা মনে পড়েনা হয়তো দেখেছি, হয়তোবা দেখিনি।
তবে ওর বয়সী ছোট ছোট অনেক মেয়েকে খেলতে দেখেছি আসা যাওয়ার পথে। তাদেরই একজন হয়তো হতভাগা বর্ষা! বহুবার শুনেছি শিশুরা ধর্ষিত হয়, অনুভব করার চেষ্টা করেছি, কষ্টে বুক ফেটে গেছে, ধর্ষককে তীব্র ঘৃনা করেছি, মনে মনে থুতুও ছিটিয়েছি, পেপারেও লিখেছি, শাস্তি দাবি করেছি। কিন্তু চোখের সামনে দিনের পর দিন একজন ধর্ষককে দেখে আসছি, ওই পথে কতবার যে তাকে দেখেছি, সে যে দোকানে কাজ করে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনেছি, তার সাথে কথা বলেছি একবারের জন্য ও বুঝতে পারিনি ভালো মানুষের আড়ালে লুকিয়ে আছে একটা হিংস্র হায়েনা, নরপিশাচ। শুধু আমি না, কারোই কোন ক্ষমতা নেই সেই নরপিশাচ কে চেনার! ওই এলাকার কেউই বিশ্বাস করতে পারছেনা লক্ষণ দাশ নামের একটা গোবেচারা টাইপ দোকানের কর্মচারী এরকম একটা নোংরা, জঘন্য কাজ করতে পারে,এতটা পাষণ্ড, বর্বর হতে পারে! সে অনেকের বাসায় গিয়েও দোকানের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দিয়ে আসতো যার যেটা প্রয়োজন। কে জানতো একজন ঠাণ্ডা মাথার ভবিষ্যত খুনী তাদের সামনে দাঁড়িয়ে! শোনা যায় মেয়েটাকে ডেকে সে প্রায়ই চকলেট, চিপস, এটা ওটা দিতো। তার মানে অনেকদিন ধরেই তার এই কুমতলব, তীব্র লোলুপ দৃষ্টি সুযোগ খুঁজছিলো কিভাবে ছোট্ট মেয়েটাকে শেষ করে দেয়া যায়!
কি সুন্দর নাম মেয়েটির ‘বৃষ্টি’। বৃষ্টির মতো রিমঝিম শব্দ করে ঘুরে বেড়াবে তার আপন ভুবনে, যখন ইচ্ছে হবে নেচে গেয়ে বেড়াবে, আনন্দময় শৈশব আনন্দে পরিপূর্ণ করে তুলবে! হয়তো পরদিনই তার স্কুলে যাওয়ার কথা ছিলো, দেখা হতো বন্ধুদের সাথে পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে গল্প করতো, খেলাধূলা করতো, সেই গল্পে চকলেট, চিপস দেয়ার গল্পও থাকতে পারতো! স্কুল শেষে বাসায় ফিরে আসতো, হাসি, আনন্দ খেলাধূলায় ভরিয়ে রাখতো তার সোনালি শৈশব। হয়তো একদিন উপভোগ করতো তার মেয়েবেলা, তারুণ্যের সুন্দর সময়গুলো! আহারে পারলোনা বর্ষা, হেরে গেলো জীবনের কাছে! আবারও চলবে মিটিং, মিছিল, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি, তারপর থেমে যাবে সবকিছু, হয়তো থেমে যাবে মায়ের চাপা কান্নাও! আবারও শুনবো নতুন কোনো ধর্ষণের খবর, ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যার খবর, পেপারে দেখবো ধর্ষকের চেহারা! জীবন চলবে জীবনের নিয়মে শুধু বর্ষারা আর কোনদিন ফিরে আসেনা….আমার শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে করে বর্ষা তুমি ফিরে এসো একবার বুমেরাং হও যে তোমাকে বাঁচতে দিলো না তার জীবনটা তুমি হাতের মুঠোয় নিয়ে ফিরে যাও তোমার গন্তব্যে…..