উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত সড়ক ও জনপথ নির্মিত একশত সেতু

বরকল, কালার পুলসহ চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৪৬টি

মো. আবু নাছের | সোমবার , ৭ নভেম্বর, ২০২২ at ১০:২০ পূর্বাহ্ণ

এক-দুটি কিংবা দশ-বিশটি সেতু নয়। সংখ্যার হিসেবে একশত সেতু। নানান দৈর্ঘ্যের, নানান প্রস্থের। সেতুগুলো দেশ জুড়ে বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়কে নির্মিত। এসব সেতু সমতল ভূমি, জলাশয়, খাল-বিল, নদ-নদী আর পাহাড়ের মায়ায় ঘেরা এই বদ্বীপ জনপদে তৈরি করেছে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের সেতুবন্ধ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনস্থ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কর্তৃক নবনির্মিত একশত সেতু উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত। এ সকল সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার মধ্য দিয়ে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হতে যাচ্ছে নতুন মাত্রা। সরকারের সাফল্যের মুকুটে যোগ হতে যাচ্ছে আরো একটি হিরন্ময় পালক।

একসময় তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলে অপবাদ সইতে হয়েছে স্বাধীন এ দেশকে। রক্ত মূল্যে অর্জিত দেশকে বিদেশি মিডিয়া বিশ্ব মাঝে পরিচয় করিয়ে ছিল বন্যা-সাইক্লোনে বিধ্বস্ত এক অভাবগ্রস্ত জনপদ হিসেবে। প্যারিসকন সোর্টিয়াম বৈঠকে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীকে তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করতে হতো সাহায্যের প্রতিশ্রুতির জন্য। সে প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে রচিত হত দেশের বাজেট। কিন্তু এ দৃশ্যপট বদলে গেছে। চালচিত্রে এখন পরিবর্তনের হাওয়া। খাদ্য ঘাটতির দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অভাবগ্রস্ত বাংলাদেশ আজ অপারসম্ভাবনার মোহনা। অদম্যগতিতে ছুটে চলা বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে। বিশ্ব অর্থনীতির মানচিত্রে বাংলাদেশ আজ প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির এক নবতর সংস্করণ।

বদলে গেছে দেশের সক্ষমতা। অন্যান্য খাতের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। দেশের স্থল যোগাযোগ অবকাঠামো এখন উন্নয়ন-বান্ধব। ছন্দ ময় গতিময়তা সড়ক-মহাসড়ক জুড়ে। নদ-নদী জনিত বিচ্ছিন্নতা জয় করে একের পর এক গড়ে উঠছে সেতু। প্রত্যন্ত কোনো একটি জনপদ এখন আর বিচ্ছিন্ন নয়। এসেছে সড়ক নেটওয়ার্কের আওতায়। হাওর এলাকা কিংবা পার্বত্য জনপদ; সর্বত্রই আজ সড়ক যোগাযোগের জয়জয়কার। সরকারের গতিশীল এবং পরিকল্পিত নেতৃত্বে যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন উন্নয়নের নিত্য অনুঘটক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে একের পর এক নির্মিত হচ্ছে দুপাশে সার্ভিস লেনসহ চারলেনের মহাসড়ক পর্যায়ক্রমে দেশের সকল জাতীয় মহাসড়ক ছয়লেনে উন্নীত করার এক সাহসী পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অবিরাম কাজ করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। একের পর এক নির্মিত হচ্ছে সেতু। তৈরি হচ্ছে বিচ্ছিন্ন জনপদের মাঝে স্বপ্ন ও সম্ভাবনার সেতুবন্ধ। নিজ অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জানান দিয়েছে তার সাহস এবং অর্থনীতির সক্ষমতা। দেশব্যাপি যাত্রী ও পণ্য পরিবহন উপযোগি সড়ক অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। এ অবকাঠামো আরো গতিশীল এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক করা হচ্ছে। চারলেনের মহাসড়ক থেকে একধাপ এগিয়ে মাওয়া হতে পদ্মাসেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। মহাসড়কে ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম বা আইটি এসব হালনাগাদ প্রযুক্তির ব্যবহার করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চালু হয়েছে রোড সেফটি অডিট। রাজধানী শহরে বসবাসকারিদের স্বস্তি দিতে এ বছরের শেষ নাগাদ চালু হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম এবং নতুন প্রজন্মের মেট্রোরেল। ২০৩০ সালের মধ্যে সময় বদ্ধ পরিকল্পনার আওতায় আসছে মেট্রো রেলের আরও চারটি রুট। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্ণফুলী টানেল।

দেশব্যাপি সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ইতো মধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। এ ধারাবাহিকতায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ কাজ শেষ করেছে একশতটি ছোট-মাঝারি এবং বড় সেতুর কাজ। দেশব্যাপি বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হচ্ছে নতুন নতুন সড়ক এবং সেতু। চলছে এ নির্মাণ ও সৃজনের মহাযজ্ঞ। ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণের যে লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, নানান প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে সে অভিলক্ষ্যে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

ভূপ্রকৃতির দিক দিয়ে বাংলাদেশ এক বৈচিত্র্যময় নিসর্গের আধার। বঙ্গোপসাগরের স্নেহ ধন্য নদী বিধৌত এ পলল ভূমিতে রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য। অসংখ্য নদ-নদী, হাওর, জলাশয় আর দুর্গম পাহাড়ি জনপদকে অভিন্ন ও নিরাপদ সড়ক নেটওয়ার্কের আওতায় আনা চ্যালেঞ্জিং কাজ। আর এ কাজটিই শুরু করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রথমেই মনযোগি হন বিধ্বস্ত সড়ক নেটওয়ার্ক পুন:প্রতিষ্ঠায়। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৭৪ সালের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংস প্রাপ্ত সকল সেতু পুন:নির্মাণের মাধ্যমে বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল করা সম্ভব হয়। ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক-সেতু মেরামতের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রায় ৪৯০ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ করেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় একটি আধুনিক সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার সুদূর প্রসারী পথ দেখিয়ে ছিলেন তিনি। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তাঁর সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ হতে ২০০১ এবং ২০০৯ হতে এ পর্যন্ত দূরদর্শী পরিকল্পনা ও পদক্ষেপে বর্তমানে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ২০০৯ থেকে সরকারের বর্তমান মেয়াদে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কর্তৃক দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক উন্নয়নের পাশাপাশি ১ লক্ষ ১৩ হাজার মিটার সেতু নির্মাণ ও পুন:নির্মাণ করা হয়েছে। কালভার্ট নির্মাণ ও পুন:নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ২১ হাজার ৩শত মিটার। এ সময়ে প্রায় ৭ শত ১৮ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। দুপাশে সার্ভিসলেন সহ চারলেনে উন্নীতকরণ কাজ চলছে আরো প্রায় ৬শত ৭৩ কিলোমিটার মহাসড়কের।

নিরবচ্ছিন্ন, সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও টেকসই সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতায় শত সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে তৈরি হতে যাচ্ছে আরেক ইতিহাস। এই একশটি সেতু বাংলাদেশের ২৫টি জেলায় অবস্থিত যার সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৪শত ৯৪মিটার। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৭টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৬টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৬টি, সিলেট বিভাগে ১৭টি, বরিশাল বিভাগে ১৪টি, রাজশাহী বিভাগে ৭টি এবং রংপুর বিভাগে রয়েছে ৩টি সেতু। এর মাঝে সর্ববৃহৎ রানীগঞ্জ সেতুটি সাতশত মিটার দীর্ঘ। এটি সুনামগঞ্জ জেলার রানীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর উপর নির্মিত। এর ফলে সুনামগঞ্জ ও ঢাকার মধ্যে দুরত্ব কমেছে ৩৮ কিলোমিটার। এ ছাড়াও চট্টগ্রামে কর্ণফুলী থানায় গুরুত্বপূর্ণ বরকল-ওহিদিয়া সেতু এবং চানখালী নদীর উপর নির্মিত কালারপোল সেতু দক্ষিণ চট্টগ্রামের সড়ক যোগাযোগকে করেছে অপারসম্ভাবনাময় এবং সময়সাশ্রয়ী। নবনির্মিত অধিকাংশ সেতুর সাথে নির্মাণ করা হয়েছে সংযোগ সড়ক। সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্বে সাথে নিয়ে স্থাপন করা হয়েছে সাইন, সিগনাল এবং সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক বিভিন্ন নির্দেশনা। সেতুগুলো সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রকৌশলীদের ডিজাইনে এবং সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত। ডিজাইন প্রণয়ন ও নির্মাণকালে ব-দ্বীপ পরিকল্পনার মূলনীতি অনুসরণে নদী বা খালের প্রবাহকে স্বাভাবিক রাখা, পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিবেচনায় আনা হয়েছে। এছাড়া প্রায় ৯ হাজার ১ শত মিটার দৈর্ঘ্যের ১১৮টি সেতু নির্মাণাধীন, যেগুলোর কাজ ২০২৩-২৪ এর মধ্যে শেষ হবে। এছাড়া দুর্গম পাহাড়ি জনপদের যোগাযোগ সহজতর করতে ১১৫টি স্টীল ব্রীজপুন:নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত নবনির্মিত একশতটি সেতু বর্তমান সরকারের অব্যাহত সাফল্যের মুকুটে যোগ করেছে আরেকটি হিরন্ময় পালক। এর ফলে সারা দেশের উপ-আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ হয়ে উঠবে আরও শক্তিশালী। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন দ্রুত, সহজতর ও নিরাপদ হয়ে উঠবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে যাবে দুর্গম এলাকায়। খাদ্যনিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টির ফলে সামষ্টিক অর্থনীতি হবে গতিময়- পি-আইডি ফিচার।

লেখক : উপসচিব, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস
পরবর্তী নিবন্ধমানুষরূপী পশুর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কখন হবে!