একটি সুন্দর ভবনের উপরের দৃশ্য আমরা দেখি, কত না সুন্দর প্রশংসা করি। এই ভবনটি যে ফাউন্ডেশন এর উপর দাঁড়িয়ে সে ফাউন্ডেশন এর কথা আমরা কেউ বলি না। বাঁশখালী গণ্ডামারায় যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে, তা তৈরি হয়ে যাওয়ার পর উপরের দিকটা কেবল দেখবো। একটি পিলার স্থাপন, সাগর থেকে পানি টেনে আনা, আবার সে পানি ব্যবহার করে সাগরে ডেলিভারি দেওয়ার জন্য কর্ণফুলী টানেলের মতো সুরঙ্গ তৈরির কারিগরি দিকগুলো কেবল যারা দেখেছেন তারাই বলতে পারবে গণ্ডামারা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কোন কারিগরি ফাউন্ডেশন এর উপর দাঁড়িয়েছে।
আজ আমরা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দেখছি। মন্ত্রী-এমপি সহ সরকারি বিভিন্ন পদে আমাদেরই নেতারা। এই নেতাদের জন্য যারা আমাদের পথ তৈরি করে গেছেন আমরা কি তাদের ভুলে যাবো? তারা কখনো আমাদের নিকট পদ-পদবী বা কোনো কিছু চাইতে আসবে না। চট্টগ্রাম শহরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক, শহর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ জহুর আহমেদ চৌধুরী মুসলিম লীগের দুর্গ ভেঙে এখানে যাদের নিয়ে আওয়ামী লীগ সংগঠন সংগঠিত করেছেন তাদের স্মরণ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আগামী প্রজন্মের নিকট তাদের সাহসী পথ চলা সাংগঠনিক দক্ষতা, বিচক্ষণতা সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের জন্য জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার মতো ঐতিহাসিক দিকগুলো তুলে ধরা। আমি যাদের দেখেছি জহুর আহমেদ চৌধুরীর সাথে ছায়ার মত থেকে যারা কাজ করেছেন তাদের মধ্যে এম এ মান্নান, ডাক্তার সৈয়দুর রহমান, অ্যাডভোকেট মাজেদুল হক, এন.জি মাহমুদ কামাল, সামশুল আলম চৌধুরী, ইদ্রিস আলম, মৌলভী ছৈয়দ, আব্দুস সোবহান, নূর মোহাম্মদ চৌধুরী, শাহ বদিউল আলম, ক্যাপ্টেন জানে ই আলম, সালে আহমদ, মাঝিরঘাট এর নুরুল ইসলাম, বালির বাপ, আবুল খায়ের চৌধুরী, সিরাজুল হক মিয়া, ছালে জহুর, মো. হারেস, বদুনাথ গুহ, সন্তোষ বাবু, মানিক চৌধুরী, আব্দুর রউফ, আবু তালেব চৌধুরী, হাজী মনির, শফি সওদাগর, নাসির উদ্দিন চৌধুরী, এডভোকেট শামসুল ইসলাম, জাফর এর বাপ, খায়রুল আনোয়ার, মোহাম্মদ আবদুর রহমান, মোঃ আবু তাহের, মাওলানা আব্দুর রহমান, সালেহ আহমেদ (চকবাজার), ছালেহ জহুর।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর একমাত্র দল ছিল মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে সংগঠন দাঁড় করানো কত বড় কঠিন কাজ ছিল তা কল্পনা করা যায় না। বিশেষত চট্টগ্রাম মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর জন্মভূমি হওয়ায় তার প্রভাব প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে জহুর আহমেদ চৌধুরীকে নিয়ে দুঃসাহসিক পথে যারা এগিয়ে যান তাদের মধ্যে বর্তমান চান্দগাঁও থানার অন্তর্গত ঐতিহ্যবাহী গোলাম আলী নাজির বাড়ির সন্তান সামশুল আলম চৌধুরী ছিলেন অন্যতম। ছাত্রজীবন থেকে প্রতিবাদী মানসিকতা ও নেতৃত্ব গুণাবলীর কারণে চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজের এজিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন, তৎকালীন জিএস ছিলেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ইদ্রিস বি.কম। প্রতিবাদী মানসিকতার কারণে ভাষা আন্দোলনের মিছিল থেকে যাত্রা শুরু করে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত একজন পরিপূর্ণ সংগ্রামী মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মরহুম এম.এ মান্নানের বন্ধু ছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জহুর আহমেদ চৌধুরী পাকিস্তান জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠিত ধনকুব রফিক উদ্দিন সিদ্দিকীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেন। জহুর আহমেদ চৌধুরী নির্বাচনের আগে থেকে একজন শ্রমিক নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জহুর আহমেদ চৌধুরী যখন গরুর গাড়ি চালকদের ইউনিয়ন করেন তার সহযোগী ছিলেন সামশুল আলম চৌধুরী মামারা। পাকিস্তানী শাসক দলের ছাত্র সংগঠন ছিল এন.এস.এফ। এন এস এফ এর গুণ্ডা বাহিনীর সাথে সরাসরি মোকাবেলা করে ছাত্রলীগ সংগঠন করার দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের মত সাহসীরা। স্টেশন রোডস্থ রেস্ট হাউসে (বর্তমান মোটেল সৈকত) ছিল জহুর আহমেদ চৌধুরীর শহর আওয়ামী লীগের অফিস। একবার এনএসএফ এর মিছিল থেকে রেস্ট হাউসে হামলা চালালে সামশু মামারা সে হামলা প্রতিহত করেন।
সে হামলায় শহর আওয়ামী লীগের নেতা ইদ্রিস আলম ছুরিকাঘাত হন। কেবল রেস্টহাউসে হামলা নয় জেল-জুলুম অত্যাচার-নির্যাতনের মুখোমুখি হয়ে আমাদেরকে একটা শক্তিশালী সংগঠন আওয়ামীলীগ উপহার দিয়ে গেছেন সামশুল আলম চৌধুরীর মতো নির্লোভ মানুষেরা। নিজে কখনো পদ পদবীর জন্য লালায়িত ছিলেন না। সংগঠন থেকে তাদের কোনো প্রত্যাশা ছিল না। তারা সংগঠনের জন্য কাজ করে আনন্দিত হতেন। জহুর আহমেদ চৌধুরী ও এম এ মান্নান নেতা নির্বাচিত হলে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিরোধী দল থেকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন মহতারমা ফাতেমা জিন্নাহকে মনোনয়ন দিয়েছিল। ফাতেমা জিন্নাহর ভোটের সময় এবং ফাতেমা জিন্নাহকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে স্বাগত জানানোর সমাবেশে এবং নির্বাচনী প্রচারণাকে রুখে দিতে সামশু মামার পরিশ্রমী ভূমিকা সত্যিই প্রশংসনীয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কিছু আদরের মানুষ ছিল যাদের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরাসরি কথা হতো, সংগঠন নিয়ে ব্যক্তিগত মত পোষণ করতেন। যেমন বদন আহমেদ দিদারী, নূর মোহাম্মদ, শাহ বদিউল আলম এবং তাদের মধ্যে সামশুল আলম চৌধুরীও একজন। বঙ্গবন্ধু তাদের নিকট থেকে দলের ও দেশের মানুষের হৃদয়ের কথাগুলো জেনে নিতেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগকে বিভিন্নভাবে জহুর আহমেদ চৌধুরীর পক্ষ থেকে তিনি তদারকি করতেন। তিনি ছিলেন দলের সিদ্ধান্ত এবং জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম এ মান্নানের নির্দেশনা পালনে আপোষহীন। আইয়ুব খান ও ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনের সময় আইয়ুব খানের প্রতীক ছিল গোলাপ ফুল, ফাতেমা জিন্নাহর হ্যারিকেন। চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে আইয়ুব খানের জনসভা পণ্ড ও হট্টগোল সৃষ্টির অন্যতম ছিলেন সামশু মামা সহ কয়েকজন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা ঐ জনসভা থেকে বের হয়ে আসে। নূর মোহাম্মদ ভাই ও শাহ বদিউল আলম এখনো বেঁচে আছেন। তারাই কালের সাক্ষী। আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি মানিক বাবুর সাথে কাজ করেছিলেন তারা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঈদগাহ সামশু মামার বাড়ি ছিল আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সেন্টার। বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শহীদ মৌলভী সৈয়দ, আবু সাঈদ সর্দার, আব্দুর রউফ, মুক্তিযোদ্ধা অমল মিত্র, মোনাফ সহ অনেকের সাথে এই বাড়িতে আমাদের যোগাযোগ হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে সবাই এইখানে একসাথে মিলিত হতেন।
অনেক সিনিয়র নেতারা বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পর নিজেরা রাজনৈতিক যোগাযোগ এড়িয়ে গেলেও সামশু মামাদের দেখেছি সকলের সাথে যোগাযোগ করতে এবং তাদের সাথে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একসাথে ছিল তারা কখনো নীরব থাকে নি। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ যোদ্ধাদেরকে তিনি সব সময় সাহস যুগিয়েছেন। জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দল গঠন করলে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মরহুম ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী জিয়ার দলে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের জিয়ার দলে নিতে তিনি চট্টগ্রামে তৎপর হলে সামশু মামা নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ষড়যন্ত্রে জড়িত না হওয়ার অনুরোধ করেন। তখন সামশু মামার ঈদগাহ বউবাজারের বাসভবন ছিল আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার কেন্দ্রস্থল। দলের গোপনীয় মিটিং হতো এখানে, সেই সময়কার জিয়া সরকারের মামলা ও গ্রেফতার থেকে রেহায় পাওয়ার জন্য সামশু মামার ঐ বাসভবনে অনেক নেতারা রাত্রিযাপন করতেন। সেই সময়ে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার জন্য এইখানে মিলিত হতেন এম এ মান্নান, মৌলভী ছৈয়দ, মহিউদ্দীন চৌধুরী, ইসহাক মিয়া, এস এম ইউসুফ, জালাল কমিশনার, মরহুম খালেকুজ্জামান, এনামুল হক দানু, আবু তালেব চৌধুরী, আবদুর রউফ, মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ, বাঁশখালীর শফি খাইরুল আনোয়ার, বিবিরহাটের সালে জহুর, মুক্তিযোদ্ধা হারেস ভাই সেই কালের সাক্ষী এখনো বেঁচে আছেন মুক্তিযোদ্ধা অমল মিত্র। আমাদের বিরুদ্ধে মামলা হলে বা কেউ গ্রেফতার হলে সামশু মামা এ্যাডভোকেট বদিউল আলম, এ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম এবং এ্যাডভোকেট খান শফিকুল মান্নান সাহেবকে দিয়ে আমাদের মামলার জামিনের ব্যবস্থা করতেন। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধকালে সাবেক এনেসেল বিল্ডিং (বর্তমান ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার ) এর মাঠে জহুর আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হয়। তখন সামশু মামা দামপাড়ার আবদুল মালেককে সেই ট্রেনিং এর সময় ব্যাপক ভূমিকায় দেখেছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণা করলে চট্টগ্রামে প্রথম জনসভা করেন লালদিঘি ময়দানে। সে জনসভা সফল করার জন্য জহুর আহমেদ চৌধুরী ,এম এ আজিজ, এম এ হান্নান, আব্দুল্লাহ আল-হারুন, এম এ মান্নান, এম ওয়াহাবের সাথে সামশু মামারা ব্যাপক ভুমিকা রাখেন যেটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট অনেক প্রসংশনীয় ছিল। বঙ্গবন্ধু লালদিঘির মাঠে ছয় দফার উপর বক্তৃতা করার পর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা ইদ্রিস আলম বলেছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। বঙ্গবন্ধুও বলেন ছয় দফা বাঙালির মুক্তির সনদ। এরপর সমগ্র চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা ঐক্য বদ্ধ হয়ে ছয়দফার পক্ষে জনমত তৈরিতে নেমে যায়। ছয়দফার পক্ষে জনমত দেখে বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা মামলায় ফাঁসি দেওয়ার জন্য আইয়ুব খান বিশেষ ট্রাইবুনাল করলে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করেন এই নেতারা। সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এবং বঙ্গবন্ধু শাহাদাতের পর প্রতিশোধের জন্য এই নেতারা আন্দোলন, সংগ্রাম করেন। আগামী প্রজন্মের নিকট এরা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দুঃসময়ের সামশু মামারা আজীবন বেঁচে থাকবেন ত্যাগিদের হৃদয়ে।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সহ-সভাপতি : জাতীয় শ্রমিক লীগ। উপদেষ্টা : চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ










