করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এর সাথে সাথে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়মগুলো জনসমক্ষে ধীরে ধীরে চলে আসে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে আমাদের স্বাস্থ্য সেবার আসল চিত্রটি ধরা পড়ে। বড় বড় শহরগুলোতে যেখানে মানুষের স্বাস্থ্য সেবা পেতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয় সেখানে উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে চিত্র আরো বেশি শোচনীয়। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে টেলি মেডিসিনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হলেও তা ছিল সীমিত পর্যায়ে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যারা টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছেন তাদেরকে একটি বড় অঙ্কের টাকা ডাক্তারি ফি দিতে হয়েছে। ওষুধের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত ওষুধের অভাবে অনেকে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তবুও মানুষ বেঁচে থাকার লড়াই থেমে থাকেনি। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে যারা ধীরে ধীরে বিজ্ঞানসম্মত জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হতে থাকে তারা কিছুটা সুস্থ ও সুন্দর জীবন যাপন শুরু করে। করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য পরিষ্কার পরিছন্নতা; সামাজিক দূরত্ব ও মাস্ক ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেদেরকে সুরক্ষা রাখার চেষ্টা করে। আধুনিক প্রযুক্তির শীর্ষে অবস্থানরত দেশগুলো ও শিল্প-সংস্কৃতিতে বিশ্বের প্রধান প্রধান দেশগুলো করোনাভাইরাস এর ভয়াবহতায় বিপর্যস্ত হতে থাকে। সেখানে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা বেশি নাজুক। সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব আমাদের মতো দেশগুলোতে এসে পড়ে। যেখানে অর্থনৈতিকভাবে অধিকাংশ মানুষ হয়ে পড়ে দুর্বল সেখানে লকডাউনের কারণও প্রতিটি জীবনকে ব্যাপক প্রভাবিত করে। সকল পর্যায়ে যে অস্থিরতা দেখা যায় তাতে সকলেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায়। তাছাড়া সামাজিক অর্থনৈতিক ও পারিবারিক সমর্থনের অভাবে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত জীবনগুলো দিন দিন বিপন্ন হতে থাকে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেক দিন থেকে বিবিধ নিষেধাজ্ঞা থাকার ফলে স্বাভাবিক জীবন যাত্রা অনেক পিছিয়ে যায়। তাই জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে বিপর্যস্ত মানুষের পক্ষে মানসিক স্বাস্থ্য ও অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করার মত সামর্থ্য ও যোগ্য অধিকাংশ মানুষের নেই।
মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় করোনাভাইরাস আক্রান্ত বিপর্যস্ত পরিবারগুলোর কথা। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের কাছে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনগুলো প্রায় অর্থহীন হয়ে পড়ে। ফলে মানসিক বিকাশ এর পরিবর্তে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসিক ভারসাম্যহীনতাই যেন আরো বেশি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। পরিবারের সেই ছোট্ট শিশুটিও জীবনমুখী চিন্তা ধারা থেকে বঞ্চিত হয় জীবন বিদ্বেষী চিন্তাধারায় এগোতে থাকে। লেখাপড়ার প্রকৃত পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হতে হতে শিক্ষার্থীরা প্রতিটি বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করতে থাকে। অনেক শিক্ষার্থী জীবন ও জীবিকা নিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যায়। যেখানে লেখাপড়ার চিন্তা থাকার কথা ছিল সেখানে তাদেরকে জীবন ও জীবিকার জন্য লড়াই করতে হয়। সেই চিন্তায় অধিকাংশ সময় ব্যয় করতে হয়েছে। আমাদের মেয়ে শিশুদের মধ্যে করোনার প্রভাব আরো বেশি মারাত্মক আকার ধারণ করে। বাল্য বিবাহের মত পরিস্থিতির শিকার মেয়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক গতিধারা ধরে রাখা সম্ভব ছিল না। বেসরকারি পর্যায়ের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষগুলোকে অর্থনৈতিক সাহায্য করার পাশাপাশি মানসিকভাবে সাহস যোগানো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়েছে। কারণ করোনা মহামারির ভয়াবহতার ফলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। যে যেই অবস্থানে আছে সেই অবস্থান থেকে শুরু করার জন্য প্রতিটি মানুষকে মানসিক ভাবে সুস্থ স্বাভাবিক ও অগ্রগামী হতে হবে।
করোনা কালীন সময়ে দেশে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সক্রিয় কার্যক্রম ছিল না। তবে বরাবরের মত দোষারোপের রাজনীতিতে ত্রাণ বিতরণের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। গঠনমূলক কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি চোখে না পড়লেও ত্রাণ নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছিল বেশ লক্ষনীয়। ত্রাণ চোরের খবর নিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলো সরব ছিল। দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ বরাবরের মত ত্রাণ বঞ্চিত হয়। টি. সি. বি এর স্বল্প ও নায্য মূল্য যে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করা হয় সেখানে অনেক অনিয়ম চলে। অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত জীবনগুলো অন্য দিকে সিন্ডিকেটের রাজনীতির গিনিপিগ হয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে। একান্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে জীবন যুদ্ধ আরো বেশি কষ্টকর হয়ে যায়। করোনা কালীন সময়ে প্রায় দুই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে যায়। ৭৫% শিক্ষার্থী নানান মানসিক সমস্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই সমস্যা থেকেই অনেকে আত্নহত্যার পথ বেছে নেয়। মহামারীর ফলে সেশনজট ও পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে হতাশাই শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার কারণ। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানান চাপে অনেক শিক্ষার্থী লেখাপড়ায় অনীহা পোষণ করে। পরিবারের প্রতিটি সদস্য মানসিক ভাবে প্রচণ্ড রকমের চাপে প্রতিটি দিন অতিবাহিত করে। এত কিছুর পর কেউ কেউ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে কৃষি, অন-লাইন, পোশাক শিল্প ও অন্যান্য ঘরোয়া চেষ্টায় নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছে। নানান প্রচেষ্টায় নিজেদের ও দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের চাকা সচল রাখে। এই অবস্থায় আমাদের সচেতনতা ও একাগ্রতাই পারে সবার মানসিক স্বাস্থ্য জোরদার রাখতে। কারণ একমাত্র মানসিক শক্তিই হচ্ছে সকল অগ্রযাত্রার মূলমন্ত্র।
লেখক: প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রি কলেজ।