ইভিএম ভোটাধিকার সুরক্ষার অন্যতম পন্থা

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ৮ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

অতিসম্প্রতি আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রণীত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। আগস্ট মাসে ইসির সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুষ্ঠিত সংলাপে অংশগ্রহণকারী ২৯টি দলের ১৭টি ইভিএমের পক্ষে এবং ১২টি দল বিপক্ষে মত দিয়েছে। বেশির ভাগ দলের মতামত ইভিএমের পক্ষে থাকায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারকে যুক্তিসঙ্গত বলে দাবি নির্বাচন কমিশনের। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা, ইভিএম ও ব্যালট পেপারের ভোটের সুবিধা-অসুবিধাসহ তুলনামূলক পর্যালোচনা, ৯০০টি নির্বাচন অভিজ্ঞতার (ভোটার উপস্থিতি, ব্যয়, সহিংসতা, ভোট-ফলাফল ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি) আলোকে কমিশন ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিভিন্ন মহলের অভিযোগ নির্বাচন কমিশন যে ১৭টি দলকে ইভিএমের পক্ষে বলে প্রচার করেছে, তার মধ্যে ৩টি দল সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে, ১টি দলের কোনো মতামত ছিল না এবং ৯টি দল ইভিএম নিয়ে বিভিন্ন শর্তের কথা উল্লেখ করেছিল। প্রসঙ্গক্রমে কমিশন থেকে তা নাকচ করে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং আলোচনার পর কিছু দলের লিখিত প্রস্তাবও বদলিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুসারে, বিগত একটি জাতীয় নির্বাচনে খরচ হয়েছে এক হাজার ৮৭ কোটি টাকা। কিন্তু ইভিএম ব্যবহারের ফলে ব্যালট পেপার ক্রয়-ছাপা-পরিবহন খরচসহ ভোট গণনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকবলের খরচ সাশ্রয়ে একটি জাতীয় নির্বাচনে খরচ হবে মাত্র নয়শত কোটি টাকা। ইভিএমের অন্যান্য সুবিধার মধ্যে রয়েছে- একটি মেশিনে নতুন করে প্রোগ্রাম প্রবেশের মাধ্যমে চার-পাঁচটি জাতীয় নির্বাচন অথবা ইউনিয়ন পরিষদ-উপজেলা-সিটি কর্পোরেশন বা উপ নির্বাচনও করা সম্ভব, এই প্রক্রিয়ায় কোনো ভোটারের ভোট বাতিল না হয়ে ভোটের তথ্য প্রায় ১০ বছর যাবৎ মেশিনে অবিকৃত অবস্থায় ডাটাবেজ সংরক্ষণ, একজন ভোটার ভোট দেওয়ার পর ব্যালট ইউনিট ১০ থেকে ১২ সেকেন্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে অকার্যকর থাকার ফলে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের ইচ্ছা সত্ত্বেও একজন ভোটারের একাধিক ভোট দানের সুযোগ না থাকা, কেন্দ্র দখলের ঘটনায় সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার কর্তৃক কন্ট্রোল ইউনিটের ক্লোজ সুইচ চাপার ফলে দখলকারীদের কোনো ভোট দিতে না পারা ও স্মার্ট কার্ড সরিয়ে নেওয়ার পর মেশিনটি চালু না হওয়া, ১২ ভোল্টের ব্যাটারি চালিত হওয়ায় ব্যবহারকালে ইলেকট্রিক শক না হওয়া, কাগজ-কলমের ঝামেলা ছাড়া ভোট প্রদান, স্বল্প সময়ে সঠিকভাবে ভোট প্রয়োগ ও দ্রুততার সাথে ভোট গণনার কাজ নিষ্পন্ন করা ইত্যাদি।
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ গণমাধ্যমে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ১২ কোটি ভোটারের আস্থা আছে বলে দাবি করেন। তিনি জানান, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে। যেসব দল ইভিএমের বিরোধিতা করে তারাও অন্তরে বিশ্বাস করে ইভিএম ভালো। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ইভিএমের বিরোধীতাকারীরা অনানুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনে এসে ইভিএমে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেন। উক্ত সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘একটি দল ইভিএমের বিরোধী। কিন্তু তাদের একজন সংসদ সদস্য লিখিতভাবে ইসিকে অনুরোধ করেছেন, তার এলাকায় ইভিএমে ভোট করার জন্য। এর মানে, তিনি অন্তরে বিশ্বাস করেন ইভিএম ভালো।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা ইভিএম নিয়ে নেতিবাচক আর্টিকেল লেখেন, তারা ইভিএম দেখেননি, নির্বাচন কমিশনের কাছে গিয়ে ইভিএম নিয়ে কিছু শুনতেও চাননি, ইভিএমে ভোটও দেননি।’ তিনি উল্লেখ করেন যে ইভিএমে কারচুপি, ব্যালট ছিনতাই, জালভোট দেওয়ার সুযোগ নেই।
নির্বাচন বিশ্লেষক-বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনার ক্ষেত্রে ইভিএম একটি উত্তম মাধ্যম। রাজনৈতিক মহলে ইভিএমের পক্ষে-বিপক্ষে যে আলোচনা সেটি একান্তই রাজনৈতিক। প্রকৃতপক্ষে ইভিএমে ভোট কারচুপি করার কোনো সুযোগ নেই। তবে কোথাও কেন্দ্র দখল বা বুথ দখল হলে সেই দায় ইভিএমের নয়। ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ইভিএমের ব্যবহার দেখা গেছে। উক্ত নির্বাচনে ভোটাররা ইভিএমে আগুলের ছাপ না মেলা, ভোট গ্রহণে ধীর গতি, আগেই বোতাম চেপে ভোট দিয়ে রাখাসহ বিভিন্ন অভিযোগ করলেও একজনের ভোট আর একজন দিয়েছে এমন খবর পাওয়া যায়নি। সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) শাহাদত হোসেন ব্যালট পেপারের চেয়ে ইভিএমে ভোটগ্রহণ আরও নিরাপদ ও স্বচ্ছ পদ্ধতি হিসেবে ব্যক্ত করেছেন। গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একসময় জাল ভোট হতো। কোনো কেন্দ্রে ঝটিকা আঘাত হেনে আধাঘন্টা, এক ঘন্টার জন্য কেন্দ্রটা দখল করে ২০০-৩০০ ব্যালট পেপার বাক্সে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটত। ইভিএম একটি যন্ত্র। উল্লেখ্য অনিয়মগুলো চিহ্নিত করতে ভালো একটা যন্ত্র হচ্ছে ইভিএম। কেউ যদি বলে ডিজিটাল কারচুপি করা সম্ভব, এটা সম্ভব না। যদি না মেশিনের প্রোগ্রামিং চেঞ্জ করতে পারে। সেটা নিশ্চিত সম্ভব না।’
২৫ মে ২০২২ নির্বাচন কমিশনে দেশের বিশিষ্ট তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ইভিএম বিষয়ক মতবিনিময় সভায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এম কায়কোবাদ উভয়েই ইভিএম অত্যন্ত চমৎকার মেশিন এবং এখানে ম্যানিপুলেশন (কারচুপি) করার জায়গা নেই বলে মন্তব্য করেছেন। তবে একটি মেশিনকে কখনোই শতভাগ বিশ্বাস করা উচিত হবে না মর্মেও মতামত প্রদান করেন। অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘ইভিএম বিষয়টি পুরোটা দেখেছি। তার ভেতরে যে টেকনিক্যাল বিষয় আছে সেটাও তাঁদের কাছ থেকে জেনে নিয়েছি। সর্বশেষ তাঁরা আমাদের জন্য একটি মেশিন খুলে রেখেছিলেন, যাতে ভেতরের আইসি লেভেলে দেখতে পারি, কেউ যদি এটি ম্যানিপুলেট করতে চায় কতটুকু কঠিন বা সহজ হবে সে ধারণা পাওয়ার জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে কনভিন্সড হয়েছি। যেহেতু আমাদের বায়োমেট্রিক ডেটা আছে, সেজন্য ভোট দেওয়া অত্যন্ত নিখুঁতভাবে করা সম্ভব, একজন মানুষ অন্যজনের ভোট দেওয়া মোটামুটিভাবে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি আমাদের দেশের জন্য পারফেক্ট একটি মেশিন। অত্যন্ত সহজভাবে এটা চালানো সম্ভব।’
ইভিএম উদ্ভাবন ও কারিগরি কমিটির সদস্য ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম’র মতে, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে উদ্ভাবিত এবং ব্যবহৃত ইভিএম মেশিনটি ২০১৩ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত ইভিএম মেশিন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সম্পূর্ণ নতুন চিন্তা নিয়ে ভিন্ন প্রযুক্তিতে এটি ভিন্নভাবে উদ্ভাবিত। নতুন এই মেশিনটির উদ্ভাবকদের সঙ্গে আগের উদ্ভাবকদের কোনো সংযোগ নেই- নেই আগের ইভিএম মেশিনের কোনো সম্পর্ক। নতুন এই মেশিনে একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারে না এবং ভোটের সময় ছাড়া এর আগে বা পরে কখনই ভোট দেওয়া যায় না। ভোটার আঙুলের ছাপ দিলেই কেবল ইলেকট্রনিক ব্যালট পেপার ভোটদানের জন্য উন্মুক্ত হয়, অন্যথায় নয়। ব্যালট পেপার অন হওয়ার পর ভোটার তার ভোট প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে তা আবারও অকেজো হয়ে যায় এবং অন্য একজন ভোটারের আঙুলের ছাপ না দেওয়া পর্যন্ত আর ভোটদানের জন্য উন্মুক্ত হয় না। একজন ভোটার দ্বিতীয়বার ভোট দিতে চাইলে মেশিন নিজেই তাকে ভর্ৎসনা করে ফিরিয়ে দেয়। মানুষের করা দুর্নীতির সব প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দেয় এই মেশিন, তার নিজস্ব ক্ষমতাবলে। কোনোভাবেই কেন্দ্র দখল করে ভোট দেওয়া যায় না বিধায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা আর রক্তপাতের কোনো সুযোগ থাকে না এই ব্যবস্থায়। শান্ত পরিবেশে নির্ভয়ে ভোট দিতে ইভিএমের কোনো বিকল্প নেই। জনগণের প্রকৃত ভোটাধিকার নিশ্চিত করে যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের পথকে মসৃণ ও প্রশস্ত করতে প্রয়োজন নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার।’
আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক জ্ঞান-যুক্তিনির্ভর সমাজ বিনির্মাণে বিশেষ করে অধিকাংশ তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের মনস্তত্ত্বে সমকালীন তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষতা অনুধাবনে ইভিএমে ভোটদান সর্বাধিক উপযুক্ত ব্যবস্থা। নির্বাচনের ফলাফল দেশীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করার মানসে ইভিএম ব্যবহার এখন সর্বত্রই সমাদৃত। সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ-সফল-সার্থক নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের ইভিএমের পক্ষে-বিপক্ষে এতবেশি বক্তব্য দেওয়া বা শোনার তেমন কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভূত নয়। কমিশনের নিজস্ব মেধা-প্রজ্ঞা-বিচক্ষণতা-দূরদর্শীতার মুখ্য পরিচায়ক হবে সমসাময়িক বিশ্বে নির্বাচন সমূহকে আমলে নিয়ে ইভিএম ব্যবহারে সচেষ্ট থাকা। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে উন্নত মানসিকতা-সচেতনতার সমৃদ্ধি এবং ইভিএম ব্যবহারের সামগ্রিক দিকসমূহ আপামর জনগণের মাঝে সুপরিচিত করার উদ্যোগই হবে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। মোদ্দাকথা এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, ব্যয়ভার কিছুটা অধিক মনে হলেও ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আরেকটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সকল নির্বাচনে ইভিএম মেশিনের ব্যবহার। সময়ক্ষেপণ না করে এখন থেকেই শহর-নগর-প্রান্তিক জনপদে প্রস্তুতি-পরীক্ষামূলক ইভিএম কার্যক্রমে জনগণের সম্পৃক্ততা সকল বিভ্রান্তি নিধন ও দেশবাসীকে বিপুল উৎসাহিত-অনুপ্রাণিত করবে- নিঃসন্দেহে তা দাবি করা মোটেও অযৌক্তিক বা অমূলক নয়।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধসড়কে বাইক আরোহী তিন বন্ধুর মৃত্যু