এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানি শোষকের হাত থেকে ১৬ ডিসম্বর’৭১ বিজয় লাভের পর মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো বাঙালি জাতি দুঃখ কষ্ট বুকে চেপে রেখে একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে দেশ গড়ার কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করে চলেছে নিরলসভাবে। ধাপে ধাপে অনেক চড়াই উৎরাইয়ের পর আজ বাংলাদেশ ’তলাবিহীন ঝুড়ি’ তকমা থেকে বের হয়ে উন্নত দেশের তালিকায় পা ছুঁই ছুঁই। দৈর্ঘ্যে ৬.১৫ কি:মি: স্বপ্নের পদ্মা সেতু সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে সরকারের সদিচ্ছায় নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়ে বাস্তবে রূপ নিয়েছে। মেঘের আড়ালে ঢেকে থাকা দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে পদ্মাসেতু কেন্দ্রিক আলোর ঝলক বিচ্ছুরিত হয়ে উন্নয়নের পদধ্বনিতে বসন্তের হাওয়া বয়ে চলেছে। অনুন্নত একটি এলাকার উন্নয়ন জাতীয় আয়কে সমৃদ্ধ করে স্বাধীনতার সুফল সকল নাগরিকের ঘরে ঘরে পৌঁঁছে দেয়ার জন্য সরকারের প্রচেষ্টার কমতি নেই। এমতাবস্থায় দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি তর্কের খাতিরে বলে বেড়ান, স্বাধীন বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তান আমল ভালো ছিলো। সেক্ষেত্রে তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। কথায় বলে, ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করো’। পাকিস্তানের ভূত স্বাধীন দেশে অনেকের হৃদয়ে যে এখনো মিশে আছে, এটা তারই প্রমাণ।
বিমানে টিকেট কেটে অনেকেই টানেল দেখার জন্য বিদেশ যেতেন ডলার খরচ করে। বাঙালি জাতির কাছে আরেক স্বপ্ন কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ সম্পন্ন হয়ে চালুর অপেক্ষায়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আজ মহাশূন্যে লাল-সবুজ পতাকা উড়াচ্ছে, বিদ্যুত উন্নয়নে সফলতায় ২,০০০ মেঘাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কাজ শেষপ্রান্তে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে বিদ্যুৎ চাহিদা নিশ্চিত করতে সরকারের নানামুখি পরিকল্পনায় উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের মধ্যে রামপাল ও মাতারবাড়ি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়।
সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ কূটনৈতিক তৎপরতায় আন্তর্জাতিক আদালতে আইনি মোকাবেলায় ১ লক্ষ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্রসীমায় আমাদের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে- যা বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয় হিসেবে আখ্যায়িত। উক্ত এলাকায় সমুদ্রের মৎস্য ভাণ্ডারসহ সকল সম্পদ আজ আমাদের নৌবাহিনীর সতর্ক তত্ত্বাবধানে আহরিত হচ্ছে।
ভারতের সাথে স্থল সীমান্ত চিহ্নিতকরণ ও ছিটমহলসমূহ হস্তান্তর চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে সীমান্ত এলাকায় দীর্ঘদিনের বিরাজমান অশান্তি দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে কথিত পাহাড়ি শান্তি বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান এবং পাহাড়ী এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করাও স্বাধীন বাংলাদেশের একটি বিশাল অর্জন।
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতায় প্রথম অর্জন ৪ নভেম্বর ১৯৭২ইং তারিখে শাসনতন্ত্র তথা সংবিধান গণপরিষদে পাশ করে তার ভিত্তিতে দেশের শাসন কার্য পরিচালনা করা। এ জন্যই প্রতি বছর ৪ নভেম্বর বাংলাদেশে সংবিধান দিবস হিসেবে পালিত হয়। দেশ স্বাধীন হবার পর জনসংখ্যা যখন মাত্র ৭/৮ কোটি, তখনও হাজার হাজার টন খাদ্য শস্য জাহাজ বোঝাই করে বিদেশ থেকে আমদানি করা হত। বর্তমান প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ ধীরে ধীরে আজ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ বলা যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রভূত উন্নয়ন- যেমন, গ্রামেগঞ্জে এখন পিচঢালা রাস্তা, প্রায় গ্রামই বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে, মোবাইল নেটওয়ার্ক আওতায় পুরো দেশ, বড় বড় ওভারব্রীজ, ফ্লাইওভার, ব্রীজ-কালভার্ট, নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, বছরের প্রথম দিনই মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের হাতে প্রায় ২০০ কোটি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণ করে দেয়া, শিক্ষাভাতাসহ বিভিন্নভাবে আর্থিক সহায়তা দিয়ে নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি করে উন্নত সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারের জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি অব্যাহত আছে।
বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক দূর, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে দেশ আজ রাইজিং টাইগার হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ এখন অনেকটাই স্বাবলম্বী হওয়ার পথে। ফলত: এশিয়া অঞ্চলের অনেক দেশই আজ বাংলাদেশের দ্রুত উন্নয়নে ঈর্ষান্বিত। কথায় আছে, ‘গাছে বেল পাকিলে তাতে কাকের কী’। সোনার বাংলার সম্পদ লুটে নেয়া মোটাতাজা পাকিস্তান অর্থনৈতিক সূচকে আজ বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে আছে। পাকিস্তানের সুশীল সমাজ তাদের টিভি টক শো বিশ্লেষণে বা সেমিনার সিম্পোজিয়ামে যখন তাদের সরকারের কাছে সুপারিশ করে বলেন, ‘আমাদের পাকিস্তানকে বাংলাদেশ বানিয়ে দাও’ তখন আমরা গর্ব করে বলতেই পারি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। তিনি এদেশের স্বাধীনতা এনেছেন, দিয়েছেন লাল সবুজ পতাকা। স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক সমৃদ্ধ বাঙালি জাতি হিসেবে আজ আমরা পরিচয় দিতে পারছি।
দেশের উন্নয়নে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সকল জনগনই কৃতিত্বের দাবিদার। তদরূপ এর সুফলও ভোগ করবে সবাই, এটাই স্বাভাবিক। যারা দেশের স্বাধীনতা চায়নি, তাদের অনেকেই প্রকাশ্যে না বলেও মিহি মিহি সুরে হলেও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের আর্থিক, সামাজিক অবস্থা বহুগুণে ভালো এটুকু স্বীকার করেই থাকেন। যদিও তাদের পাকিস্তানপ্রীতি এখনো কাটেনি। এমতাবস্থায়, ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন কোনো বিশেষ ব্যক্তি যখন বলেন, ‘বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তান ভালো ছিলো’, তখন বেঈমান মীর জাফরদের চরিত্র আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিলো ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’। যারা এখনো পাকিস্তানপ্রীতি পোষণ করে চলেন তাদের দেশপ্রেম তথা দেশাত্মবোধ কতটুকু আছে তা ভাববার বিষয়। কবির ভাষায় বলতেই পারি:
‘ঘরের শত্রু ঘরেই জন্ম
শুধু স্বার্থের কারণে,
বিনা স্বার্থে সে চলে না
আজ দেখলাম আচরণে।’
যারা দেশবিরোধী আচরণ করবেন, দেশবিরোধী কথা বলবেন, দেশকে অবজ্ঞা করবেন, শত্রু দেশের পুজো করবেন তাদের এক পা শত্রুদেশে সংযুক্ত থাকতেই পারে। যা দেশদ্রোহী কর্মকান্ড পর্যায়ে বিবেচ্য বিষয় বলে মনে করি। এসব ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা সমীচীন হবে নিশ্চয়ই।
২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের ৭৬তম অধিবেশনের ৪০তম প্লানারী সভায় নিয়মানুযায়ী পর পর ২টি ত্রিবার্ষিক পর্যলোচনায় উত্তরণের মানদন্ড পূরণে সক্ষম হওয়ায় বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভে অনুমোদন পায়। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় বলা যায়, ‘বাঙালিদের দাবায়া রাখতে পারবা না’। দেশের সামাজিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকলে চলমান উন্নয়নধারায় উন্নত দেশের তালিকায় অচিরেই অন্তর্ভুক্ত হবে বাংলাদেশ। গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। গর্বিত উন্নত বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করবে আমাদের আগামী প্রজন্ম। আশারাখি, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট হবেন সকল নাগরিক। ব্যক্তি স্বার্থ পরিহার করে সবাই দেশের স্বার্থ প্রাধান্য দিই, হোক কামনা।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বন্দর থানা শাখা; টার্মিনাল অফিসার (পিআরএল), চবক।