ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাসে চট্টগ্রামে বাড়ছে হৃদরোগী

বিশ্ব হার্ট দিবস আজ ।। দেশে প্রতি ১শ জন রোগীর মধ্যে ১২-১৫ জন রোগী হার্টের

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে হৃদরোগের ভয়াবহতা ক্রমে বাড়ছে। উন্নত দেশের তুলনায় দেশে তরুণ ও যুবকরা হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রতি ১শ জন রোগীর মধ্যে ১২ থেকে ১৫ জন হার্টের রোগী। আর দেশে এ রোগের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে রয়েছে চট্টগ্রামের নাম। ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাসের কারণেই চট্টগ্রামে হৃদরোগী বেশি এবং দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার দাশ। সম্প্রতি ইমপেরিয়াল হাসপাতাল উদ্বোধন করতে এসে অনেকটা অভিন্ন ৫ম পৃষ্ঠার ৪র্থ কলাম
তথ্য দিয়েছিলেন বিশ্বের খ্যাতিমান হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও ভারতের নারায়ণা ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিয়াক সায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা ডা. দেবী প্রসাদ শেঠী।
বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ভারত ও বাংলাদেশে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি জানিয়ে ডা. দেবী শেঠী বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের লোকজনের জিনগত বৈশিষ্ট্য প্রায় একই। জিনগত কারণে ভারত-বাংলাদেশের লোকজন হার্ট অ্যাটাকের বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। এখানকার মানুষের জীবনধারা, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাস, নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিস ও ধুমপান প্রি-মেচিউর হার্ট অ্যাটাকের কারণ। এ অঞ্চলের মানুষ ব্যায়াম করেন না আর বেশি বেশি মাংস খেতে পছন্দ করেন। হৃদরোগের কারণ হিসেবে এসবও কম দায়ী নয়। আর ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভাস বলতে লাল মাংসের (রেড মিট) প্রতি চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের বেশি আগ্রহের কথা বলেছেন ডা. প্রবীর কুমার দাশ।
চিকিৎসকরা বলছেন, উন্নত আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রা, অস্বাস্থ্যকর জীবনাভ্যাস, অসচেতনতা-এসব কারণে হৃদরোগ শুধু বড়দের নয়, শিশু-কিশোরদের মাঝেও দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ১৭ ভাগই হৃদরোগের কারণে।
এক তথ্যে দেখা যায়, সারা বিশ্বে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৭৫৩ মিলিয়ন, যা বিশ্বে মহামারী হিসেবে ছড়িয়ে পড়া করোনায় আক্রান্তের তুলনায় বেশি। হৃদরোগের ভয়াবহ মাত্রা কমানোর লক্ষ্যে প্রতি বছর ২৯ সেপ্টেম্বর পালিত হয় বিশ্ব হার্ট দিবস। বিশ্বের ১৯৪টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও আজ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করছে। ২০০০ সাল থেকেই এদেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘ইউজ হার্ট ফর এভরি হার্ট।’
এ উপলক্ষে চট্টগ্রামে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। হৃদরোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে র‌্যালি, সেমিনারের আয়োজন করেছে চমেক হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগ। চমেকের শাহ বীর উত্তম মিলনায়তনে সকাল ৮টায় অনুষ্ঠানমালা শুরু হবে বলে জানিয়েছেন হৃদরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রিজোয়ান রেহান। বিনামূল্যে বেশ কয়টি স্ক্রিনিং ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। অবশ্য বিশ্ব হার্ট দিবস হিসেবে প্রতি বছর পালিত হলেও বাংলাদেশে এখনো এটি জাতীয় দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। গুরুত্বের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব এটিকে জাতীয় দিবস ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে জানিয়ে চমেক হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রিজোয়ান রেহান বলেন, পুরুষরা তো আক্রান্ত হচ্ছেই। সাম্প্রতিক সময়ে নারীরাও উল্লেখযোগ্য হারে হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রাত্যাহিক জীবনযাপনে ছোট ছোট কিছু পরিবর্তন এনে হৃদরোগ প্রতিরোধ সম্ভব বলে জানান চিকিৎসকরা। রোগটি প্রতিরোধে শুধু একটু সচেতনতা জরুরি জানিয়ে ডা. রিজোয়ান বলেন, খাদ্য তালিকায় স্বাস্থ্যকর খাবারের পরিমাণ বাড়ানো, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করা, শারীরিক পরিশ্রম বাড়ানো এবং ধূমপান থেকে বিরত থেকে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটা কমানো যায়।
স্থ্থূলতা, ব্যায়ামের ঘাটতি ও উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগের ঝুঁকির প্রধান কারণ উল্লেখ করে চিকিৎসকরা বলছেন, সচেতন থাকলে এ সংক্রান্ত ঝুঁকি এড়ানো যেতে পারে। হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে কাজে সক্রিয় থাকা, পর্যাপ্ত খনিজসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া, মাছ খাওয়া, বেশি বেশি আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া, দিনে কমপক্ষে পাঁচ দফায় ফল বা সবজি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। একই সাথে দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখা, চর্বি জাতীয় খাবার থেকে দূরে থাকা, ধূমপান থেকে বিরত থাকা, লবণ কম খাওয়া এবং মদ্যপান থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে এই পরামর্শগুলো অবশ্যই মেনে চলতে হবে বলে জানান ডা. প্রবীর কুমার দাশ।
হৃদরোগের অন্যতম কারণ হিসেবে লাল মাংসকে (রেড মিট) দায়ী করে তিনি বলেন, বিভিন্ন সূত্র বলছে, বাংলাদেশের হাসপাতাল এবং পার্শ্ববর্তী ভারতসহ অন্যান্য দেশে হৃদরোগের চিকিৎসা নিতে যাওয়া বাংলাদেশিদের মধ্যে চট্টগ্রামের মানুষ বেশি। এ বিষয়ে দেশে জেলাওয়ারি হৃদরোগে আক্রান্তের সংখ্যাতাত্ত্বিক গবেষণা নেই। তবে মেজবান ও গরুর মাংসের প্রতি চট্টগ্রামের মানুষের বিশেষ আগ্রহের বিচারে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। রাজধানী ঢাকার তুলনায় চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে মানসিক ও পারিপার্শ্বিক চাপ কম থাকলেও হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি। এর অন্যতম কারণ খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় গাফিলতি ও শারীরিক পরিশ্রমের স্বল্পতা। তাছাড়া গরু, খাসিসহ চর্বি জাতীয় খাবারকে আমরা অধিক পছন্দ করে থাকি। যে কোনো অনুষ্ঠানে রেড মিট আমাদের থাকতেই হবে। তাছাড়া ফাস্ট ফুডে আসক্তিও রয়েছে এই অঞ্চলের মানুষের, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ঝুঁকি এড়াতে হলে শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করার পাশাপাশি রেড মিট, ফাস্ট ফুড ও চর্বি জাতীয় খাবার থেকে দূরে থাকতে হবে। রান্নায় সয়াবিন তেলের পরিবর্তে সরিষা তেল ব্যবহারের পরামর্শও দেন তিনি।
তথ্য মতে, বিশ্বে বিভিন্ন অসুখে যে পরিমাণ মানুষ মৃত্যুবরণ করে, তার শতকরা ৩১ শতাংশ মারা যায় হৃদরোগের কারণে। এ কারণে বর্তমান বিশ্বে হৃদরোগকে এক নম্বর ঘাতকব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ১৫ লাখ, শ্বসনতন্ত্রের রোগজনিত মৃত্যুর সংখ্যা ৪০ লাখ, ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর সংখ্যা ৮২ লাখ।
অন্যদিকে হৃদরোগজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বছরে সর্বোচ্চ ১ কোটি ৭৩ লাখ। অর্থাৎ বিশ্বে প্রতি বছর ১ কোটি ৭৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় হৃদরোগে, যার শতকরা ৮০ ভাগই স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশে। তবে ২০৩০ সাল নাগাদ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর এই সংখ্যা বেড়ে ২ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বজন হারানোর দুঃখ নিয়ে বাঙালির মুখে হাসি ফুটিয়েছেন শেখ হাসিনা
পরবর্তী নিবন্ধজয়তু নারী ফুটবলার জয়তু দৈনিক আজাদী