আমার দেশ আমার শহর

এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা | বৃহস্পতিবার , ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

বিজয়ী নারীদের গৌরবে দীপ্ত মুখগুলো

পত্রপত্রিকা, ঘরে বাইরে সাফ গেমসে বিজয়ী ফুটবল চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের বন্দনাগীতিতে সবাই মুখরিত। খোলা বাসে দাঁড়িয়ে বিজয়ী নারীদের গৌরবে দীপ্ত মুখগুলো যেন সূর্যের সোনালি রশ্মির মত ঝক্‌ঝক্‌ করছিল। মহিমায় ভাস্বর বীর নারীদের দেখে আনন্দে চোখে জল আসেনি এমন রমণী এ দেশে কেউ কি আছে? বিজয়ী নারীদের চোখে মুখের যে খুশির ছটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তার পরশে পরিবার ও সমাজের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেঙ্গে এগিয়ে যাবার দুর্দম বাসনা ও সাহস এ যুগের নারীরা উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাদের মনও গুনগুনিয়ে গাইছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান “আমরা নূতন যৌবনেরই দূত।”
সবচেয়ে আনন্দের বিষয় গত বিশ বছর ধরে নারীদের ক্ষমতায়নের সাথে সাথে এ দেশের অনেক নারী খেলাধুলোতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় ইভেন্টে স্বর্ণ ও রূপার পদক এনে দেশকে গৌরবে ভরিয়ে দিচ্ছিল এবং দিচ্ছে। এভারেস্ট বিজয়ী এবং পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া গুলোতে আরোহন করে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও এ দেশের মেয়েরা প্রায়ই পৃথিবীকে চমকে দিচ্ছে আমাদের দেশের যে সব বিজয়ী নারীরা সমগ্র পৃথিবীতে আমাদের জন্য সম্মান ও গৌরব এনে দিচ্ছে তাদের আমরা প্রথম কয়েকদিন খুব ঘটা করে অভিনন্দন জানাই। কিন্তু তারপর? বাস্তবক্ষেত্রে শুধু অভিনন্দনে তো একজন খেলোয়াড়ের শক্তি, সামর্থ্য ধরে রাখা যায় না এবং পরিবারের অনটনও দূর করা সম্ভব হয় না। নারীদের সাফল্য ধরে রাখতে হলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এ দেশে নারীরা যে সাফল্য আজকাল অর্জন করে চলেছে তাতে তারা সমাজ, পরিবার, সরকারি ও বেসরকারি ভাবে কতটুকু সহযোগিতা ও সহমর্মিতা পেয়ে এসেছে?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদারমন, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, অতুলনীয়। তিনি গত কয়েক বছরে সমগ্র দেশের অভাবনীয় উন্নতি ও সমৃদ্ধি ঘটিয়েছেন যা সমস্ত পৃথিবীর জন্য বিস্ময়কর। নারীদের ক্ষমতায়নে তাঁর অবদান চিরদিন নারীরা স্মরণ রাখবে। সংসদে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, আদালত, সরকারি, বেসরকারি কর্মক্ষেত্রের সর্বত্র নারীরা মর্যাদাপূর্ণ পদে অবস্থান করে দেশ ও দশের সেবায় নিবেদিত প্রাণ হয়ে কর্মের মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নতিতে অবদান রাখছেন।
কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করছে কারা? মীর জাফরের বংশধরেরা বংশ বিস্তার করে চলেছে। তাই যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের দুস্থ, অসহায় পরিবারকে বাড়ি, জমি, জায়গা অর্থ দান করেছেন তখন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে তারা। অসহায় পরিবারগুলো প্রায়ই সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছে। ক’দিন আগে পত্রিকায় পড়লাম ২০১৭ সালে সাফ গেমসে অনুর্ধ্ব পনেরো চ্যাম্পিয়নশিপে গোল্ডেন বুট পুরস্কার প্রাপ্ত আঁখি খাতুনকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তিন শতক জমি ভাল জায়গায় প্রদান করেন। কিন্তু আঁখি খাতুন সাফল্যের প্রাপ্য সম্মানটুকু আজও লাভ করে নি। এতোদিন পরে তাকে দেওয়া হয়েছে নিম্নমানের ভূমি যা নিয়ে বর্তমানে ঝামেলা ও বিবাদ চলছে। এরকম উদাহরণ আমরা প্রায় পত্রিকায় পড়ে থাকি। এসব ঘটনার কি প্রতিকার হয়? আমাদের সমাজে এখনো অনেকে জনদরদীর মুখোশ পরে সর্বত্র বিরাজ করছে। যারা সুযোগ পেলেই অসহায় জনগণের সম্পত্তি হজম করতে দ্বিধা করে না। অনেক দিন আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম মফস্বল থেকে আসা স্বর্ণবিজয়ী একজন মেয়ে বলেছিল তাকে ঢাকায় আসা-যাওয়া ও থাকা-খাওয়া বাবদ যা অর্থ দেওয়া হয়েছিল তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই স্বল্প। বাসস্থান ছিল খুবই নিম্নমানের। যদিও সরকারিভাবে ঠিকমত প্রয়োজনীয় অর্থ দেওয়া হয় কিন্তু মাঝপথেই তা লোপাট হয়ে যায়। খেলোয়াড়রা প্রাপ্য সবটুকু অর্থ দূরের কথা এমনকি কোন সহযোগিতা ও সহমর্মিতা অনেকে লাভ করতে সমর্থ হয় না। যারা খেলাধূলার ব্যবস্থাপক তারা যদি আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন তবে হয়তো দূর্নীতি দূর করা সম্ভব। কিন্তু অনেকে বলেন বাংলাদেশে প্রবাদটি আজও চরম সত্য “ঠক বাছতে গাঁ উজাড়”।
মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেশে ও বিদেশে মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে লেখাপড়ায়, খেলাধুলোতে এবং বিভিন্ন কর্মজগতে গৌরব নিয়ে আসছে। তারা হাজার হাজার টাকা খরচ করে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়তে পারে না, লক্ষাধিক টাকার গাড়িতে করে স্কুল- কলেজে যেতে পারে না। হাজার হাজার টাকা খরচ করে জিম-এ গিয়ে শরীরচর্চা ও আধুনিক সুইমিং পুলে সাঁতার শেখার সৌভাগ্য লাভ করতে পারে না। তাদের জন্য আপেল, আঙুর জুস কেউ নিয়ে এগিয়ে আসে না। স্বমহিমায় উজ্জ্বল সাধারণ ঘরের এসব ছেলেমেয়েরা মা-বাবার বকুনি, চড়- থাপ্পড় খায় (লেখাপড়া না করে খেলাধুলো করলে শাস্তি দেয়া হয়)। মুখ লাল করে আধ-পেটা খেয়ে স্বল্প মূল্যের মলিন পোশাক পরে পায়ে হেঁটে রোদে, বৃষ্টিতে ভিজে স্কুল কলেজ পড়তে যায় এবং খেলার মাঠে শৈশব কৈশোর থেকে নিজের প্রচেষ্টায় খেলাধুলো করে। বিশেষ করে কেউ কি কখনো তাদের একটা ফুটবল অথবা একটা ক্রিকেট ব্যাট গিফট করেছে? জন্মদিনে উইশ করে কখনো কি কেউ তাদের খেলাধুলোর উপযোগী জুতা-মোজা উপহার দিয়েছে? এখন তারা সাফল্য অর্জন করেছে। তাদের যদি পুরস্কার হিসাবে অর্থ বাড়ি বা থাকার জন্য ভূমি সরকারের তরফ থেকে দেওয়া হয় তা দিতে কি এক শ্রেণির হিংসুটে ব্যক্তির গড়িমসি করা উচিৎ? পত্রিকায় পড়লাম পুরুষ খেলোয়াড়দের তুলনায় নারী খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক কম দেওয়া হয়। এখানেও বৈষম্য! পুরুষরা কোন কালে উদার ছিল না এযুগেও বেশির ভাগ পুরুষ নারীদের প্রতি অবিচার করতে পারলে মনে মনে তৃপ্তি অনুভব করে। শুধু এ দেশে না এ কথা সারা পৃথিবীতেই আজও প্রমাণিত হয়েছে।
নারীরা চিরদিনই স্বচেষ্টায় তাদের ভাগ্য বদলাবার চেষ্টা করে এসেছে। আগেকার যুগে এদেশে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বেগম রোকেয়া, নজরুল শরৎচন্দ্র প্রমুখ কিছু মহান ব্যক্তি উদার হৃদয়ে লেখালেখি ও কর্মের মাধ্যমে নারীকল্যাণে সহায়তা করেছিলেন। তার ফলে নারীদের চলার পথ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সে পথে ছিল অনেক কাঁটা। সমাজ ও পরিবার থেকে সে কাঁটা গেঁথে রাখা হয়েছিল। নারীদের চরণ রক্তাক্ত হয়েছে তবু অদম্য নারীরা পথ চলায় ক্ষান্ত দেন নি। বরং সব বাধা তুচ্ছ করে এগিয়ে গিয়েছেন এবং আজও এগিয়ে যাচ্ছেন।
তবে এখনো পরিবার ও সমাজ নারীদের মূল্য দিতে পারবে কি? লাখ লাখ টাকা দেওয়া হবে না আরও বেশি দেওয়া হবে এসব প্রশ্ন অনেকের মুখে। কেউ বলছেন শুধু তিনজনকে কি অর্থ দেওয়া হবে? কি আশ্চর্য। প্রতিভার স্বীকৃতি অর্থ দিয়ে মূল্যায়ন করা কি যুক্তি ও রুচিসম্মত? তবে সাফল্যের যথাযোগ্য স্বীকৃতি দেয়া সম্মানজনক। সেটা বিবেচনা করা প্রয়োজন। সত্যিই তো শুধু অভিনন্দনে পেট ভরে না। এটা সবাই বোঝেন। কিন্তু অনেকে বোঝে না কারণ, “এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি।” অথচ কত দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা অরুচিকর কথাবার্তা নারী খেলোয়াড়দের মনকে প্রায় সময় পীড়িত করে তুলেছিল। তবু সব অগ্রাহ্য করে এদেশের সাধারণ পরিবারের অসাধারণ সোনার টুকরো নারীরা দেশের সাফল্য বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন। তা উপলব্ধি করে ভবিষ্যতে নারীদের চলার পথকে মসৃণ ও মোলায়েম করে সৃষ্টি করা যায় না? শুধু ফুল দিয়ে তো পথ মসৃণ হয় না। সেজন্য ইট-সুরকি-পীচেরও প্রয়োজন রয়েছে।
অনেকে বলেন নারীদের চলার পথের কাঁটা অনেক নারীর দ্বারা সৃষ্টি। মায়েরা সন্তানকে খুব ভালবাসেন। কিন্তু পরিবার ও সমাজের ভয়ে অনেক মা কন্যা সন্তানকে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সহযোগিতা করতে পারেন না। এক্ষেত্রে পিতা যদি সহায়তা করেন তবে মা সাহস পাবেন। কন্যা সন্তানকে সহানুভূতির সাথে সহযোগিতা করলে এবং কন্যা সন্তানও কখনো হীনমন্যতায় কষ্ট পাবে না। বাংলাদেশের বেশির ভাগ শাশুড়িদের কথা কি বলবো। তাদের লোভের জিহ্বা তো বারো হাত দীর্ঘ। যৌতুকের বিশাল লিসট শ্বশুর ও শাশুড়ির হাতে থাকে। এ কারণে কন্যা সন্তানের যত্ন অধিকাংশ পরিবারে হয় না। আজও যৌতুক বন্ধ হলো না। হবে কি করে, ধনী ও শিক্ষিত শ্বশুর ও শাশুড়ি তো যৌতুক নেবার জন্য উম্মাদ।
যা হোক আনন্দিত মনে লেখা শুরু করেছিলাম। বিমর্ষ অন্তরে লেখা শেষ করতে চাই না। এ যুগের নারীরা যেন আরো সাফল্য বয়ে আনেন তাই আমাদের সবার কাম্য। তাঁদের মনে রাখতে হবে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের চরণ, “আমরা বেড়া ভাঙি। আমরা অশোকবনের রাঙা নেশায় রাঙি ঝঞ্চার বন্ধন ছিন্ন করে দিই আমরা বিদ্যুৎ। যেখানে ডাক পড়ে জীবন-মরণ-ঝড়ে আমরা প্রস্তুত”।
লেখক : কবি ও সাহিত্যিক; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, মহিলা কলেজ চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসক্রিয় হোক আমাদের ক্রীড়াঙ্গন
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম