টিএসপি সার ভেজালে চক্র

পরিবহনকালে মেশানো হচ্ছে সস্তা জিপসাম বা আমদানি করা নিম্নমানের টিএসপি ।। বগুড়ায় পাঠানো ২৩৮ টনের খালাস বন্ধ, তদন্ত কমিটি ।। এক ঠিকাদার কালো তালিকাভুক্ত, জামানত জব্দ

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ৩১ আগস্ট, ২০২২ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

টিএসপি সার পরিবহনকালে সস্তা জিমপাম বা চীন থেকে আনা নিম্নমানের টিএসপি মেশানো হচ্ছে। এভাবে একটি চক্র অবৈধভাবে লাভ করছে কোটি কোটি টাকা। ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ এই সার ভেজাল করায় কৃষি খাতে সংকট তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ১শ কোটি টাকা দামের টিএসপি সার পরিবহনকালে পথে পাল্টে নিম্নমানের সার বাফার গুদামে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এই ধরনের ঘটনায় একজন পরিবহন ঠিকাদারকে তালিকাভুক্ত করে আড়াই কোটি টাকার বেশি জামানত জব্দ করা হয়েছে। গত সোমবার অপর একজন ঠিকাদারের চালান খালাসও আটকে দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে বগুড়ায় নেয়া ২৩৮ টন টিএসপি খালাস বন্ধ করে পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি।
সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে রাসায়নিক সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৬ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ইউরিয়া ২৬ লাখ টন, টিএসপি ৭ লাখ টন, ডিএপি ১৬ লাখ ৫০ হাজার টন ও এমওপি ৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর এই চাহিদা ছিল ইউরিয়া ২৫ লাখ ৫০ হাজার টন, টিএসপি ৫ লাখ টন, ডিএপি ১৫ লাখ টন ও এমওপি ৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন।
দেশের একমাত্র ফসফেটিক সার কারখানা টিএসপি কমপ্লেক্সে বছরে ১ লাখ টনের মতো সার উৎপাদন করা হয়। বর্তমানে টিএসপি সার নিয়ে নানা জালিয়াতি চলছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
জানা যায়, চট্টগ্রামের পতেঙ্গার টিএসপি কমপ্লেক্স থেকে ৪৩ হাজার ৭৫০ টন সার দেশের ২৫টি বাফার গুদামে পৌঁছে দেয়ার জন্য ৫ জন পরিবহন ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। এর মধ্যে এম এইচ আর কর্পোরেশন ২১ হাজার ৬২৫ টন, মেসার্স সৈয়দ এন্টারপ্রাইজ ৯ হাজার টন, আলীয়া এন্টারপ্রাইজ ৩৭৫০ টন, মেসার্স সালাউজ্জামান ৩ হাজার টন এবং মেসার্স ব্রাদার্স কর্পোরেশনকে ৬ হাজার ৩৭৫ টন সার পরিবহনের দায়িত্ব দেয়া হয়। ঠিকাদাররা টিএসপি কমপ্লেক্সের গুদাম থেকে সার বোঝাই করে বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবহন করছেন। এর মধ্যে এমএইচআর ১১টি গুদামে, মেসার্স সৈয়দ এন্টারপ্রাইজ ২টি গুদামে, মেসার্স আলীয়া এন্টারপ্রাইজ ১টি গুদামে, মেসার্স সালাউজ্জামান ১টি গুদামে ও মেসার্স ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজের ২টি গুদামে সার পৌঁছে দেয়ার কথা। কিন্তু পরিবহনকালে মূল্যবান টিএসপি সার সরিয়ে তাতে সস্তা জিপসাম মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো বস্তায় নিম্নমানের আমদানিকৃত টিএসপি মিশানো হচ্ছে। টিএসপির নামে সারের সাথে মাটি মিশিয়ে বাফার গুদামে পাঠানোর অভিযোগও করা হয়েছে। এই ধরনের ঘটনা ধরা পড়ার পর ৯ হাজার টন সার পরিবহনের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিবহন ঠিকাদার সৈয়দ এম কে এন্টারপ্রাইজকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বলে টিএসপি কমপ্লেক্স সূত্র জানিয়েছে।
ওই ঘটনার সুরাহা হওয়ার আগেই অপর পরিবহন ঠিকাদার এম এইচ আর কর্পোরেশনের পরিবহন করা ট্রাকবোঝাই টিএসপিতে ভেজাল করার অভিযোগ করা হয়েছে। এই অভিযোগে চট্টগ্রাম থেকে বগুড়ায় পাঠানো ১৭ ট্রাক টিএসপির খালাস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের টিএসপি কমপ্লেক্স ২৩৮ টন সার পাঠানো হয় বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থার (বিসিআইসি) বগুড়ার বাফার গুদামে। কিন্তু সোমবার এই সার গ্রহণকালে ভেজাল ধরা পড়ায় কর্তৃপক্ষ সারের চালানটি গ্রহণ করছে না। বাফার গুদামের কর্মকর্তাদের দাবি, চট্টগ্রাম থেকে বগুড়ায় নেয়ার পথে ট্রাকের বস্তা পরিবর্তন করে ভেজাল সার দেওয়া হয়েছে।
গতকাল এই সারের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য রাজশাহীর মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া যাবে বলে জানিয়ে সূত্র বলেছে, রিপোর্ট পাওয়ার পরই সারগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এদিকে ঘটনাটি তদন্তে টিএসপি কমপ্লেক্সের পক্ষ থেকে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হচ্ছেন টিএসপি কমপ্লেক্সের উপ-প্রধান রসায়নবিদ রেজাউল হক, ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মাজহারুল ইসলাম ও সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আউয়াল হোসেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ৫০ কেজির প্রতি বস্তা টিএসপির দাম ডিলার মূল্য ১১শ টাকা। এই সার সুযোগ বুঝে ডিলাররা যেমন চড়া দামে বিক্রি করেন, তেমনি ডিলারদের কাছ থেকে নিয়ে খোলা বাজারে আরো বাড়তি দামে বিক্রি করা হয়। কৃষিতে টিএসপির উপযোগিতা ও চড়া দামের সুযোগ নিয়ে সংঘবদ্ধ একটি চক্র নানাভাবে এই সার নিয়ে কারসাজি করে। এর মধ্যে দেশীয় উন্নতমানের টিএসপির সাথে চীন থেকে আনা নিম্নমানের টিএসপি মিশিয়ে বিক্রি করা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি মেশানো হয় জিপসাম।
এক বস্তায় ৫০ কেজি টিএসপি থাকে। এর মধ্যে ৩০ কেজি সার বের করে নিয়ে জিমশাম মেশানো হয়। জিপসাম মিশিয়ে লাখ লাখ টাকার আর্থিক প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। কৃষি জমিতে টিএসপি সার দিলেও জিপসাম দেয়ার ফলে সারের কোনো কাজ হবে না। আর সময়মতো টিএসপি না পাওয়ায় ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এ ব্যাপারে টিএসপি কমপ্লেঙের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান বলেন, কিছু ঘটনা ঘটছে, যেগুলো আমরা সতর্কতার সাথে দেখছি। তিনি বলেন, বগুড়ায় সারের ব্যাপারে সন্দেহ হওয়ার সাথে সাথে আমরা টিম পাঠিয়েছি। টিম এখনো সেখানে রয়েছে। সারের নমুনা নেয়া হয়েছে। পরীক্ষা করে ভেজালের ব্যাপারটি নিশ্চিত হলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এর আগে সৈয়দ এন্টারপ্রাইজকে এই ধরনের ঘটনায় কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাদের ২ কোটি ৬৫ লাখ টাকার মতো সিকিউরিটি মানি জমা ছিল। তা জব্দ করা হয়েছে। এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে টিএসপি কমপ্লেক্স কঠোর অবস্থান নেয় বলে জানান তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমিথ্যা অভিযোগ দিয়ে লাভ নেই : প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনী ভারতের গৌতম আদানি