বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একসূত্রে গাঁথা

দিলরুবা আক্তার চৌধুরী | শনিবার , ২০ আগস্ট, ২০২২ at ৭:২৭ পূর্বাহ্ণ

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে সোহরাওয়ার্দীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বঙ্গবন্ধু কলকাতায় যান এবং ১৯ বছর বয়সে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন পুরো মাত্রায়। বঙ্গবন্ধু অসামপ্রদায়িক রাজনীতির ধারক ছিলেন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ ও আওয়ামী মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে মুসলিম শব্দটা বাদ দিতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র রচনার সময় ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে গণপরিষদে তিনি পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণার বিরোধীতা করেন। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর জোর দেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের নাম পূর্ব বাংলা রাখার দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক দূরদর্শী নেতা ছিলেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ১৩ দিনের পাক-ভারত যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলাকে অরক্ষিত রেখে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েই ব্যস্ত ছিল তাই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উপর আস্থা হারিয়ে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয়দফা কর্মসূচি ঘোষণা দেন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ছয়দফা ও ছাত্রদের এগারো দফা দাবিতে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুললে গণ অভ্যুত্থানের রূপ নেয় ও আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ১৯৭০ এর নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরও আওয়ামী লীগের হাতে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তরের অস্বীকৃতি জানায় ইয়াহিয়া খান। ফলে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হয়। ১৯৭১ এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে দশ লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য বাঙালি জাতির করণীয় নির্দেশ করেছেন। মূলত এ ভাষণই বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পরিচালনা করতে প্রেরণা যোগায়।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতো জনগণ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাঙালি বিজয় লাভ করে। অর্জন করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ দেশে ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে পুনর্গঠন ও পুনঃস্থাপনের ব্যবস্থা করলেন। এক বছরের মধ্যে একটা গণতান্ত্রিক সংবিধান উপহার দিলেন। ১৬ মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন করলেন, সোয়া দুই বছরের মধ্যে ১২১ টি দেশের স্বীকৃতি আদায় করেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগদান এবং ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রয়ারি পাকিস্তান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়। ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্যপদ লাভ, জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ এবং ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯ তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বাংলায় ভাষণ দেন। তিনি বলেন, বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত শোষক ও শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ বিশ্ব ব্যবস্থার আর সোনার বাংলা গড়ার।
বঙ্গবন্ধুর মতো দূরদর্শী, দেশপ্রেমিক, নির্ভীক আদর্শবান নেতার জন্ম এদেশে আর হবে কিনা জানি না। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন, আমি দুইবার মরতে মরতে বেঁচে গেছি। প্রথমবার আইয়ুব খানের বন্দীশালায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়। আমার এক সাথী আমাকে সতর্ক করে দেয় সন্ধ্যাবেলায় সেলের বাহিরে নিয়মিত ঘোরাঘুরি বিপজ্জনক। পেছন থেকে গুলি করবে আর বলবে পালিয়ে যাচ্ছিলো বলে গুলি করেছি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে এভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। দ্বিতীয়বার ইয়াহিয়া খানের কারাগারে বন্দী অবস্থায় আমাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর পরিকল্পনা করেছিল, আমার সামনেই কবর খোঁড়া হচ্ছে। বুঝতে পারছি যে আমার সময় ঘনিয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধু তারপরও কোনো আপস করেননি, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না, ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে আমি বলে যাবো আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ, আমাকে ফাঁসি দাও দুঃখ নাই, শুধু আমার লাশটা বাংলার মাটিতে পৌঁছে দিও’। তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার জন্য সকল আয়োজন সম্পন্ন করেও পাকিস্তানীরা মৃত্যুদণ্ড দিতে পারেনি। সেই মৃত্যুদণ্ড সেদিন কার্যকর হয়নি হয়েছে আরও চারবছর পর ১৯৭৫ এর পনেরই আগস্ট। তাঁর প্রাণ কেড়ে নেবে বাঙালিরা এটা বঙ্গবন্ধু কোনোদিন ভাবতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ তিনি দেশের মানুষকে বেশি ভালোবাসেন। তিনি বলেছেন, ‘সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারবো না’। তাঁর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা তিনি দেশের মানুষকে একটু বেশিই ভালোবাসেন। সেই ভালোবাসা আর বিশ্বাসই তাঁর মৃত্যুর কারণ হলো। দেশের মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অবিচলিত আস্থার সুযোগ নিয়ে দেশদ্রোহী ঘাতকরা তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে তাঁর পরিবারের উপস্থিত সদস্যসহ। রেহাই পায়নি নিঃষ্পাপ শিকু শেখ রাসেল ও সুকান্ত বাবু। শুধু তাঁর হত্যাকাণ্ড নয় যেভাবে তাঁকে দাফন করা হয়েছে তা জাতির জন্য কলঙ্কজনক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে পেছনে ফেরানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ঘাতকরা জানতো বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তাই মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র ও বেসরকারি গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা হতো না। সেদিন যারা তাঁকে নিষিদ্ধ করেছেন তারাই আজ ঘৃণিত হয়ে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। আজ সময়ের দাবি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত বাকী খুনীদের ফাঁসি দিয়ে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা।

লেখক : উপাধ্যক্ষ, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅপরাজেয় মুজিব
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে