হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২০ আগস্ট, ২০২২ at ৭:২৮ পূর্বাহ্ণ

মার্কিনিদের জন্যে আমার ‘করুণা’ হয়। করুণা এই কারণে আমেরিকার জনগণ বিশেষ করে রিপাবলিকান পার্টির গোটা নেতৃত্ব ও তাদের রাজনৈতিক ভবিষৎ আটকে আছে এমন এক ব্যক্তির মর্জি, খেয়াল-খুশির উপর যিনি কোন অর্থেই রাজনীতিবিদ নন, রাজনীতির কোন সংজ্ঞা, জ্ঞান ও ধারণা যার নেই। বুঝতেই পারছেন আমি যুক্তরাষ্ট্রের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা বলছি। ক্ষমতা থেকে তিনি বিদায় নিয়েছেন বছর দুয়েকের বেশি সময় আগে, মূলতঃ বিদায় নিতে হতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু বিগত নির্বাচনে হেরে যাবার পর থেকে তার আচরণ, কার্যকলাপ দেখে মনে হয় তিনি এখনো নিজেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মনে করেন। তিনি তা প্রকাশ্যে দাবিও করেন। তিনি এখনো মেনে নিতে পারেননি জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে। গণতন্ত্রের ধারক-বাহক দাবিদার এই দেশটিতে গণতন্ত্রকে কী নির্লজ্জভাবে হত্যা করা হচ্ছে, গণতন্ত্র কীভাবে এই ব্যক্তির কাছে জিম্মি হয়ে আছে তা গোটা বিশ্ব অবাক তাকিয়ে দেখলো ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি, যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের উস্কে দেয়া উগ্র-সমর্থকরা ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিল আক্রমন করে বসলো, ধংসযজ্ঞ চালালো সেখানে, হত্যা করলো কয়েক নিরাপত্তা কর্মীকে যারা গণতন্ত্রের সুতিকাগার ও আইনপ্রণেতাদের রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। তারপরও ট্রাম্প এবং পরবর্তীতে তার দলের নেতারা এই হিংসাত্মক আক্রমণকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে লাগলেন। দলের নেতারা অনেকের ভাষায় একটি উম্মাদ-প্রায় ব্যক্তি, যার চিন্তা-ভাবনা একটি স্কুলগামী-শিশুর পর্যায়ে তাকে অন্ধের মত অনুসরণ করতে লাগলেন। তারা গণতন্ত্রকে ফেললেন হুমকির মুখে। তারা গোটা দেশকে নিয়ে চলেছেন এক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে। যার প্রভাব কেবল আমেরিকাতে নয়, প্রভাব পড়বে গোটা বিশ্বেও। সেখানেই অনেকের মত আমারও শংকা।
এতো গেলো মার্কিন জনগণের একটি বৃহৎ গোষ্ঠীর কথা যারা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘খোদা’ মনে করে তিনি যা যা বলেন তা ‘গোসপেল ট্রুথ’ মনে করে তার সমস্ত নির্দেশনা মেনে চলেন। কিন্তু যারা সে-দেশে রাজনীতি করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে তারা কেন এমন অন্ধ হয়ে এই উম্মাদ-প্রায় ব্যক্তিটি যা বলেন, তা যত অরাজনৈতিক বা অন্যায় বক্তব্য হোক না কেন, সব জেনে শুনে মাথানত করে তা মেনে নেবেন। তারা কেন ‘জি হুজুর, জি হুজুর’ করে তার কথায় উঠবস করবেন? তারা কেন আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতিবিদদের মত ‘স্পাইনলেস’ হবেন। তাদের ভয় কিসের? তাদের অবস্থা তো আর আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মত নয় যে, রাজনীতিতে না থাকলে তারা ভাতে মরবেন। তারা শিক্ষিত, লেখাপড়া জানেন। তারপরও। আসলে তাদের ভয়, ক্ষমতা। ক্ষমতার কী মোহ। এই ক্ষেত্রে তাদের সাথে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের বেশ মিল লক্ষ্যণীয়। তাদের ভয় ক্ষমতা হারানোর ভয়। আর এই ক্ষমতা হারানোর ভয়ে রিপাবলিকান পার্টির নির্বাচিত সিনেটররা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরাগভাজন হতে চাননা। তারা জানেন এবং বিশ্বাস করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের একমাত্র ‘ট্রাম্প-কার্ড’ যা দিয়ে তারা ২০২৪ সালের নির্বাচনে বৈতরণী পার হতে পারবেন। আর সে কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলের ‘রায়ট’ উস্কে দেয়ার কারণে যে বিচার হলো তাতে প্রচুর প্রমাণাদি উপস্থিত করা সত্ত্বেও রিপাবলিকান দলীয় সাংসদরা তার পক্ষ অবলম্বন করে ভোটাভুটিতে তাকে নির্দোষ প্রমাণিত করলেন। সিনেটর লিজ চেইনিসহ হাতে গোনা যে ক’জন রিপাবলিকান সদস্য ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করে ভোট দিলেন, তাদের কেবল রাজনৈতিক জীবন নয়, তাদের প্রাত্যহিক জীবন দুর্বিষহ করে তুললেন ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের বিরুদ্ধে তার সমর্থকদের উস্কে দিয়ে। তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে নিজদলে একঘরে করলেন। তাদের কেউ কেউ জীবনের হুমকির কারণে রাজনীতি থেকে অবসর নিতে বাধ্য হলেন। লিজ চেইনি সহ আরো যে কজন সিনেটর ট্রাম্পের বিপক্ষে গিয়ে সত্যি কথা বলেছেন তারা আসন্ন দলীয় নির্বাচনে পুনরায় মনোনীত হতে পারবেন কিনা এই ব্যাপারে এখন যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ট্রাম্পের রোষাণলে যাতে না পড়েন সেই জন্যে রিপাবলিকান দলের সকল নেতা বিশেষ করে যারা আসন্ন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাবার জন্য লড়ছেন তারা জোরালোভাবে ট্রাম্পের পক্ষ নিয়ে বক্তব্য রেখে তার (ট্রাম্প) সমর্থন কুড়াচ্ছেন। পরিস্থিতি এমন হয়ে গেছে যে রিপাবলিকান পার্টি এখন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক এক ব্যক্তিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে যেখানে সত্যিকার অর্থে এখন আর গণতন্ত্র চর্চার বালাই নেই বললেই চলে। রাজনীতিতে নতুন যারা তাদের এমনটি করলে অবাক হবার কিছু ছিল না, কিন্তু দলের বাঘা বাঘা নেতারাও এখন ট্রাম্পের সামনে বিড়াল হয়ে বসে থাকেন এবং তিনি মাথা নাড়লে তারাও মাথা নাড়েন, তিনি হাততালি দিলে তারাও হাততালি দেন, তিনি হাসলে তারাও হাসেন। চীন নয়, রাশিয়া নয়, নয় উত্তর কোরিয়া, খোদ আমেরিকায় এমনটি ঘটছে। অবাক হবার তো কথা।
ক্ষমতা থেকে চলে যাবার পর যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রেসিডেন্ট এত আলোচনায় আসেননি, এত বিতর্কের সৃষ্টি করেননি, যতটা না ডোনাল্ড ট্রাম্প করে চলেছেন। অন্যদিকে একটার পর একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছেন তিনি। মনে করা হয় এই বুঝি ‘ঘুঘু’ ফাঁদে ধরা পড়লো। কিন্তু না, পরক্ষণেই ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন তিনি। ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিল আক্রমণকে ঘিরে যখন তদন্ত চলমান, সেই সময় সমপ্রতি নতুন করে আলোচনায় এলো ফ্লোরিডার পামবিচ কাউন্টিতে অবস্থিত ট্রাম্পের বিশাল বিলাসবহুল বাসভবন ‘মার-আ-লাগো’। তার বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ- ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত গোপন নথি বেআইনিভাবে এই ভবনে নিয়ে গেছেন এবং গোপন রাষ্ট্রীয় নথির অপব্যবহার, বিচারপ্রক্রিয়ায় বাধাদান ও গুপ্তচর আইনের লঙ্ঘন করেছেন। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলির মধ্যে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ‘গুপ্তচর আইন লঙ্ঘন’। এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার কপালে জেল সহ বড় ধরনের শাস্তি যে অপেক্ষা করছে তা বলা বাহুল্য।
অবাক লাগে যে জনগণ বিশেষ করে রিপাবলিকান দলীয় নেতা ও দলীয় সমর্থকরা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ব্যাপারটিকে কোন আমলেই নিচ্ছেন না। তারা এই বিষয়টি একবারও চিন্তা করে দেখছেন না যে রাষ্ট্রীয় অতি গোপন নথি তথা পারমাণবিক ভান্ডার বিষয়ক কোন নথি রাষ্ট্রের নির্ধারিত রক্ষণাবেক্ষণের স্থান থেকে বাইরে আনার ক্ষমতা দেশের প্রেসিডেন্টেরও নয়। সেক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই কর্মটি করেছেন। তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখনও জানা গিয়েছিল যে, কোন নথি বা নোট পড়ার পর তিনি অনেক সময় হয় ছিঁড়ে ফেলতেন বা নিজের পকেটে রেখে দিতেন। এমনকি জরুরি নথি পড়ার পর টয়লেটে ছুঁড়ে ফ্ল্যাশ করতেন। মোটকথা, যা কিছু স্বাভাবিক না, তার অনেক কিছুই করতেন ‘আনপ্রেডিকটেবল পার্সন’ হিসাবে পরিচিত এই ব্যক্তি। তবে এমন নয় যে প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রের কোন গোপন নথি ব্যক্তিগত বাসভবনে নিয়ে আসতে পারবেন না। ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং আরো কোন কোন প্রেসিডেন্ট অফিসের জরুরি ফাইল, নথি বাসায় নিয়ে আসতেন। কাজ করার জন্য। কিন্তু তা তারা করেছেন যখন ক্ষমতায়। ক্ষমতা ছাড়ার পর তারা এমনটি করেননি বলে জানা যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প করেছেন।
আগেই উল্লেখ করেছি রিপাবলিকান পার্টিতে বর্তমানে যে সকল নেতা-নেত্রী আছেন তাদের ভয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধচারণ করলে তাদের নিজ নিজ আসন হারাতে হবে। আর সে কারণে ট্রাম্প ও তার বলয়ের মধ্যে অবস্থান নেয়া ব্যক্তিদের সুরে সুর মিলিয়ে তারা বলছেন, মার-আ-লাগো নিয়ে যা হচ্ছে তা কেবল ট্রাম্পকে হয়রানি করার জন্যে, রাস্তা খুঁজে বের করছে যাতে তিনি ২০২৪ নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারেন। ইতিমধ্যে একাধিক সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্য এই পদক্ষেপের জন্যে এফ বি আই ও বিচার বিভাগের কঠোর সমালোচনা করেছেন। দলীয় নেতা কেভিন ম্যাকার্থি এই বলে হুমকি দিয়েছেন যে, রিপাবলিকান পার্টি কগ্রেসের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও এটর্নি জেনারেল ম্যারিক গারল্যান্ডের অভিশংসনের ব্যবস্থা নেবেন। ইতিমধ্যে অতি উৎসাহী জর্জিয়া থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান দলীয় কংগ্রেস সদস্য মার্জোরি টেইলার অভিসংশনের নোটিশ জারি করেছেন। ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বিলাসবহুল বাসভবনে এফবিআইয়ের এই যে অভিযান তা জো বাইডেন ও তার প্রশাসনকে বিপদে ফেলতে পারে, যদি প্রমাণিত হয় যে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ নথি সেখানে পাওয়া যায়নি। নিঃসন্দেহে এটিকে পুঁজি করে ট্রাম্প ও রিপাবলিকান দল আগামী নির্বাচনে ফায়দা লুটবে। তবে ঘটনা কোনদিকে গড়ায় সেটি দেখার জন্যে আমাদের আরো দুটি বছর অপেক্ষা করতে হবে। সেদিনের অপেক্ষায়।

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একসূত্রে গাঁথা
পরবর্তী নিবন্ধভিশন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লব