নার্স কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার হয়রানি, সেবায় অবহেলা

চমেক হাসপাতাল নিয়ে সেই পুরনো অভিযোগ

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ৪ আগস্ট, ২০২২ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের সেবা নিয়ে ঘুরে ফিরে সেই পুরনো অভিযোগগুলোই উঠে এসেছে দুদকের (দুর্নীতি দমন কমিশনের) গণশুনানিতে। বিশেষ করে হাসপাতালের নার্স, ওয়ার্ডবয়, টিকিট কাউন্টারম্যান ও লিফটম্যানদের দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করেছেন সেবাগ্রহীতারা। এছাড়া সেবাদানে নার্সদের অবহেলা, দালাল ও ওষুধ চোর চক্রের উৎপাত, বাইরে পরীক্ষা করানো, এমআরআই মেশিন বিকল থাকায় ভোগান্তি এবং বেশি টাকায় মেশিন ক্রয়ের অভিযোগও উঠে এসেছে শুনানিতে।

গতকাল বুধবার সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শাহ বীর উত্তম মিলনায়তনে এ গণশুনানির আয়োজন করে দুদক। শুনানিতে চমেক হাসপাতাল সংক্রান্ত মোট চারটি অভিযোগ দুদকের তালিকায় স্থান পায়। যদিও অভিযোগকারী একজনও শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন না। পরে অভিযোগকারী ছাড়াই এসব অভিযোগের শুনানি করেন দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান। দুদকের তালিকায় দেখা গেছে, হাসপাতালের নার্স, ওয়ার্ডবয়, টিকিট কাউন্টারম্যান ও লিফটম্যানদের দুর্ব্যবহার-হয়রানির অভিযোগ করেছেন কামরুল ইসলাম নামে এক সেবাগ্রহীতা। দালাল এবং ওষুধ চোর চক্রের উৎপাতের কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। সংকটাপন্ন নিজের শিশু সন্তানের চিকিৎসা সেবায় নার্সদের পক্ষ থেকে চরম অযত্ন-অবহেলার অভিযোগ করেছেন ক্যসাই অং নামে আরেক অভিযোগকারী। কানের একটি টেস্ট বাইরে করতে গিয়ে ১২০০ টাকা খরচ হয়েছে উল্লেখ করে পরীক্ষায়-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ করেছেন জুয়েল নামে অপর এক অভিযোগকারী। দীর্ঘদিন ধরে এমআরআই মেশিন বিকল থাকায় রোগীদের ভোগান্তির কথা বলেছেন মো. আবু বক্কর ছিদ্দিক নামে এক সেবাগ্রহীতা।

শুনানি করতে গিয়ে দুদক কমিশনার নিজেই এসব (দুর্ব্যবহার-হয়রানি, অবহেলা, দালালের উৎপাত) অভিযোগকে পুরনো বলে অভিহিত করেছেন। নিজে এক সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন উল্লেখ করে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, আমি এক সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছি। তাই এসব বিষয়ে আগে থেকেই জানি-অবগত আছি। তবে প্রাইভেট হাসপাতালে গেলে সেখানে কিন্তু ভালো ব্যবহার পাওয়া যায়। এটি হতে পারে টাকার বিনিময়ে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে উদ্দেশ্য করে দুদক কমিশনার বলেন, আমরা জানি-আপনাদের যোগ্যতার অভাব নেই। তবে একটু আন্তরিক হতে হবে। অবস্থার পরিবর্তনে প্রয়োজনে স্টাফসহ সকল পর্যায়ে মোটিভেশন করতে হবে।

বিকল এমআরআই মেশিনের বিষয়ে দুদক কমিশনার বলেন, এটা তো ঠিক যে মেশিন নষ্ট থাকায় মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। মেশিন সারাতে আপনারা কাজ করছেন, মন্ত্রণালয়ে লিখছেন। এটি কিন্তু মানুষ শুনতে অগ্রহী না। মানুষ সেবাটা চায়। এক পর্যায়ে এমআরআই মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিষয়েও জানতে চান তিনি। এ সময় দুদক কমিশনার বলেন, এসব ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের পিছনে অনেকেই থাকে। এ ধরনের কিছু দুষ্ট লোক সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো নষ্ট করে ফেলেছে। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে আমাদের মামলা আছে। অনেকে দেশেই থাকে না।

হাসপাতালের সেবা সংক্রান্ত অভিযোগগুলোর বিষয়ে জবাব দেন চমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. অং সুই প্রু মারমা। হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ১৩’শ থেকে সম্প্রতি ২২’শ-তে উন্নীত হওয়ার তথ্য উল্লেখ করে সেবাদানে প্রকট লোকবল সংকটের কথা তুলে ধরেন তিনি। হাসপাতালের উপ-পরিচালক বলেন, সরকারি ভাবে ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারি নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। বিশেষ করে এজন্যই আমাদের লোকবল সংকট প্রকট। এরপরও যারা আছে, সবাইকে আমরা মোটিভেশন করছি।

কয়েকদিন আগেও নার্সদের নিয়ে আমরা কয়েক দফায় বসেছি। অবস্থার পরিবর্তনে হাসপাতালের পরিচালক মহোদয়ের নের্তৃত্বে আমরা আন্তরিক ভাবে কাজ করছি।
তথ্য-উপাত্তসহ এমআরই মেশিনের বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন হাসপাতালের স্টোর অফিসার ডা. হুমায়ুন কবির। অভিযোগের প্রেক্ষিতে কানের পরীক্ষা করানোর মেশিনটি হাসপাতালে নেই জানিয়ে ডা. হুমায়ুন কবির বলেন, কানের যে পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে, সেটির জন্য অডিওমিটার মেশিন দরকার। কিন্তু আমাদের ওই মেশিন নেই। মেশিন চালাতে টেকনিশিয়ানেরও অভাব রয়েছে। হাসপাতালে ওই মেশিন না থাকার কারণেই রোগীদের বাইরে থেকে ওই পরীক্ষা করাতে হয়েছে বা হচ্ছে। তবে হাসপাতালে মেশিনটি স্থাপনের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং মন্ত্রণালয়ে লিখবেন বলেও শুনানিতে বলেন হাসপাতালের এ কর্মকর্তা।

এ সময় হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাজিব পালিত ও সহকারী পরিচালক (অর্থ ও ভান্ডার) ডা. জাহাঙ্গীর আলম সেখানে উপস্থিত ছিলেন। শুনানির শুরুতে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান ও চমেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তারও মিলনায়তনে উপস্থিত ছিলেন।

মো. নুর হোসেন নামের অপর এক অভিযোগকারী হাসপাতালের জন্য মেশিন ক্রয়ে অনিয়মের অভিযোগ করেছেন। তার অভিযোগ, সার্জারী ও গাইনী বিভাগের জন্য ইলোক্ট্রো সার্জিক্যাল ইউনিট লেজার ফিউশন মেশিন ক্রয়ে অনিয়ম হয়েছে। সর্বনিম্ন ২৮ লাখ টাকার দরদাতা থাকা সত্ত্বেও বেশি দামে ওই মেশিন কেনা হয়েছে। যদিও এটি আগের অর্থ বছরের ঘটনা উল্লেখ করে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (অর্থ ও ভান্ডার) ডা. জাহাঙ্গীর আলম শুনানিতে বলেন, একটি টেকনিক্যাল কমিটির মাধ্যমে ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পাদন করা হয়। ওই মেশিনের ক্ষেত্রে ওয়্যারেন্টির একটি শর্ত ছিল। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানটি সর্বনিম্ন দরদাতা বলা হচ্ছে, তারা কোনো ওয়্যারেন্টি দেয় নাই। আর এখানে একটি মেশিনের কথা বলা হলেও মেশিন আসলে দুটি। বিস্তারিত শুনে বিষয়টি যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান। তিনি বলেন, এটির বিষয়ে আমাদের দুদক কর্মকর্তারা খোঁজ নেবেন। তাদের আপনারা কাগজপত্র দিয়ে সহযোগিতা করবেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমিটারগেজ বগি চট্টগ্রাম আসতে আরো ৫ মাস
পরবর্তী নিবন্ধতিন বছর ধরে ‘অধরা’ পাসপোর্টের নাগাল দুদিনেই