বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের দায়ে নগরীর বায়েজিদ থানাধীন জালালাবাদের প্রিমিয়ার এক্সেসরিজের বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকি মামলার দুটি পৃথক আদেশে অর্থদণ্ডের টাকাসহ ৪৪ কোটি ১৩ লাখ ৪৮ হাজার ৭১৩ দশমিক ৯৪ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট চট্টগ্রাম। গত ৪ জুলাই কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট চট্টগ্রামের কমিশনার একেএম মাহবুবুর রহমান স্বাক্ষরিত এ আদেশ দুটি জারি করা হয়। প্রিমিয়ার এক্সেসরিজের বিরুদ্ধে মেশিনারিজের উৎপাদন ক্ষমতার অতিরিক্ত কাঁচামালের ব্যবহার দেখিয়ে ইউপি (ইউটিলাইজেশন পারমিশন) গ্রহণ করে ১১ কোটি ৪২ লাখ ৮২ হাজার ৩৬৯ দশমিক ৩১ টাকা এবং জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজিত ইউডির (ইউটিলাইজেশন ডিকলারেশন) বিপরীতে ইউপি গ্রহণের মাধ্যমে ৩ কোটি ২০ লাখ ৬৬ হাজার ৩৪৪ দশমিক ৬৩ টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ এনে দাবিনামাসহ কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছিলো চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট।
উৎপাদন ক্ষমতার অতিরিক্ত কাঁচামাল ব্যবহারের পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়, প্রিমিয়ার এক্সেসরিজ লিমিটেড কারণ দর্শানোর জবাবে উল্লেখ করেছে তারা নতুন ২০টি টুইল টেপ মেশিন স্থানীয় বাজার থেকে ক্রয় করে। কিন্তু নতুন ওই ২০টি টুইল মেশিন সংযোজনের জন্য কাস্টমস বন্ড দপ্তরের অনুমোদন গ্রহণ করা হয়নি এবং অনুমোদন পেতে কোনো আবেদনও করেনি। প্রতিষ্ঠানটি আমদানি এবং ২০টি মেশিন ক্রয় করেছেন কারণ দর্শানোর নোটিশে এমনটি জানালেও তা বন্ড লাইসেন্সে অন্তর্ভুক্ত করেনি বিধায় তা বিবেচনা করার আইনগত কোনো সুযোগ নেই। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটিতে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তের জন্য নথি নং-এস৪-১৯/বন্ড(সাঃ)/লাই/২০০০(অংশ-০২) এর নোটানুচ্ছেদ ৩০৮ (ঘ) এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ২০২১ সালের ২৫ মার্চ কারখানা পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শন প্রতিবেদনে ওই মেশিনগুলো স্থাপিত হয়েছে মর্মে উল্লেখ নেই। প্রতিবেদনে পূর্বের ১২টি টুইল টেপ মেশিনের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ নতুন কোনো মেশিন স্থাপন কিংবা তা দ্বারা পণ্য উৎপাদনের কোনো তথ্য প্রমাণ নেই। পর্যালোচনায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ড্রয়েস্টিং/ড্রকেট উৎপাদন করার জন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ গত ২৯ মার্চ ২০২০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত মোট দুই লাখ ৭৮ হাজার ২৮ কেজি পলিস্টার ইয়ার্ন ব্যবহার করেছে। কিন্তু দেখা যায়, এতে উৎপাদন ক্ষমতার অতিরিক্ত ১ লাখ ২৬ হাজার ৮২৮ কেজি কাঁচামাল বা পলিস্টার ইয়ার্ন ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া একই সময়ে টুইল টেপ উৎপাদনে মোট পলিস্টার ইয়ার্ন ব্যবহার করা হয় ১০ লাখ ৪২ হাজার ১১৬ কেজি। এ সময় প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদন ক্ষমতার অতিরিক্ত ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬৩ কেজি পলিস্টার ইয়ার্ন ব্যবহার করেছে বলে পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়।
চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের আদেশে বলা হয়েছে, প্রিমিয়ার এক্সেসরিজ পণ্যভেদে মেশিনারিজের উৎপাদন ক্ষমতার অতিরিক্ত কাঁচামাল ব্যবহার করে। অর্থাৎ মিথ্যা ঘোষণায় অপসারিত কাঁচামালের শুল্ক করের পরিমাণ ১১ কোটি ৪২ লাখ ৮২ হাজার ৩৬৯ দশমিক ৩১ টাকা আদায়ের লক্ষ্যে জারিকৃত দাবিনামা দি কাস্টমস অ্যাক্ট, ১৯৬৯ এর সেকশন ১১১ অনুযায়ী চূড়ান্ত করা হলো। বন্ড সুবিধার আমদানিকৃত কাঁচামাল মিথ্যা ঘোষণায় ইউপি গ্রহণ করে অবৈধভাবে অপসারণের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়ায় দি কাস্টমস অ্যাক্ট, ১৯৬৯ এর সেকশন ৩২ লংঘনের কারণে একই আইনের সেকশন ১৫৬ (১) এর টেবিলের ক্লজ ১৪ অনুযায়ী ২৩ কোটি অর্থদণ্ড আরোপ করা হলো। প্রাপ্য শুল্ককরাদি ১১ কোটি ৪২ লাখ ৮২ হাজার ৩৬৯ দশমিক ৩১ টাকা ও অর্থদণ্ডের টাকাসহ মোট ৩৪ কোটি ৪২ লাখ ৮২ হাজার ৩৬৯ দশমিক ৩১ টাকা আদেশ জারির ৩০ দিনের মধ্যে পরিশোধের দিন পর্যন্ত প্রযোজ্য সুদসহ ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে ট্রেজারি চালানের মূল কপি এই দপ্তরে দাখিল করার নির্দেশ দেয়া হলো।
অপরদিকে জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজিত ইউডির বিপরীতে ইউপি গ্রহণের পর্যালোচনায় কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করেন, কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে প্রিমিয়ার এক্সেসরিজ লিমিটেড অগ্নিকাণ্ড ঘটনার পর থেকে অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর ২০২০ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত ২৯টি লোকাল ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে ইউপি গ্রহণ করে পণ্যসামগ্রী বিভিন্ন গার্মেন্টসে রপ্তানি করে, যার সমর্থনে প্রিমিয়ার এক্সেসরিজ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত পিআরসি প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে। ইউপি গ্রহণের জন্য আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের দেয়া ব্যাক টু ব্যাক এলসি এবং বিজিএমইএ/বিকেএমইএ থেকে দেয়া ইউডি দাখিল করতে হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতা পরস্পর যোগসাজসের মাধ্যমে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় করা হয়েছে। বিজিএমইএ/বিকেএমইএ কর্তৃক ইউডি ইস্যু করা হয়নি। বরং জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজিত ইউডি দাখিল করে প্রিমিয়ার এক্সেসরিজ ইউপি গ্রহণ করে। জালিয়াতিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় নেয়া ইউপি আইনগত বৈধতা পেতে পারে না। কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব ও শুনানিতে দেয়া বক্তব্যে আরো উল্লেখ করা হয়, অগ্নিকাণ্ডের পর তিনটি প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রিমিয়ার এক্সেসরিজ লিমিটেড সাব কন্ট্রাক্ট কার্যক্রম সম্পাদন করেছে বলে জানায়। যার সপক্ষে তারা চুক্তিনামাও দাখিল করে। কিন্তু ওই জবাবের আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। কারণ বন্ড লাইসেন্সধারী রপ্তানি প্রতিষ্ঠানের কোনো ধরণের সাব কন্ট্রাক্ট কার্যক্রম সম্পাদনের আইনগত বিধান নেই। এ ছাড়া যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উত্তর আগ্রাবাদ রঙ্গীপাড়ার মেসার্স মেলভিন এক্সেসরিজ, দেওয়ানহাটের মেসার্স পাঞ্জাতন এক্সেসরিজ এন্ড প্রিন্টিং লিমিটেড এবং জালালবাদ বায়েজিদ বোস্তামী রোডের মেসার্স মোহাম্মদী ডাইং এন্ড প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে জানিয়েছে মেসার্স প্রিমিয়ার এক্সসরিজ লিমিটেডের কোনো ধরণের সাব কন্ট্রাক্ট কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। অন্যদিকে প্রিমিয়ার এক্সেসরিজের বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সিআই সেলের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রিমিয়ার এক্সেসরিজ বিজিএমইএ’র ৬টি এবং বিকেএমইএ’র ১০টি ইউডি জালিয়াতির মাধ্যমে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট থেকে ৭৩টি ইউপি গ্রহণ করেছে। পরবর্তীতে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট প্রিমিয়ার এক্সেসরিজের এলসি সংক্রান্ত ব্যাংক দলিলাদি, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং সিইপিজেড থেকে প্রাপ্ত দলিলাদি পর্যালোচনা করে। এতে বিজিএমইএ থেকে প্রাপ্ত ৭টি প্রতিষ্ঠান, বিকেএমইএ থেকে প্রাপ্ত ১২টি প্রতিষ্ঠান এবং সিইপিজেডের ৩টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা পায় কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। এ ছাড়া তিনটি বন্ডেড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের কথিত সাব কন্ট্রাক্টের দাবি মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় এবং জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজিত ইউডির বিপরীতে ইউপি গ্রহণ করায় এটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় প্রিমিয়ার এক্সেসরিজ লিমিটেডে গত ১৬ ডিসেম্বর ২০২০ ইং অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি পণ্য উৎপাদন করেনি। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন সক্ষমতা ছিল না। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে কেবল বৈদেশিক মুদ্রা আদান প্রদান করেছে। জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজিত ইউডির বিপরীতে ইউপি গ্রহণের মাধ্যমে অবৈধভাবে অপসারিত কাঁচামালের শুল্ককরাদি ৩ কোটি ২০ লাখ ৬৬ হাজার ৩৪৪ দশমিক ৬৩ টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বন্ড কাস্টমস কর্তৃপক্ষের আদেশে উল্লেখ করা হয়, জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজিত ইউডির বিপরীতে ইউপি গ্রহণ করে কাঁচামাল অপসারণের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় দি কাস্টমস অ্যাক্ট, ১৯৬৯ এর সেকশন ৩২ লংঘনের কারণে একই আইনের সেকশন ১৫৬ (১) এর টেবিলের ক্লজ ১৪ অনুযায়ী ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড আরোপ করা হলো। প্রাপ্য শুল্ককরাদি ৩ কোটি ২০ লাখ ৬৬ হাজার ৩৪৪ দশমিক ৬৩ টাকা ও অর্থদণ্ডের টাকাসহ মোট ৯ কোটি ৭০ লাখ ৬৬ হাজার ৩৪৪ দশমিক ৬৩ টাকা আদেশ জারির ৩০ দিনের মধ্যে পরিশোধের দিন পর্যন্ত প্রযোজ্য সুদসহ ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে ট্রেজারি চালানের মূল কপি এই দপ্তরে দাখিল করার নির্দেশ দেয়া হলো।