১৯২২ সালের ৬ জুলাই তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাঠনায় পিতা আবদুল হাদী চৌধুরীর কর্মক্ষেত্রে জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ খালেদ এবং মৃত্যুবরণ করেন ২০০৩ সালের ২১ ডিসেম্বর। মাতা তামান্না বেগম ছিলেন একজন পর্দানসীন ধর্মপ্রাণ গৃহিণী। পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোনের সংসারে তাদের পৈতৃক নিবাস ছিল চট্টগ্রামের রাউজানের সুলতানপুর গ্রামের দারোগা বাড়ি। ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই কলেজের বেকার হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করেছেন। এটি ছিল ভারতের একটি ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন বিদ্যাপীঠ। পারিবারিক কারণে পাঠ সমাপ্ত না করে দেশে ফিরে এসে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক সমাপ্ত করে পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৪৪ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালে তিনি বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হলে তিনি এদেশের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ’৬২–এর কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৪–এর সাম্প্রদায়িক প্রতিরোধ আন্দোলন, ’৬৬–এর ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন ’৬৯–এর গণ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন তিনি। ’৭০–এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে রাউজান–হাটহাজারী সংসদীয় আসনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেন। এদেশের রাজনীতিক অঙ্গনের দিকপাল ছিলেন তিনি। ছিলেন ক্ষণজন্মা পুরুষ। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত এই গুণীজন ব্যক্তি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩২ জন সদস্যের মধ্যে অন্যতম সদস্য ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। ’৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি চট্টগ্রামে ছাত্র ও যুব সমাজকে সংগঠিত করেন এবং সংগ্রাম পরিচালনার জন্য গঠিত ৫ জন সদস্যের মধ্যে অন্যতম সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে কালুরঘাটে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুজিব নগর সরকারের তথ্য দপ্তরের দায়িত্ব প্রাপ্ত হিসেবে স্বাধীন বংলা বেতারের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। পাশাপাশি মুজিব নগর সরকারের মুখপাত্র হিসেবে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বাকশালের উত্তর জেলার গভর্নর নিযুক্ত করেন। চট্টগ্রামের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিল। তিনি ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা। উন্নয়নের ভূমিকা রাখতে শত নাগরিক কমিটি গঠন করে চট্টগ্রামের দলমত নির্বিশেষে সকলকে একিই প্লাটফর্মে আনেন যা অন্য কোনো রাজনীতিক নেতার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তচিন্তা চর্চার পথিকৃৎ। এই মহান ব্যক্তিত্বের স্মরণে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব প্রতি বছর অধ্যাপক খালেদ স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে থাকে। এছাড়া চট্টগ্রাম একাডেমি প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে অধ্যাপক খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে আসছে। ইতিমধ্যে বাংলা একাডেমি তাঁর জীবনী গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। তিনি সকল লোভ লালসার উর্ধ্বে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু একনিষ্ঠ ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে তাঁর অনেক সুখ্যাতি ছিল। জাতীয় পরিষদ সদস্য থাকাকালীন সময়ে সর্বক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল প্রশংসনীয়। আজকের দিনে অনেক মন্ত্রী, এমপি ও দলের প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বা সমাজের অপরাধ ঘটানোর প্রবণতা দেখা যায়। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এ সবকিছুর উর্ধ্বে ছিলেন। এক কথায় সে সময় রাজনীতিতে নোংরামী ছিল না। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। অধ্যাপক খালেদকে নিয়ে অনেকে নানা কথা বলেন। কিন্তু, বাস্তবতা হলো ’৭৫–এর ১৫ আগস্ট প্রেক্ষাপট নিয়ে অনেক বেশি দুশ্চিন্তা করতেন তিনি। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর খুনি মোশতাক, জিয়া আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের উপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালানো শুরু করে সেসময় বঙ্গবন্ধুর নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতে দেয়নি খুনিরা। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদে একাধিকবার বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বার্ষিকী পালন করেন। ওই সময় তাঁর নেতৃত্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচীও পালিত হয়। দল ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধাবোধ ও আনুগত্য ছিল। যার ফলে খন্দকার মোস্তাক, জিয়া ও এরশাদের লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন তিনি। নীতি এবং আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর জয়গান গেয়েছেন। পরিবারের জন্য তেমন কোনো সম্পত্তিও রেখে যাননি। মৃত্যুর এক মাস আগে তাঁর বড় ছেলে মো. জমির দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ছোট ছেলে মো. জহির সাপ্তাহিক স্লোগান পত্রিকার সম্পাদক। তিনি আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের জামাতা ও বর্তমান সম্পাদক এম. এ. মালেকের ভগ্নিপতি। উল্লেখ্য, আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক খালেদ মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার ও বর্তমান সম্পাদক এম এ মালেক একুশে পদকে ভূষিত হন। আমার মরহুম পিতা আবদুল মাবুদ সওদাগরের সাথে অধ্যাপক খালেদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ২০০১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে চেরাগী পাহাড়স্থ সেন্টার পয়েন্ট হাসপাতালে আমার অসুস্থ পিতাকে দেখতে আসেন তিনি এবং সেখানে দীর্ঘ সময় অবস্থান করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সুস্থ অবস্থায় তিনি কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সহ পবিত্র জুমার নামাজ আদায় করতেন। আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক ছিলেন তিনি। বয়সে ছোট হলেও কাউকে আপনি ছাড়া তুমি বলে সম্বোধন করতেন না। তাঁর মাঝে কোনো উচ্চাভিলাসী মনোভাব ছিল না। সবসময় রিকশায় চড়তেন। দেওয়ান বাজারস্থ আমেনা মঞ্জিলে একটি ভাড়া বাসায় জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। দৈনিক আজাদীর মতো ঐতিহ্যবাহী ও বহুল প্রচারিত একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক হয়েও তাঁর মাঝে কোনো অহংকার ছিল না। একজন সম্পাদকের উপর নির্ভর করে পত্রিকার জনপ্রিয়তা খালেদ সাহেব তাঁর জ্বলন্ত প্রমাণ। তিনি সুদীর্ঘ ৪৫ বছর সততা ও নিষ্ঠার সাথে আজাদীর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক খালেদ ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ। তাঁর এই শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তাঁকে হারিয়ে আমরা একজন রাজনীতিক অভিভাবককে হারিয়েছি। দেশবাসী হারিয়েছে বরেণ্য এক বুদ্ধিজীবী। জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের জন্য চট্টগ্রামে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনীতিক জীবনের নীতি, আদর্শ, ত্যাগ ও সফলতা তুলে ধরে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অধ্যাপক খালেদ ছিলেন রাজনীতির আদর্শের পাঠশালা। তাঁর আদর্শ যেন এদেশের রাজনীতিক নেতাকর্মীদের চলার পথের পাথেয় হয়। জন্মশতবার্ষিকীতে এই বীরের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন।
লেখক: শ্রম বিষয়ক সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ।