রাতের রাজপথে নতুন অপরাধী

গণপরিবহনের চালক, হেলপারের আড়ালে কর্মকাণ্ড, নগরে চক্র

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ৫ জুন, ২০২২ at ৫:৩০ পূর্বাহ্ণ

নগরীতে রাতের রাজপথে নতুন একটি অপরাধী চক্রের সন্ধান মিলেছে। তারা গণপরিবহনের চালক, হেলপারের আড়ালে কখনো ছিনতাই করে, কখনোবা করে ধর্ষণ। কখনো আবার যাত্রীদের ছুরিকাঘাতও করা হয়। সম্প্রতি নগরীতে শহর এলাকার একটি বাস জব্দ করার পর একের পর এক বেরিয়ে আসছে এমন চাঞ্চল্যকর কাহিনী। এমন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে গণপরিবহনের জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে পুলিশকে। পরপর তিনটি ঘটনায় জড়িত এই গাড়িটির সামনের নম্বর প্লেটটি বাসের বাম্পারের আড়ালে ঢোকানো, যাতে সহজে নম্বর দেখা না যায়। পেছনে নম্বর প্লেট ছিল না।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) সামশুল আলম বলেন, আমাদের কাছে মনে হচ্ছে এটি অপরাধীদের নতুন একটি কৌশল। বাকলিয়ার ঘটনাটির পর আমরা পরিবহন মালিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে এ বিষয়ে সভা করেছি। নগরীতে গণপরিবহন চালকদের বিষয়ে তথ্য চেয়েছি। নির্জন, ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সেখানে চেকপোস্ট বসানোর পরিকল্পনাও হয়েছে। সিএনজি টেক্সিকে যেমন ‘আমার গাড়ি নিরাপদ’ অ্যাপসের আওতায় আনা হয়েছে, একইভাবে নগরীতে চলাচলরত গণপরিবহনগুলোকে ডাটাবেইজের আওতায় আনার ভাবনা রয়েছে।

সম্প্রতি বাকলিয়া, পাহাড়তলী ও বন্দর থানায় করা অভিযোগে একটি বাসের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেটির চালক তিনজন। তিন থানায় ধরা পড়েছে তিন চালক। বাসটি জব্দ করে বাকলিয়া থানা পুলিশ।

বাসটির মালিকানা সম্পর্কে বাকলিয়া থানার ওসি রাশেদুল হক বলেন, বাসটি বর্তমানে তৃতীয় পক্ষের কাছে রয়েছে। মূল মালিক অন্যজন। তিনি এটি বিক্রি করে দিলেও ক্রেতা মালিকানা বদল করেননি। গাড়িটি তদারকির দায়িত্বে একজন মহিলা রয়েছেন। তিনিও আবার মালিক নন। প্রকৃত মালিক তার দুই ছেলে, যারা বর্তমানে প্রবাসে অবস্থান করছেন। স্ট্যাম্পমূলে তারা প্রথম মালিকের কাছ থেকে গাড়িটি ক্রয় করেন।

১৯ মে রাতে বাসটিতে এক গার্মেন্টসকর্মীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। নিজেকে রক্ষা করতে ওই তরুণী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস থেকে লাফ দিয়ে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করেন। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঁচদিন চিকিৎসা নেন। বাসটি ওই কোম্পানির সাথে চুক্তিতে শ্রমিকদের আনা-নেওয়া করত। ঘটনার দিন বাসে আরো ১০-১২ জন সহকর্মী ছিলেন। বিভিন্ন স্টপেজে কর্মীদের নামিয়ে দিয়ে বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালের দিকে যেতে থাকে বাসটি। চালক আনোয়ার ড্রাইভিং সিট থেকে উঠে হেলপার জনিকে চালাতে দেয়। পথে ভিক্টিমের স্টপেজ চলে আসলে আনোয়ার তাকে নামতে না দিয়ে হাত ধরে টেনে বাসের পেছনে নিয়ে যায়। সেখানে জোরপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা করে। বাসটি রাহাত্তারপুল ফ্লাইওভারের দক্ষিণ পাশে পাকা রাস্তার উপর আসলে ওই গার্মেন্টসকর্মী নিজেকে রক্ষা করতে জানালা দিয়ে চলন্ত বাস থেকে লাফ দেন।

বাকলিয়া থানার ওসি রাশেদুল হক আজাদীকে বলেন, ঘটনার ছয়দিন পর তরুণী কিছুটা সুস্থ হয়ে বাকলিয়া থানায় মামলা দায়ের করে। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে চালক আনোয়ারকে কুয়াইশ ও হেলপার জনিকে সিঅ্যান্ডবি থেকে গ্রেপ্তার করে। সাথে গাড়িটিও উদ্ধার করা হয়, যা বর্তমানে বাকলিয়া থানা হেফাজতে রয়েছে। আনোয়ার এই গাড়িটির নিয়মিত চালক নয়। তিনি অন্য চালকের কাছ থেকে বদলি নিয়ে অপরাধ ঘটানোর উদ্দেশ্যে গাড়িটি নিয়ে বের হয়। গাড়িটির হেলপার জনি দাশ দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। চালক আনোয়ারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ছিনতাই, ছুরিকাঘাতের মামলা রয়েছে।

এই ঘটনার পরদিন ২০ মে রাত ১২টার দিকে একই গাড়ি ব্যবহার করে ছিনতাই ও ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটানো হয়। ওইদিন রাতে ইপিজেড এলাকার বে শপিং সেন্টারের সামনে থেকে বাসে উঠেন পলাশ কান্তি দে নামে এক বিকাশ ব্যবসায়ী। নিমতলা বিশ্বরোডে পৌঁছার পর তাকে নামিয়ে দেওয়ার জন্য চালক গিয়াস উদ্দিন নয়নকে বললেও সে তা না শুনে গাড়িটি দ্রুত গতিতে চালিয়ে বড়পোলের দিকে নিয়ে যায়। এ সময় গাড়ির পেছনে যাত্রীবেশে থাকা গিয়াসের তিন সঙ্গী পলাশের উরু ও হাতের দুই আঙুলে ছুরিকাঘাত করে নগদ ১০ হাজার টাকা ও দুটি মোবাইল নিয়ে নেয়। পরে তারা বাসটি নিয়ে সিটি গেট, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিনেমা প্যালেস মোড়, বহদ্দারহাট এলাকায় ঘুরতে থাকে। উদ্দেশ্য বিকাশে থাকা বাকি টাকা তুলে নেওয়া। তিন স্টপেজে তারা তিন দফায় ৪০ হাজার ৮০০ টাকা তুলে নেয়। পরে আহত অবস্থায় পলাশকে ভোর রাতে লালখান বাজার এলাকায় ফ্লাইওভারে হাত-পা বেঁধে ফেলে যায়। পলাশ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বন্দর থানায় একটি ছিনতাই মামলা দায়ের করেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বন্দর থানার ওসি জাহেদুল কবীর আজাদীকে বলেন, ঘটনার পরপরই অভিযানে নেমে প্রথমে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করি। সিসিটিভি ফুটেজে দেখি, ওই বাসটি এর আগে বাকলিয়ায় গার্মেন্টসকর্মীকে ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যবহার করা হয়। একই বাস দিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনাটি ঘটে। ছিনতাইয়ের সময় বাসটিতে মোট চারজন ছিল। এর মধ্যে বাসটির মূল চালক গিয়াস ও ছিনতাইয়ে সহায়তাকারী সীমান্তকে চান্দগাঁও থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২২ মে রাত দেড়টার দিকে অন্য এক চালকের সহায়তায় আবারও ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত হয় বাসটি। ওইদিন রাতে ইলেকট্রিক দোকানের এক কর্মচারী পাহাড়তলী থানার অলংকার মোড় থেকে ভাটিয়ারী যাওয়ার জন্য বাসটিতে উঠেন। বাসটি এ কে খান পৌঁছাতেই একই কায়দায় যাত্রীবেশে থাকা চার ছিনতাইকারী ভিকটিমকে মারধর করে মোবাইল ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয়। এই ঘটনায় পাহাড়তলী থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়।

পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অভিযোগ পেয়ে বাসের চালক আশরাফুল ইসলাম, মিন্টু, নাঈম ও হাবিব নামে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই বাসে যে কয়টি ঘটনা ঘটেছে প্রতিটিতে চালকের আসনে ভিন্ন ভিন্ন অপরাধী ছিল, যারা মূলত একই চক্রের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসবুজে ভরে উঠুক আমাদের পৃথিবী
পরবর্তী নিবন্ধপ্রেমিককে জিম্মি করে কিশোরীকে গণধর্ষণ