ডায়াবেটিস বিষয়ে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের যুগান্তকারী আবিষ্কার

রেজাউল করিম স্বপন | বৃহস্পতিবার , ২ জুন, ২০২২ at ৪:২০ পূর্বাহ্ণ

মাঝেমধ্যে কিছু খবর শুনলে গর্বে বুকটা ভরে উঠে। তেমনই একটা খবর হলো বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ও গবেষকদের ডায়াবেটিস হওয়ার প্রধান কারণ আবিষ্কার। ডায়াবেটিসকে বলা হয় সর্বরোগের ডিপু। বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৪৬ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। যার মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ৮৪ লাখ ডায়াবেটিসের রুগি এবং এর দেড় গুণ মানুষ প্রাক ডায়াবেটিস অবস্থায় আছে। এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। গত ২৩ মার্চ ২০২২ রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয় মানুষের অন্ত্রের এক ধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্থ কমে যাওয়া ডায়াবেটিসের মূল কারণ। আগে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের এটি জানা ছিলো না। এই জৈব রাসায়নিকের নাম ইনটেষ্টিনাল এলকালাইন ফসফাটেস (আইএপি)। এটি মানুষের পাকস্থলীর শেষ অংশ হতে পায়ুপথ পর্যন্ত দীর্ঘ নালি বা অন্ত্রে থাকে। জাতীয় অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি ডা. এ কে আজাদ খান উক্ত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যাদের শরীরে আইএপি কম থাকে, তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। গবেষণা প্রতিবেদনটি ‘দ্য বিএমজে ওপেন ডায়াবেটিস রিসার্চ এন্ড কেয়ার’ চিকিৎসা সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। সাময়িকীটি যৌথভাবে প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ও যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন। বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এতে নেতৃত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাসাচুয়সটস জেনারেল হাসপাতালের সাবেক সহকারী অধ্যাপক ও প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. মধু এস মালো। এতে ডায়াবেটিক সমিতি, বারডেম হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ জন গবেষক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অংশগ্রহণ করেন। সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক মধু এস মালো বলেন, মানুষের খাদ্যনালিতে ১০০ ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া থাকে। এর পরিমাণ বেড়ে বা কমে গেলে শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। সংখ্যা বেড়ে গেলে শরীর তাকে মেরে ফেলে।

মৃত ব্যাকটেরিয়ার কোষ প্রাচীর টক্সিন নামের পদার্থ তৈরী করে। এ টক্সিন সাধারণত মলের সাথে বের হয়ে যায়। তবে অতিরিক্ত তেল/চর্বি জাতীয় খাবার, কোমল পানীয় ও এলকোহলে (মদ) অভ্যস্ত ব্যক্তিদের সম্পুর্ণ টক্সিন বের না হয়ে কিছুটা রক্তে মিশে যায়। রক্তে টক্সিন মেশার পর প্রদাহ সৃষ্টি হয়। টক্সিন শরীরে প্রবেশ করলে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদী হলে যুদ্ধক্ষেত্রের যোদ্ধারা ছাড়াও আশেপাশের অনেক কোষ ক্ষতির মুখে পড়ে। এতে ইনসুলিন প্রস্তুতকারী কোষ বা ইনসুলিন যার সাথে বন্ধন তৈরী করে তার ক্ষতিসাধন হয়। ফলে ধীরে ধীরে মানুষের ডায়াবেটিস হয়। তবে অন্ত্রে পর্যাপ্ত আইএপি থাকলে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই এনজাইম খাদ্যনালীতে ব্যাকটেরিয়াল টক্সিনের সঙ্গে বন্ধন তৈরী করে টক্সিনকে নষ্ট করে দেয়। ফলে দীর্ঘ মেয়াদি কোন প্রদাহ হয় না। তবে যদি অন্ত্রে আইএপি কম থাকে তবে শরীরের ইনসুলিন উৎপাদন ব্যাহত হয় (টাইপ১ ডায়াবেটিসের কারণ) বা ইনসুলিনের কার্যকারীতা কমে যায় (টাইপ২ ডায়াবেটিসের কারণ)। এখানে উল্লেখ্য যে, ইনসুলিন রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করে। ইনসুলিন উৎপাদন বন্ধ হলে বা উৎপাদন কমে গেলে অথবা কার্যকারিতা কমে গেলে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়। রক্তে মাত্রাতিরিক্ত গ্লুকোজ থাকার অর্থ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া। মৃত ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীর হতে তৈরী হওয়া টক্সিনকে ধ্বংস করে আইএপি। অন্ত্রে আইএপি কমে গেলে টক্সিন ধ্বংস হয় না বা কম ধ্বংস হয়। ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। আইএপি ও ডায়াবেটিসের এই সম্পর্কের কথা এতদিন জানা ছিলো না। এটিই এই আবিষ্কারের বিশেষত্ব। প্রশ্ন হলো অন্ত্রে আইএপি কমে কেন? এর সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো চিহ্নিত করা যায়নি। তবে ব্যাকটেরিয়া আঁশযুক্ত খাবার থেকে নানা এসিড তৈরী করে। এর একটির নাম বুটারিক এসিড। এই এসিড অন্ত্রে আইএপি বৃদ্ধি করে। কোন কারণে বুটারিক এসিড কমে গেলে আইএপি কমে যায়।

গবেষক দল ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সী ৫৭৪ জন নন ডায়াবেটিক সুস্থ মানুষ নিয়ে এই গবেষণাটি করেছে। এদেরকে পাঁচ বছর পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। গবেষণার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এদের আইএপি পরিমাপ করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, যাদের শরীরে আইএপি বেশী থাকে, তাদের তুলনায় আইএপি কম থাকা মানুষের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ১৩ গুন বেশি। গবেষণার শুরুতে যাদের অন্ত্রে আইএপি কম ছিল এবং পরে বেড়েছে, তাদের ডায়াবেটিস হয় নি। আর যাদের অন্ত্রে আইএপি কম ছিলো, খালি পেটে তাদের রক্তে গ্লুকোজ বৃদ্ধির মাত্রা ছিলো দ্বিগুণ। গবেষকরা বলেন যাদের শরীরে আইএপি কম তাদের কোনোভাবে আইএপি খাওয়ানো সম্ভব হলে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় অধ্যাপক মধু এস মালো শরীরে থাকা আইএপি পরিমাপের জন্য একটি প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন।এই প্রযুক্তিতে মল পরীক্ষার মাধ্যমে ৩ হতে ৩০ মিনিটের মধ্যে আইএপি পরিমাপ করা যায়। তবে এটি এখনো আনুষ্ঠানিক অনুমতি পাই নি। গবেষকেরা আরো বলেন আক্রান্ত ডায়াবেটিস রোগীরা এর থেকে উপকার পাওয়ার পদ্ধতির জন্য আরো গবেষণার দরকার। তবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এই আবিষ্কার বড় ভূমিকা রাখবে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তারা বলেন আইএপি বৃদ্ধিতে হলুদ ও ক্যাপসিকাম কাজ করে। গবেষকেরা আরো বলেন নানা কারণে ডায়াবেটিস হয়। এর মধ্যে একটি কারণ আইএপি কমে যাওয়া। অন্যদিকে জিন ও বংশ গত কারণে, মানুষ স্থুল হলে বা কায়িক পরিশ্রম কম করলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর সব প্রজাতির মধ্যে আইএপি এনজাইম বিদ্যমান। দেখা গেছে জেনেটিক মিউটেশনের কারণে ১৫% ও আইএপির স্বল্পতা বা অভাবে ৮৫% ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। সুস্থ মানুষের আইএপি গড় সাধারণত ৬৫ ইউনিটের বেশি। এই এনজাইম যাদের ৬৫ ইউনিটের বেশি তাদের ক্ষেত্রে মাত্র ৩% লোকের ডায়াবেটিস হয়েছে। আর যাদের ৬৫ ইউনিটের কম তাদের মধ্যে ৪২% মানুষের ডায়াবেটিস হয়েছে। অন্যদিকে আইএপির মাত্রা অনুযায়ী মানুষকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে ০১৫ ইউনিট, ১৫৩৩ ইউনিট, ৩৩৫৫ ইউনিট, ৫৫১১৫ ইউনিট ও ১১৫ ইউনিটের বেশি। সবচেয়ে বেশি ইউনিট আইএপির তুলনায় সবচেয়ে কম ইউনিট আইএপির ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস হওয়ার আশংকা ১৪ গুণ বেশি। তাই ডায়াবেটিস মুক্ত থাকতে হলে যেসব খাদ্য খেলে আইএপি বাড়ে (হলুদ, ক্যাপসিকাম ও আশ জাতীয় খাদ্য) খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে, শারীরিক পরিশ্রম বাড়াতে হবে এবং তেল/চর্বি জাতীয় খাবার, কোমল পানীয়, এলকোহল আসক্তি ও শরীরের স্থুলতা কমাতে হবে। তবেই আমরা সুস্থ ও সবল জীবন যাপন করতে পারবো।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল
পরবর্তী নিবন্ধসিএসইতে লেনদেন ২২.৫৯ কোটি টাকা