প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সব জেলায় স্টেডিয়ামসমূহ সাধারণের খেলাধূলার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। সম্প্রতি জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানের সময় তিনি অত্যন্ত সময়োপযোগী গুরুত্বপূর্ণ এ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এটি বাস্তবায়িত হলে শিশু– কিশোরসহ তরুণ প্রজন্মকে খেলাধূলামুখী করার কাজটি কিছুটা সহজ হবে। হাজার কোটি টাকার স্টেডিয়ামগুলো এতে সারাবছর ব্যাপী সদ্ধ্যবহার হবে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে দিন দিন মাঠের সংখ্যা যে হারে কমছে তাতে উদ্ধিগ্ন হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আজকালকার তরুণ প্রজন্ম নেটে আসক্ত। মোবাইল ফোন নিয়ে তারা দিনরাত ব্যস্ত। শিশু–কিশোররা অনলাইন গেমস কার্টুন নিয়ে পড়ে থাকছে। বাচ্চাদের হাতে মোবাইল ফোন না দিলে তাদের খাওয়ানো পর্যন্ত যায় না। প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহারের চেয়ে তরুণ সমাজের বড় একটি অংশ মেতে থাকছে নেতিবাচক বিষয়গুলো নিয়ে। অনলাইনে জুয়ায় সক্রিয় থাকছে অনেকেই। কিশোর গ্যাংগুলো সংঘবদ্ধ হচ্ছে অপরাধমূলক কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে। এ নিয়ে খুন– খারাবিও হচ্ছে হরহামেশা।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, মাঠের অভাবে খেলাধুলার সুযোগ বঞ্চিত হয়ে শিশু–কিশোর–তরুণরা মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ায় তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। খেলাধুলা শুধু নয়। সাংস্কৃতিক চর্চাও এখন আর তেমন হয় না বলে অপসংস্কৃতি ঢালপালা বিস্তার করছে। আগে গ্রামে–গঞ্জে শীত মৌসুমে স্কুল–কলেজে বার্ষিক নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি হত। পাড়ার ক্লাব– সমিতিগুলো খোলা জায়গা বা মাঠে এ ধরনের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালাত। সেসব এখন অতীত ইতিহাস। নগরে–বন্দরে, গ্রাম– গ্রামান্তরে মাঠের অস্তিত্ব এখন আর নেই। যে যেভাবে পারে গিলে খাচ্ছে, দখল নিচ্ছে, মার্কেট বা বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরি করছে। অধিকাংশ স্কুলের মাঠও বেদখল হয়ে গেছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দ্বারা। সেখানে দোকান–পাঠ করে খেলাধুলার সুযোগ– সুবিধা নষ্ট করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগরে পান্থপথের কাছে তেঁতুলতলা নামে পরিচিত একটি মাঠকে বরাদ্দ করা হয়েছিল থানা ভবনের জন্য। সম্প্রতি সেই মাঠে থানার নির্মাণ কাজ শুরু করা হলে এলাকাবাসী প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে। প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে আটক হন উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সংগঠক সৈয়দা রত্না ও তার কিশোর পুত্র। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় বয়ে যেতে থাকলে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। মাঠ রক্ষায় এলাকাবাসীর আন্দোলনটি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসায় মাঠটিও রক্ষা পায়।
স্টেডিয়ামগুলোতে লিগ বা টুর্নামেন্টের খেলাধূলা ছাড়া অন্য সময় বন্ধ থাকে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন টুর্নামেন্ট যখন থাকে না সে সময় বন্ধ না রেখে যেন স্টেডিয়ামগুলো খোলা রাখা হয়। যাতে শিশু–কিশোররা সারাবছর সেখানে খেলাধুলা করার সুযোগ পায়। চট্টগ্রামে এখনও প্রধানমন্ত্রীর সে নির্দেশ প্রতিপালিত হয়নি। আশা করা যায় দ্রুত স্টেডিয়ামের দরজা উন্মুক্ত হবে সবার জন্য। চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়াম ৯০ দশকেও খেলাধূলায় মাতিয়ে রাখত শিশু– কিশোর– তরুণরা। এই মাঠ থেকেই জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড় হিসেবে উঠে এসেছেন মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, নুরুল আবেদীন নোবেল, ইকবাল খান, আকরাম খান, নাফিস ইকবাল খান, তামিম ইকবাল খান, আশীষ ভদ্র, নাজিম, আফতাবসহ অনেক খেলোয়াড়। সেই আউটার স্টেডিয়ামে খেলাধূলা নেই দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। সারাবছর এখানে মেলা–উৎসব লেগে থাকে। তা না হলে এটি ট্রাক টার্মিনাল হিসেবে বা যানবাহন চালানোর প্রশিক্ষণ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আউটার স্টেডিয়ামের উন্মুক্ত মাঠের অর্ধেক গিলে খেয়েছে সুইমিং পুল। ফ্লাড লাইটের দুটি টাওয়ার এবং মার্কেট বাকি মাঠকে করে তুলেছে খেলাধূলার অনুপযোগী। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ৮০‘র দশকেও স্টেডিয়ামের চারপাশে খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য আরও চারটি মাঠ ছিল। এর একটিতে অনেক আগে করা হয়েছে শিশুপার্ক নামের খাঁচা, পাশে হয়েছে সার্কিট হাউস। আলমাস সিনেমার সামনের মাঠটি এখন নির্মাণ সামগ্রী রাখার গোডাউন। অ্যাপোলো শপিং সেন্টার যেখানে সেটিও ছিল উন্মুক্ত খেলার মাঠ। চারপাশে রেলিং দিয়ে ঘেরা ছিল। পাড়ার শিশু–কিশোররা এখানে খেলত। ভিআইপি টাওয়ারের স্থানটি ছিল আম– কাঁঠাল– লিচু গাছে ভরপুর একটি বড় টিলা। নাম ছিল ‘মোল হিল’।
বাওয়া স্কুলের পাশের মাঠে আগে খেলাধূলা সুযোগ ছিল। এখন সেটিতে সারাবছর ধরে বিভিন্ন মেলা– উৎসব হয়। আগ্রাবাদ ডেবার পাড়ের মাঠে হয়েছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। জাম্বুরি মাঠের পশ্চিম পাশে শিশু পার্ক এবং মূল মাঠ হয়েছে আধুনিক পার্ক। সেখানে আর খেলাধূলার সুযোগ নেই। হালিশহর ওয়াপদা সংলগ্ন মাঠ এবং আবাহনী মাঠেও খেলাধূলার চেয়ে মেলা–উৎসব বেশি হচ্ছে। সাগরিকায় বিকেএসপিতে খেলার মাঠ আছে, তবে খেলার অনুপযুক্ত। জহুর আহমদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের পাশে বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার একটি মাঠ রয়েছে মহিলাদের খেলাধূলার জন্য। সেটি অনেক দূরে নির্জন স্থানে হওয়ায় মহিলা ক্রীড়াবিদরা সেখানে যেতে ভয় পায়। রেলওয়ে পলোগ্রাউন্ড এখন মেলার মাঠে পরিনত হয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের একটি বড় স্টেডিয়াম রয়েছে। সেটির ব্যবহারও সীমিত। চসিকের বাকলিয়া স্টেডিয়ামেও খেলাধূলা নেই।
স্কুল–কলেজের মাঠের মধ্যে এখন প্যারেড মাঠ থাকলেও নিরাপত্তার অভাবে অভিভাবকরা সেখানে বাচ্চাদের পাঠাতে ভয় পান। লালদিঘি মাঠটি মুসলিম হাইস্কুলের মাঠ। এখন সেখানে থেকেও খেলাধূলা নির্বাসিত। বাকলিয়া, নাসিরাবাদ সরকারি স্কুলে মাঠ আছে, তবে খেলার অনুপযোগী। ডিসি হিল চত্বর আগে সারাবছর ধরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মুখরিত থাকত। এখন সেখানে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উপর আরোপিত হয়েছে নিষেধাজ্ঞা।
আজকের প্রজন্মকে দোষ দেওয়া হচ্ছে তারা খেলাধূলা বিমুখ হয়ে মোবাইল, মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। কেন হচ্ছে তা চিহ্নিত করে প্রতিকারের উদ্যোগ নেই। পাড়ায়– মহল্লায় এখন কোনো মাঠ বা খোলা জায়গার অস্তিত্ব নেই যেখানে শিশু– কিশোররা খেলবে। এ কারণে তারা অসৎ সঙ্গে মিশে গোল্লায় যাচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ে যুক্ত হয়ে খুন–খারাবিসহ নানা অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। অনেক অভিভাবক তাদের সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে সে খবরও রাখেন না। যখন সন্তানের অধপতনের খবর পান তখন আর করার কিছু থাকে না। নগরীর চেরাগী পাহাড় মোড় আগে ছিল শিল্প–সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট লোকজন, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীর আড্ডাস্থল। পরিবেশ ছিল সুন্দর। সেই চেরাগীকে এখন নরকে পরিনত করা হয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে এখান থেকে পাততারি চুকিয়ে অন্যত্র অফিস– প্রতিষ্ঠান স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়েছেন অনেক সৃজনশীল প্রকাশক। এ বিষয়ে লেখালেখি কম হয়নি। কিন্তু এ নিয়ে ভাবার বা দেখার কোনো কর্তৃপক্ষ নগরীতে আছে বলে মনে হয় না। সম্প্রতি চেরাগীতে কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধে এক কিশোর খুন হলে পুলিশ কিছুদিন তৎপর ছিল বলে পরিবেশটা ক‘দিন সুস্থ ছিল। এখন আবার সেই একই রূপে ফিরেছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর নির্বাচনি প্রতিশ্রুতির অন্যতম ছিল প্রত্যেক ওয়ার্ডে খেলার মাঠ করার। কয়েকদিন আগে একটি অনুষ্ঠান শেষে নাস্তার টেবিলে বসে মেয়রের সাথে আলাপ হচ্ছিল নানা বিষয় নিয়ে। উঠে আসে ঢাকায় তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষায় স্থানীয় বাসিন্দাদের আন্দোলন প্রসঙ্গ। চট্টগ্রামে শিশু–কিশোররা এখন রাস্তাঘাটেও খেলার সুযোগ পায় না। মাঠ নেই নগরী সিংহভাগ ওয়ার্ডে। এই যদি হয় অবস্থা তাহলে শিশু– কিশোররা যাবে কোথায়? মেয়র আশার বানী শুনিয়ে বললেন, নগরীর ৪১ ওয়ার্ডে খেলার মাঠ তৈরির বিষয়ে চসিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। দ্রততম সময়ে মাঠ তৈরির কাজটি তিনি শেষ করতে চান। আমরাও প্রত্যাশা করি মেয়রের এই আশাবাদ যেন বাস্তবে নগরবাসী দেখতে পান। নির্বাচনি এই প্রতিশ্রুতি পূরনে তিনি যেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। মোবাইল আসক্তি, মাদক ও গ্যাং থেকে রক্ষা করতে শিশু– কিশোরদের মাঠে ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার কোন বিকল্প নেই।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
.












