নিরেট মাটিতে শিল্প ফুটিয়ে তোলে তৈরি হয় ফুলের টব, নানা পাত্র আর হাঁড়িকুড়ি। একসময় এই শিল্পে জড়িতরা এসব তৈরি করে ভালভাবেই জীবিকা চালিয়ে নিতে পারতেন। এখন কালের পরিক্রমায় হারাতে বসেছে এই শিল্প এবং এর কারিগররা। তবে বাপ-দাদার এই শিল্প এখনও আঁকড়ে রয়েছেন রাঙ্গুনিয়া উপজেলার লালানগর ইউনিয়নের ইসলামিয়া পাড়ার অন্তত অর্ধশত কুমার পরিবার। এলাকার অনেকেই এই শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভিন্ন পেশা বেঁচে নিলেও শত অভাবেও এই নিয়ে পথ চলছেন এসব পরিবারের সদস্যরা।
সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, একসময় উপজেলায় অন্তত ১০টি কুমার পল্লীতে তৈরি হতো মাটির তৈরি তৈজসপত্র। মূলত কোভিড পরিস্থিতির শুরুর পর থেকে অন্যান্য এলাকার মতো চূড়ান্তভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে এই পাড়ার মৃৎশিল্প (কুমার শিল্প)। কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং চাহিদা না থাকায় অনেক পরিবার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে এই শিল্প থেকে। অথচ এক সময় কুমার শিল্পে প্রসিদ্ধ ছিল এই এলাকা। দূরদুরান্ত থেকে অনেকে এসে মাটির তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র পাইকারি ও খুচরা দামে কিনে নিয়ে যেতো। কিন্তু এখন পার্বত্য এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ী ছাড়া কেউ আর আসেন না। যারা আসেন তারাও নাম মাত্র দামে কিনে নিয়ে যায় জিনিসগুলো।
কথা হয় এই পেশায় দীর্ঘদিন ধরে নিয়োজিত হাজেরা বেগমের (৫০) সাথে। এই মৃৎ শিল্পী বলেন, কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। আমরা আগে এক ট্রলি মাটি কিনতাম ২০০ টাকা দিয়ে। এখন কিনতে হয় ২৫০-৩০০টাকা দিয়ে। এটা ছাড়াও বাজারে তেমন চাহিদাও নেই। তাই কাস্টমারও তেমন আসে না। আমরা কাঁচা বানিয়ে প্রতি পিছ ব্যাংক, ঢাকনা তিন টাকা দামে বিক্রি করি। এই টাকায় আমাদের খরচও ওঠে না। তারপরও বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে ধরে আছি।
মো. সেলিম নামে আরেকজন জানান, আমি মূলত কাঁচা অবস্থায় তৈজসপত্র কিনে পুড়িয়ে পাইকারি দামে বিক্রি করি। ৩ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে এই শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছি এখন। অল্প পরিমাণ লাভ হলেও প্রতি সপ্তাহে ৭ হাজার টাকা কিস্তি দিয়ে দিতে হয়।
রমিজ উদ্দিন নামে অন্য একজন বলেন, আমাদের অনেকেই এখন ভিন্ন পেশায়। যারা জড়িত রয়েছেন তাদেরও চুষে খাচ্ছেন মাঝিরা। তারা বিভিন্ন বাজার থেকে অর্ডার নিয়ে এসে আমাদের খুচরাভাবে কন্ট্রাকে বানানোর জন্য দিয়ে দেয়। তারা আমাদের অল্প টাকা পারিশ্রমিক দিয়ে তৈরি তৈজসপত্র কাঁচা অবস্থায় কিনে নিজেরা পুড়িয়ে ভাল দামে বিক্রি করে। আমরাও অসহায় তাদের কাছে।
জায়তুন নূর বেগম নামে এক নারী বলেন, বাজারে চাহিদা কমে এলেও আমরা এই শিল্পের সাথে জড়িত। সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা থেকেও তুলনামূলক ভাবে বঞ্চিত আমাদের এই পল্লীর বাসিন্দারা।
এই ব্যাপারে স্থানীয় ইউপি সদস্য আমির হোসেন সুমন বলেন, শত অভাবেও তারা যেভাবে বাপ-দাদার পেশা আকড়ে আছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমরা ইসলামীয়া পাড়ার কুমার শিল্পীদের সাহায্যে সবসময় তৎপর। আগে সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হলেও আমি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করি।
জানা যায়, একসময় রাঙ্গুনিয়ার অন্তত ১০টি কুমার পল্লীতে মাটির তৈরি নানা তৈজসপত্র বানানো হতো। তা সারা দেশে সরবরাহ হতো রাঙ্গুনিয়া থেকে। কিন্তু বর্তমানে ধাতব তৈজসপত্র বাজারে সহজলভ্য হওয়ায় মাটির তৈজসপত্রের চাহিদা কমে গেছে। এই শিল্পের সাথে জড়িতরাও পেশা পরিবর্তন করে ভিন্ন পেশায় চলে যাচ্ছে। তাই কালের প্রবর্তনে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে সে মৃৎশিল্প।