কয়দিন আগের কথা? দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুই টেস্টের দুই ইনিংসে শতরানের নিচে অল আউট হয়ে লজ্জার ষোলকলা পূরণ করে এসেছিল বাংলাদেশ দল। তাই বলে শ্রীলংকার মত দলের বিপক্ষে তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে? ঢাকা টেস্টের প্রথম দিনের প্রথম এক ঘণ্টায় বাংলাদেশ যেন সে পথেই হাঁটছিল। যে দলটি চট্টগ্রামের রানের বন্যা বইয়ে দিয়েছে সেই দলটিই কিনা শ্রীলংকার বোলারদের বিপক্ষে ঢাকা টেস্টের প্রথম দিনে ২৪ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বসল! আরো একটি লজ্জার পথে যেন হাঁটছিল বাংলাদেশ। কিন্তু তখনই হাল ধরেন লিটন এবং মুশফিক।
২৫ কিংবা এর নিচে ৫ উইকেট হারানোর পর ষষ্ঠ উইকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ছিল ঢাকাতেই। বর্তমানের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের ওয়ালিস মাথিয়াস ও সুজাউদ্দিন গড়েছিলেন ৮৬ রানের জুটি। ২২ রানে দল পঞ্চম উইকেট হারানোর পর জুটি গড়েছিলেন তারা।
এমন বাজে শুরুর পর ষষ্ঠ উইকেটে এর আগে কখনও ২০ পার করতে পারেনি বাংলাদেশ। কদিন আগে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ডারবান টেস্টে দল ১৬ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর নাজমুল হোসেন শান্ত ও ইয়াসির আলি চৌধুরি যোগ করতে পারেন কেবল ১০ রান। ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডজের বিপক্ষে অ্যান্টিগা টেস্টে ১৮ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর নুরুল হাসান সোহানের সঙ্গে লিটন যোগ করেছিলেন ১৬ রান।
গতকাল দলের টপ অর্ডারের পাঁচ ব্যাটার রান করেছেন ১৭। তিনজন ফিরেছেন রানের খাতা খোলার আগেই। এই পাঁচ ব্যাটার খেলেছেন মাত্র ৩৭ বল। এমন বিভীষিকাময় পরিস্থিতি আর ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে রান করা কিংবা দলের ইনিংসকে বড় করা কতটা কঠিন সেটা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু লিটন এবং মুশফিক মিলে বদলে দিলেন ইতিহাস। গড়ে ফেললেন বিশ্বরেকর্ড। দলকে নিয়ে গেলেন পাহাড় চূড়ার কাছাকাছি। এবার হিমালয়ের চূড়ায় উঠার অপেক্ষা। লিটন-মুশফিক নামের যে সিড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে বাংলাদেশ তাতে শেষ সীমানাটা আকাশের কাছাকছি হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ ২৪ রানে ৫ উইকেট হারানো দলটাকে যে এই দুই ব্যাটার নিয়ে গেছেন ২৭৭ রানে। মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের শুরুটা হয়েছিল মোমিনুলের টস জয় দিয়ে। যেহেতু চতুর্থ ইনিসে ব্যাট করতে না হয় সেজন্য আগে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিলেন টাইগার দলপতি। কিন্তু কে জানতো তার এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতি সিদ্ধান্তে পরিণত হবে। ইনিংসের প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলেই বোল্ড হয়ে ফিরলেন মাহমুদুল হাসান জয়।
পরের ওভারের চতুর্থ বলে ফিরলেন আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান তামিম ইকবাল। দুই ওপেনারের ব্যাট থেকে আসেনি কোনো রান। নাজমুল হোসেন শান্ত এবং অধিনায়ক মোমিনুল স্থায়ী ছিলেন ২১ বল। ৯ বলে ৯ রান করে ফিরলেন মোমিনুল। পরের ওভারে শান্ত ফিরেছেন ৮ রান করে। তিনি খেলেছেন সবচাইতে বেশি বল। ২১ বল মোকাবেলা করেছেন এই টপ অর্ডার ব্যাটার। ২৪ রানে ৪ উইকেট নেই বাংলাদেশের। উইকেটে তখন দুই অভিজ্ঞ সাকিব এবং মুশফিক। কিন্তু এক বল খেললেন সাকিব। ফিরলেন রানের খাতা খোলার আগেই।
দলের এমন অন্ধকার অবস্থায় আশার আলো হয়ে মিটিমিটি করে বাতি জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা করেন লিটন এবং মুশফিক। প্রতিটা ওভারকে যেন নতুন ভোর মনে করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন এ দুজন। এক একটা ওভার, এক একটা ঘণ্টা কিংবা এক একটা সেশন এভাবেই যেন এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলে। প্রথম সেশনটা কাটালেন দুজন ৬৬ রান করে। এরপরের দুই ঘণ্টাও পার করে দিলেন। আর এই সময়ে রান তুললেন ৮৭। ১৫৩ রান নিয়ে যখন চা বিরতিতে যান এ দুই ব্যাটার তখন লিটনের নামের পাশে ৭২ আর মুশফিকের নামের পাশে ৬২ রান। ভয় কাটিয়ে ততক্ষণে সাহস সঞ্চার করতে শুরু করেছে দুজন। ধ্বংসস্তূপ থেকে দলকে অনেকটাই নিরাপদ জায়গা নিয়ে গেছেন। চা বিরতির পর দিনের শেষ সেশনটা যেন আবার নতুন করে শুরু করলেন লিটন-মুশফিক। এবার ব্যাকফুট থেকে যেন ফ্রন্টফুটে এই দুই টাইগার ব্যাটার। এই সেশনে দুজন মিলে রান তুলেছেন ৩২ ওভারে ১২৪। আর বাংলাদেশ যেন অন্ধার পেরিয়ে আলোর পথে। শাসনের যাতাকল থেকে মুক্ত হয়ে যেন শাসকের ভূমিকায়।
লিটন এবং মুশফিক দুজনই তুলে নিয়েছেন সেঞ্চুরি। মুশফিক তার ক্যারিয়ারের নবম এবং লিটন তুলে নেন তৃতীয় সেঞ্চুরি। শুধু তাই নয় লিটন খেলেছেন তার ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। যা আরো বাড়তে পারে আজ। আর মুশফিক তুলে নিয়েছেন ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি। মুশফিক ২৫২ বলে অপরাজিত আছেন ১১৫ রান করে। যেখানে চার মেরেছিন ১৩টি। আর লিটন অপরাজিত আছেন ২২১ বলে ১৩৫ রান করে। যেখানে তিনি ১৬টি চার এবং একটি ছক্কা মেরেছেন। ষষ্ট উইকেটে এ দুজন যোগ করেছেন ২৫৩ রান। যে ২৪ রানে ৫ উইকেট পতনের পর বিশ্ব রেকর্ড। সকালের লংকান ঝড়ের পর দিনের বাকি সময়টা লিটন এবং মুশফিক যেভাবে শাসন করেছেন তাতে আজ আরো বেশি কিছুর আশা এই দুই ব্যাটারের উপর। এখন দেখার বিষয় কতদূর যায় বাংলাদেশের ইনিংস। আর কতদূরই বা যান লিটন-মুশফিক।