চা বাগানের কথা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে সিলেট অঞ্চলের চিত্র। অথচ বাংলাদেশ ভুখণ্ডে প্রথম চা উৎপাদন শুরু হয় চট্টগ্রামে। ব্রিটিশ আমলে ১৮৪০ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চট্টগ্রাম ক্লাব ও আশে পাশের পাহাড়ি এলাকায় ‘পাইওনিয়ার’ চা বাগানে প্রথম চা চারা রোপন করা হয়। এর তিন বছর পর ১৮৪৩ সালে চা পাতা সংগ্রহ করে চা বানানো হয়। তৎকালীন কালেক্টর স্কোনস আসাম হতে চায়ের বীজ ও কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেন হতে তিনটি চায়না চারা এনে এই বাগানে রোপন করেছিলেন। যা থেকে পরবর্তীতে চা উৎপাদিত হয়। তবে ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশ অংশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রথম চা চাষ ও সমপ্রসারণ শুরু হয় সিলেট অঞ্চলে। ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে সিলেট অঞ্চলে চা বাগানের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। বর্তমানে দেশে ১৬৭টি চা বাগানের মধ্যে ১৩৫টিই বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে অবস্থিত। চট্টগ্রামে রয়েছে ২১টি, বাকীগুলো উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায়। একসময় চা ছিল অভিজাতদের পানীয়। এই উপমহাদেশে চা চাষের শুরুতেও একই অবস্থা ছিল। প্রায় ১৫০ বছর আগে ইংরেজ বনিকেরা সাধারণ মানুষের মুখে চা তুলে দেন। প্রথম প্রথম তারা বিনামূল্যে চা পান করান। অল্প দিনের মধ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে চায়ের নেশা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বর্তমানে চা দিয়ে দিন শুরু হয় না, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। ফুটপাতের টং দোকান হতে শুরু করে পাঁচ তারকা হোটেল, কুঁড়েঘর থেকে বংগভবন বা শহর থেকে গ্রাম অথবা দুর্গম এলাকা সব জায়গায় এই সস্তা পানীয় পাওয়া যায়। শুধু সকাল নয়, দুপুর বিকেল বা রাতেও চায়ের কদর সমান। তবে চায়ের নেশা গতি পায় গত দুই দশকে। ২০০১ সালে একজন মানুষ বছরে গড়ে ১১৩ কাপ চা পান করতেন। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় গড়ে ২২৯ কাপে। চা বোর্ডের হিসাবে দেশে প্রতি বছর চায়ের চাহিদা বাড়ছে ৫.২৫ শতাংশ হারে। বিশ্বে বর্তমানে চা পানে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। শীর্ষস্থান অনেক দিন ধরেই তুরস্কের দখলে। তুরস্কে এক জন মানুষ বছরে ১,২০০ কাপ চা পান করে। এরপরের অবস্থানে আছে লিবিয়া, মরক্কো, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও হংকং। তবে জনসংখ্যার কারণে দেশ ভিত্তিক মোট চা পানের শীর্ষস্থানে রয়েছে চীন। তারা বছরে ২০০ কোটি কেজি চাপাতার চা পান করে। ভারতের মানুষ পান করে ১০৩ কোটি কেজি চাপাতার চা। চা বোর্ডের হিসাবে ২০১৯ সালে দেশে সর্বোচ্চ চা উৎপাদন হয় ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি, এর মধ্যে সম্ভাব্য ৯ কোটি ৫২ লাখ কেজি চাপাতা ব্যবহৃত হয় দেশে। যা দিয়ে ৩,৮০৮ কোটি কাপ চা তৈরী করা হয় এবং দিনে ১০ কোটি ৪৩ লাখ কাপ চা পান করে এদেশের মানুষ। অথচ ২০০৯ সালে দেশে চায়ের উৎপাদন ছিলো প্রায় ৬ কোটি কেজি। পরের বছর অর্থাৎ ২০১০ সালেও উৎপাদন ছিলো ৬ কোটি কেজি। দিন দিন চাহিদা বাড়তে থাকায় ব্যবসায়ীরা চা আমদানি শুরু করে। সেই বছরই আমদানি করা হয় ৪৩ লাখ কেজি চা। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন না বাড়ায় ২০১৫ সালে আমদানি কোটি কেজি ছাড়িয়ে যায়। অপর দিকে চায়ের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দেশের বড় ১৮ টি শিল্প গ্রুপ যুক্ত হয় চা চাষে। আমদানি নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে চা বোর্ডও নানামুখী পদক্ষেপ নেয়। চা চাষের আওতা বাড়াতে নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেয়। একই সঙ্গে নতুন নতুন জেলায় চা চাষ সমপ্রসারণেও মনোযোগী হয় চা বোর্ড। এর সুফলও পাওয়া যায়। ২০০৯ সালে যেখানে উৎপাদন ছিলো ৬ কোটি কেজি, ২০১৯ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি। আবার এক সময় যেখানে চাহিদা মেটাতে কোটি কেজি চা আমদানি করতে হতো, ২০২০ সালে তা নেমে আসে ৬ লাখ কেজিতে। চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ সালে দেশে চা চাষের এলাকা ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ৬৪২ একর এবং একর প্রতি উৎপাদন ছিলো ৫০১ কেজি। ২০২০ সালে চা চাষের এলাকা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার একর ও একর প্রতি উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৬০০ কেজি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সমতল ভুমির চার জেলার (ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট) চা উৎপাদন। ২০২০ সালে এই চার জেলায় উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৩ লাখ কেজি চা। যার আবাদি এলাকা হলো ১০ হাজার ১৭০ একর। এখন দেশে মোট উৎপাদিত চায়ের ১২% আসে উত্তরাঞ্চল হতে, যা এক যুগ আগে ছিলো ১% এর কম। বর্তমানে দেশে চায়ের বাজার ৪ হাজার কোটি টাকার ও এখাতে শ্রমিকের সংখ্যা ১ লাখ ৪০ হাজার। এদিকে উৎপাদন বাড়তে থাকায় বড় পাঁচটি শিল্প গ্রুপ আবার চা রপ্তানি করছে। চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী চায়ের বাজারে শীর্ষস্থানে থাকা ইস্পাহানি গ্রুপের পাঁচটি ব্রান্ড, কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেটের আন্তর্জাতিক ব্রান্ড ‘টিটুলীয়া অর্গানিক’, আবুল খায়ের গ্রুপের ‘সিলন টি’, ওরিয়ন গ্রুপের ‘ওরিয়ন টি’ এবং এসিআই বাংলাদেশের ‘টেটলি টি’ ব্রান্ডের নামে চা রপ্তানি করছে। এসব ব্রান্ডের চা রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন যেমন বেশি হয়, তেমনি বিদেশে দেশের সুনামও বৃদ্ধি পায়। ২০২০ সালে এই সব ব্রান্ডের চা রপ্তানি করা হয় ২১ লাখ ৭০ হাজার কেজি।
বাগান থেকে কাপ পর্যন্ত পৌঁছাতে চায়ের পাতাকে নানান পথ অতিক্রম করতে হয়। চা পাতায় প্রথমে থাকে শ্রমিকের হাতের ছোঁয়া। প্রতি কাপ চা (২ গ্রাম) এর জন্য ১১ গ্রাম সবুজ পাতার কুড়ি তুলতে হয়। সবুজ কুড়ি তোলার পর তা বস্তায় ভরে কারখানায় নেওয়া হয়। কারখানায় নিয়ে চলন্ত বেল্টের উপর সবুজ পাতাকে ছড়িয়ে দেয়া হয়। সবুজ পাতায় থাকে ৭৬% পানি তাই প্রথম ধাপে হালকা বাতাস আর দ্বিতীয় ধাপে দূর হতে গ্যাস বার্নারের তাপে পাতা হতে পানি শোষণ করা হয়। এই প্রক্রিয়াকে ‘উইদারিং’ বলে। এতে সময় লাগে ১২-১৮ ঘণ্টা। এভাবে প্রায় ২০% পানি ছাড়িয়ে নেওয়া হয় যাতে সেই সবুজ সতেজ পাতা মলিন হয়ে যায়। এরপর সেই মলিন পাতা আরেকটি চলন্ত বেল্টের মাধ্যমে চলে যায় কারখানার দ্বিতীয় ধাপ ‘রোটর ভ্যান’ যন্ত্রে। সেখানে মলিন পাতাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করে কাটা হয়। এরপর তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যায় ঘূর্ণায়মান লোহার দাঁতযুক্ত যন্ত্রে। কারখানার পরিভাষায় এই যন্ত্রের নাম ‘সিটিসি’। ছোট করে কাটা পাতাকে এখানে চার দফায় চূর্ণবিচূর্ণ(পিষা) করা হয়। পিষে ফেলার পর সবুজের টুকরাগুলো চলে যায় ঘুরতে থাকা গোলাকার পাইপের মত ‘গুগি’ যন্ত্রে। এখানেই চূর্ণবিচূর্ণ পাতাগুলো ছোট ছোট বলের আকার ধারণ করে। গুগি থেকে বড় ট্রেতে আসার পর শুরু হয় জারণ প্রক্রিয়া। চায়ের রূপ পরিবর্তনের পালা শুরু হয় এই ধাপে। একে বলা হয় ‘ফারমেন্টেশন’।এখানে বাতাসের সাহায্যে দুই ঘণ্টা ধরে জারণের ফলে সবুজ দানাদার চা তামাটে রং ধারণ করে। পরের ধাপে বার্নারের তাপে চা দানা হতে জলীয় অংশ শুকিয়ে নেওয়া হয়। এরপরেই বের হয়ে আসে কালো চায়ের দানা। এরপর ঐ চায়ের দানাকে স্বয়ংক্রিয় চালনিতে নেওয়া হয়। চালনির নীচে থাকা বস্তায় আলাদাভাবে পড়তে থাকে বড়, মাঝারি ও মিহি দানার চা। এই চায়ে পানি থাকে ২.৫%-৩% যা শুরুতে ছিলো ৭৬%। যন্ত্রভেদে ১৫-২০ ঘণ্টায় সবুজ পাতা হতে কালো চায়ে রূপান্তরিত হয় এবং প্রতি ১০০ কেজি পাতায় প্রায় ২৩.৫০ কেজি চা পাওয়া যায়।
একসময় বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানী পণ্য ছিলো চা চামড়া ও পাট। কালের বিবর্তনে ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় চামড়া ও পাট তার নিজস্ব জৌলুস হারিয়েছে এবং এই শিল্পগুলি বর্তমানে মৃতপ্রায়। তবে আশার কথা হলো চা তার পুরানো ঐতিহ্য এখনো অটুট রেখে দেশের অর্থনীতি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বীরদর্পে এগিয়ে চলছে, যা জাতি হিসাবে গর্বের বিষয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট










