মাত্র দুই দশক আগেও কক্সবাজার শহরসহ জেলাব্যাপী সর্বোচ্চ ৬০ ফুট গভীরে নলকূপ বসিয়ে স্বচ্ছ পানীয় জল পাওয়া যেত। আর এখন ৩৬০ ফুট গভীরে বসানো নলকূপ থেকেও পানি উঠছে না। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় কক্সবাজার শহরে শত শত নলকূপ বিকল হয়ে গিয়েছে। নলকূপ বসাতে হচ্ছে প্রায় ৪শ ফুট গভীরে। পানি নিয়ে এমন পরিস্থিতিতেই বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে আজ মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস।
পানিকে সমস্ত প্রকৃতির চালিকাশক্তি বলা হয়। সকল জীবন্ত প্রাণি ও উদ্ভিদের জন্য জ্বালানী হিসাবে বিবেচিত পানি। কিন্তু জাতিসংঘের হিসাব মতে, বর্তমানে সারা বিশ্বের অন্তত ২শ কোটি মানুষ নিরাপদ পানীয় জলের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি-২০৩০ অর্জনের জন্য বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো সবার জন্য নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা বাস্তবায়ন করছে। ১৯৯৩ সাল থেকে চালু হওয়া বিশ্ব পানি দিবসের একটি উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে পানি বিষয়ে আরো সচেতন করে তোলার মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান করা। এবারের বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- ‘ভূ-গর্ভস্থ পানি অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করে’।
কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ার বাসিন্দা মোতাহার হোসেন বাবুল জানান, শহরের টেকপাড়ায় মাত্র ১৫ থেকে ২০ বছর আগেও ৬০ ফুট গভীরতায় নলকূপ বসিয়ে সারা বছর পানি পাওয়া গেছে। কিন্তু গত এক-দেড় দশক ধরে কঙবাজার শহরের পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ায় গত ৪ বছর আগে তার বাড়িতে ৩৬০ ফুট গভীরতায় নলকূপ স্থাপন করেন। কিন্তু কয়েকদিন আগে সেই নলকূপটিও অকেজো হয়ে যাওয়ায় এখন ৩৮০ ফুট গভীরতায় নতুন একটি নলকূপ বসাচ্ছেন তিনি।
শহরের উত্তর রুমালিয়ার বাসিন্দা রেজাউল করিম রেজাও পানি নিয়ে একই সমস্যার কথা জানান। তিনি বলেন, মাত্র গত কয়েক বছর আগে বাড়িতে ৩৬০ ফুট গভীরতায় একটি নলকূপ বসিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে আজ (গতকাল সোমবার) দুপুর থেকে সেই নলকূপটি থেকে আর পানি ওঠছে না। নলকূপ মিস্ত্রি জানালেন, পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এখন আরো গভীরে নলকূপ বসাতে হবে।
শহরের এন্ডাসন রোডের বাসিন্দা মাহবুবুল আলম জানান, তার বাড়িতে আগের নলকূপে পানি না ওঠায় মাত্র ২ বছর আগে ৩৮০ ফুট গভীরতায় নতুন নলকূপ বসিয়েছিলেন। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে সেই নলকূপটি থেকে এখন লবণাক্ত পানি ওঠে আসছে। ফলে মাত্র দুই বছরের মাথায় আরো গভীরতায় নতুন একটি নলকূপ বসাতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এদিকে কঙবাজার শহরের সমুদ্র তীরবর্তী হোটেল-মোটেল জোনে এখনও ৩শ ফুট গভীরতায় স্বচ্ছ পানি পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান কঙবাজার হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার। কলাতলী হোটেল-মোটেল জোনের মতোই জেলার বাইরে চকরিয়া পৌর এলাকাতেও প্রায় ৩শ ফুট গভীরতায় স্বচ্ছ পানি পাওয়া যায়। তবে সেচপাম্পের জন্য কমপক্ষে ৩৬০ ফুট গভীরতায় নলকূপ বসাতে হয়। উপজেলার কিছু এলাকার অবস্থা এর চেয়ে শোচনীয়। আর কিছু এলাকার অবস্থা একটু ভাল।
তবে জেলা সদরের চেয়ে শোচনীয় অবস্থা উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এখানে ভূ-গর্ভস্থ পানি এত দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে যে, প্রতিবছরই হাজার হাজার নলকূপ বিকল হয়ে যাচ্ছে।
উখিয়ার রাজাপালং ইউপির কুতুপালং ওয়ার্ড মেম্বার হেলালউদ্দিন জানান, মাত্র ৫ বছর আগেও কুতুপালং-বালুখালীসহ পুরো উখিয়া-টেকনাফজুড়ে ৫০ থেকে ৮০ ফুটের মধ্যে নলকূপ বসিয়ে পানি পাওয়া যেত। বর্তমানে পানির জন্য ৭শ থেকে ৮শ ফুট গভীরে নলকূপ বসাতে হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্র মতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অন্তত ১০ হাজার নলকূপ থেকে দৈনিক প্রায় ৩ কোটি লিটার পানি তোলা হচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ উৎস হতে। আর জেলা সদরের হোটেল-মোটেল জোনের প্রায় ৫শ হোটেলে উত্তোলন করা হচ্ছে অন্তত ১ কোটি লিটার ভূ-গর্ভস্থ পানি। ভূ-গর্ভস্থ উৎস হতে এভাবে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে ভূ-গর্ভস্থ মিঠা পানির মজুদে লবণাক্ত পানি মিশে যাচ্ছে। এমনকি পানীয় জলে ইউরেনিয়াম-থোরিয়ামের মতো ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় পদার্থের অস্তিত্বও ধরা পড়ছে। প্রায় তিন বছর আগে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের একটি গবেষণায় কঙবাজারের ভূ-গর্ভস্থ মিষ্টি পানির মজুদ নিয়ে এমন ভয়ংকর তথ্যই ওঠে আসে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকী বলেন, গত তিন দশকে কঙবাজারে ভূমির ব্যবহারে ব্যাপকমাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। এতে ভূ-গর্ভস্থ পানীয় জলের জলাধারের উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর ব্যাপকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে, ভূ-গর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ত ও ইউরেনিয়াম-থোরিয়ামের মতো ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি সহনীয় মাত্রায় চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে যাচ্ছে। তিনি ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কঙবাজার শহরে মিঠাপানির জলাশয় গড়ে তোলার এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির পরিবর্তে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দেন।
ভূগর্ভস্থ পানীয় জল একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। সারা বিশ্বের প্রায় অর্ধেক পানীয় জলই আসে ভূ-গর্ভস্থ মজুদ থেকে। ভূগর্ভস্থ পানির অন্বেষণ, সুরক্ষা এবং টেকসই ব্যবহার করাই হল এ বছরের বিশ্ব পানি দিবসের উদ্দেশ্য।










