গেল বৈশাখের শেষের এক দিবসে আকাশ থেকে আগুন ঝরছে। থম মেরে আছে গাছের পাতারা। পাতা আর কোথায় ? এ-তল্লাটে কোন গাছই নেই বলা যায়। এককালে ছিল অনেক পাহাড়-জঙ্গল-গাছপালা। এখন যতদূর চোখ যায় আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকা। সারি-সারি দাঁড়িয়ে। অদূরে ইস্পাত কারখানা। দিনরাত আগুন জ্বলে সেখানে। লোহা গলানো বিষাক্ত ধোঁয়ায় ছেয়ে থাকে চারপাশ। নীল হারিয়ে গেছে আকাশ থেকে। কালচে ধূসর রঙের মেঘ ভেসে ভেড়ায় দিগন্তজুড়ে। সবমিলিয়ে দিনের তাপমাত্রা বেড়ে যায় লাফিয়ে লাফিয়ে। রাতেরবেলায় ঘরের বাইরে গরমের তীব্রতা একটু কমলেও ঘরের ভেতরে তা যেন আরও জেঁকে বসে থাকে। আবাস যদি হয় পাকা দালানের সর্বোচ্চ চূড়ায়, একেবারে ছাদের নিচে, তাহলে আর রক্ষা নাই। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের জন্য যন্ত্র বসানো গেলে হয়তো শান্তিতে একটা ঘুম দেওয়া যাবে। কিন্তু সেই যন্ত্রটা না জোড়াতে পারলে ‘আল্লাহ মেঘ দে’ ছাড়া আর কোন পথ নেই।
আল্লাহ সত্যিই দয়াময়। মেঘ পাঠিয়ে দেন বৈশাখের সেই রাতে। আকাশ বাতাস পৃথিবী কাঁপিয়ে গর্জন করে ওঠে সেই মেঘ। সঙ্গে করে নিয়ে আসে হিমশীতল বারিধারা। মুহূর্তেই শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় ইট পাথরের অট্টালিকার অভ্যন্তরে। অনেকদিন পর আরামের একটা ঘুম দেওয়া যাবে। পাখাদের ছুটি মিলেছে। শেষ রাতের দিকে কাঁথা মুড়ি দিতে হবে মনে হচ্ছে। অনেক আয়োজন করে বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়া মাত্রই গভীর ঘুমের দেশে। মাঝরাত্তির পার হবার আগেই ঘুম টুটে যায় অতিকায় ট্রাকের ঘ-র-র ঘ-র-র আওয়াজে। ট্রাকের গর্জন থেমে যায় একটু গাঁইগুই করে। মিনিট কয়েক পর শুরু হয় নতুন ধরনের শব্দ। মনে হচ্ছে পাথর-কঙ্কর জাতীয় কোন পদার্থ ঢালা হচ্ছে। ট্রাক থেকে মাটিতে। উপুড় করে একবারে ঢেলে ফেললে হয়তো মুহূর্তেই সম্পাদন হয়ে যায় ঢালাঢালির কাজ। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে এক এক হাতা নিয়ে কেউ আস্তে আস্তে কাজটা করছে। আরও মনে হচ্ছে একাজ পুরো রাত ব্যাপি চলবে।
শহরতলীর এই আবাসিক এলাকা অট্টালিকায় ছেয়ে গেলেও নির্মাণ কাজ এখনও চলছে। প্রতিদিন আকাশের দিকে মাথা তুলে গজিয়ে উঠছে নতুন নতুন ভবন। হাতুড়ি, বাটাল, ইট ভাঙ্গা, রড কাটা, আর টাইলস কাটার যন্ত্রসহ আরও অনেক কিছুর শব্দ সারাদিন চলে অবিরাম। রাতেও থামে না অনেক সময়। রাত গড়িয়ে ভোরও হয়ে যায় কোন কোন দিন। রাত এখানে ঘুমোয় না। এখানকার অধিবাসীদের অনেকে ঘুমোতে পারেন না রাতে। অনেকে অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে গেছেন ছন্দবিহীন এই শব্দতরঙ্গের সঙ্গে।
বৃষ্টিভেজা দুপুররাতে এমন আয়োজন করে পাওয়া ঘুমটা ছুটে গেলে কার না অশান্তি লাগে! নায়লারও তাই হলো। বিছানা ছেড়ে হালকা একটা চাদর জড়িয়ে বারান্দায় যায় সে। বৃষ্টির ছাঁট লাগছে হালকা করে। বেশ আরামবোধ হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিজলির ছটায় আলোয় ভরে উঠছে চারপাশ। ঘুম জড়িয়ে আসছে চোখে। মনে মনে অভিসম্পাত দেয় সে ট্রাক নামের জড় পদার্থটাকে। হাসিও পায় মনে মনে। ট্রাকের চাকায় ভর করেই চলে সমগ্র দেশের অর্থনীতির চাকা। আমরা সুবিধাভোগী নাগরিকরা তবু সুযোগ পেলে ট্রাককে গালি দিতে ছাড়ি না। এই মুহূর্তে নায়লার ঘুম হরণ করেছে। যখন-তখন ওরা প্রাণও হরণ করে। মহাসড়কে। তাইতো এতো খেটেও ভালোবাসা নয়, গালিই জোটে ওদের কপালে।
এমন সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নায়লা তাকায় নিচের দিকে, যেখানে ট্রাকটা ঠায় দাঁড়িয়ে। ট্রাকের পেছনের খোলা শরীরে দণ্ডায়মান কঙ্কালসার দুই ছায়ামূর্তি। শরীর ওদের ওঠানামা করছে যন্ত্রের মতো। দুই ছায়ামূর্তি মিলে কিছু একটা তুলছে ট্রাকের পেট থেকে, আর ঢালছে মাটিতে। শব্দটা আসছে ওখান থেকেই। বিদ্যুত চমকে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে দৃশ্যটা আরও পরিষ্কার হলো। পাথর কুচি বোঝাই ট্রাকের পেটের ওপর দাঁড়িয়ে দুইজন মানুষ। উদোম গা। ভেজা লুঙ্গি। হাতে শাবলের মতো কিছু একটা নিয়ে খালি করছেন সেই ট্রাক। বিজলি, বজ্রপাত, আর রাতভর অঝোর ধারায় ঝরতে থাকা বৃষ্টিতে কিছুই এসে যায় না এই দুই মানবসন্তানের। ওদের ঘুম লাগে না।
আর কীসের ঘুম! রাত ফুরিয়ে এলো বলে। ভোরের আযান ভেসে আসে কাছের দূরের অসংখ্য মসজিদ হতে। ওদের হাত এখনও চলছে। সমানতালে ওঠানামা করছে হাড্ডিসার দেহ। বৃষ্টি একটু ধরে আসে। পৃথিবীতে আলো ফুটছে একটু একটু করে। বারান্দা ছেড়ে ঘরে আসে নায়লা। নামাজদোয়া শেষে গৃহকর্মে মন দেয়। পরিবারের সকলের প্রাতঃরাশ, নাওয়াখাওয়া শেষে যে-যার কাজে বেরোতে হবে।
মন লাগে না কাজে। কালো-কালো ছায়ামূর্তি দুটিকে চোখের সামনে থেকে সরাতে পাওে না নায়লা। ভাত পুড়িয়ে ফেলে আকাশপাতাল ভাবতে গিয়ে; মাথপিছু আয় বৃদ্ধি আর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সূত্র ধরে আমার দেশের মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক সনদ লাভ করেছে। এই গৌরব কি সবার জন্য? বৃষ্টিভেজা সেই রাতে বিজলির আলোয় দেখা দুই শীর্ণ ছায়ামূর্তি। ওরাও কী এই গৌরবের অংশীদার?