দুই চাকায় বাদাবনের সমীপে

বাবর আলী | সোমবার , ২১ মার্চ, ২০২২ at ৯:২০ পূর্বাহ্ণ

(পর্ব-৭)

রাতের আশ্রয়স্থল ছিল নৌকা। রবি ঠাকুরের উপন্যাসের নাম অবলম্বনে আমাদের বড়জোর ‘নৌকাডুবি’ হতে পারতো! কিন্তু তা নয়, আমাদের হলো কিনা তাঁবুডুবি! আগের রাতে নদীর পাড় লাগোয়া বিশাল এক নৌকার উপরে আমাদের তাঁবুটা পিচ করেছিলাম। তাঁবু পিচ করার কোন উদ্দেশ্যই ছিল না। খোলা আকাশের নিচেই শুয়েছিলাম। শোয়ার কিছুক্ষণের মাঝেই মশার ভয়াবহ উৎপাতে টেকা দায়। অগত্যা তাঁবুর ভেতরে। মাঝরাতে হাওয়া উঠে এমন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো, তৎক্ষনাৎ নৌকার ছইয়ে আশ্রয় নিলাম। ব্যাকপ্যাকগুলো গুছিয়ে উপর থেকে তাঁবু নামানোর আগেই ঝড়ো হাওয়ায় তাঁবু নদীতে। তখন আর মাথা না ঘামিয়ে ব্যাপারটা সকালে দেখা যাবে- এই বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতেই খোলা জায়গায় কয়েল জ্বালিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম।
সামনে ধ্যানস্থ ভোরের সুন্দরবন। চোখ খুলতেই এই দৃশ্য মন ভালো করার জন্য যথেষ্ট। আকাশ এখনও কিছুটা মেঘলা। আমরা প্রাতঃকৃত্য সারতে সারতে ভাটার টানে ভেসে উঠা তাঁবুটা সানি উদ্ধার করে ফেলেছে। সেটা বাতাসে খানিক শুকিয়ে রওনা হয়ে গেলাম। আমরা তিনজন সাইকেলে আর রাবাত ভাই মোটরসাইকেলে। উদ্ধারকৃত তাঁবু আর ব্যাকপ্যাক রাবাত ভাইয়ের পীড়াপীড়িতে মোটরসাইকেলের পেছনে বাঁধা হলো। শাকবাড়িয়া নদীর পাশ ঘেঁষেই রাস্তা। ইটের সলিনের রাস্তার প্রথমদিকের অংশটুকু বেশ ভালোই। খানিকবাদেই স্থানে স্থানে রাস্তাকে ক্রমশ গ্রাস করেছে নদী। তার রাক্ষুসে গ্রাাস থেকে রাস্তাকে বাঁচাতে স্থানে স্থানে জিওব্যাগ দেয়া হয়েছে। হরিহরপুরের কাছে রাস্তা হয়েছে আরো সরু। আর রাস্তার দুই পাশে দুইটা নদ-নদী। একপাশে কপোতাক্ষ নদ, অন্যপাশে শাকবাড়ীয়া নদী। রাস্তার দুই ধারে গেওয়া গাছকে সাথে নিয়ে পথ চলতে বিন্দুমাত্র ক্লান্তি অনুভূত হচ্ছিল না। ইটের সলিনের উঁচু-নিচু রাস্তাটাও খুব একটা অসুবিধায় ফেলছে না।
তবে সুখ বেশিক্ষণ সইল না। মাটির রাস্তা শুরু হলো খানিক বাদে। মাটির সাথে কিছু জায়গায় বালি মেশানো। এমনই এক জায়গায় সাইকেলের ঘাড়ে চেপে পার হতে না পেরে সাইকেলকেই আমাদের ঘাড়ে উঠাতে হলো! আমরা কোনোরকমে পার পেলেও মোটরসাইকেল আরোহী রাবাত ভাইয়ের গর্দিশের আর শেষ রইল না। বহুকষ্টে পার হলেন এই ফাঁড়াটুকু। অসংখ্য পদ্মে ভরা এক পুকুরকে পেছনে ফেলে চলে এলাম কপোতাক্ষ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে। নদীবিধৌত এলাকায় স্কুল-কলেজের নামকরণ নদীর নামেই হবে, এটাই স্বাভাবিক। ফুলতলায় আসতেই বরণ করে নিল বৃষ্টি। জায়গার নামানুসারে অথচ বরণ করে নেয়ার কথা ফুল দিয়ে! ফুলতলায় ছোট্ট একটা চায়ের বিরতি নিয়ে দক্ষিণ বেদকাশী হয়ে ঘড়িলাল বাজারে। কপোতাক্ষ নদ পার হবার ঘাটটা বাজারের শেষদিকে। জনাদুয়েক লোককে জিজ্ঞেস করে ওইদিক পানে যেতেই বিপত্তি। গত রাতের বৃষ্টিতে মাটির রাস্তাটা আর সাইকেল চালানোর উপযোগী নেই। বগলে স্যান্ডেল আর হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেলবার ধরে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে খেয়াঘাটের দিকে চলা। বারদুয়েক কোনোরকম পপাত ধরণীতল হওয়া থেকে রক্ষা পেয়ে ঘাটে। নিজেরা সাইকেল নিয়ে পার হতে পারলেও রাবাত ভাইয়ের মোটরসাইকেল নিয়ে পার হবার ব্যাপারটা কল্পনা করতেই নিজেরা এক চোট হেসে নিলাম। খানিক পেছনে রাস্তা দেখে রাবাত ভাই দোয়া-দরুদ জপতে শুরু করেছেন। খেয়ার মাঝিসহ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বহু কষ্টে যান্ত্রিক সাইকেল তথা মোটরসাইকেলকে যান্ত্রিক ট্রলারে উঠানো হলো।
কপোতের ন্যায় অক্ষি যার, তাঁর নামই কপোতাক্ষ। যদিও অসময়ের বৃষ্টির কারণে নদীর পানি ছানি পড়া বৃদ্ধের চোখের মতোই ঘোলা। কপোতাক্ষের ওপারেই সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর। খেয়াঘাট থেকে রাস্তায় উঠার অল্প অংশটুকু এই পাড়েও ভয়াবহ। নানান কসরত করে রাস্তায় উঠে বুঝলাম, দুর্ভোগ শেষ হয়নি, শুরু হয়েছে মাত্র! মাটির রাস্তাটা সাইকেল চলাচলের উপযোগী নয় মোটেও। এলাকাবাসী কয়েকজন জানাল, সামনের দিকে কিলোমিটারখানেক গেলে সাইকেল চালানো যাবে। ওইদিকে রাস্তা মোটামুটি ভালোই। আবার কাদার সাগরে সাইকেল ঠেলার পালা। তানভীর ভাই বলে বসলেন, “সাইকেল চালাইতে আসলাম নাকি ঠেলতে আসলাম সেটাই বুঝতেছি না।” আমরা যেমন-তেমন করে তুলনামূলক শুকনো রাস্তায় উঠতেই পেছন থেকে এক লোক এসে জিজ্ঞেস করল, ঘড়িলাল বাজারে আমরা কোন ব্যাগ ফেলে এসেছি কিনা। আমরা নিজেদের ব্যাগপত্র দেখে নিয়ে নেতিবাচক উত্তর দিলাম। খানিকবাদে পার্শ্বেমারী ঘাট থেকে আসা অপর লোক একই কথা জিজ্ঞেস করলেন। ওপার থেকে খেয়াঘাটের মাঝি ফোন করে জানিয়েছেন, একটা কালো ব্যাগ আর হেলমেট আমাদের কেউই ওপারে ফেলে এসেছি। পেছনে থাকা রাবাত ভাইকে ফোন করতেই ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেল। মোটরসাইকেল ঠেলায় মনোযোগ দিতে গিয়ে ভুলে ব্যাগ আর হেলমেট ফেলে এসেছেন ভদ্রলোক।
বার্তাবাহকের কাছ থেকে মাঝির ফোন নাম্বার নিয়ে রাবাত ভাইকে দিয়ে দিলাম। রাবাত ভাই তখনো বেশ পেছনে। এইটুকু পথ ঠেলে আসতে আরো বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগবে। কপোতাক্ষের সামনে একটা চায়ের দোকানে বসতেই আমাদের ঘিরে কৌতূহলী জনতার ভিড় লেগে গেল। নানান প্রশ্নের ঝড়। পার্শ্বেমারী নামক এই জায়গায় কপোতাক্ষ নদীর ঠিক সামনেই একটা সুন্দর বেঞ্চি আছে। এলাকার কিশোরদের দখলে সেই বেঞ্চি। ওই জায়গায় বেশ হাওয়া। মিনিট দুয়েক বসলেই মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ‘জিমি’ নামক এক কুকরের সাথে ভাব হয়ে গেল বসে থাকতে থাকতেই। ইতিমধ্যে একজন চুল দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি গায়ক পথিক নবী কিনা! একটু রগড় করার ইচ্ছে থাকলেও পাছে গান গাওয়ার আবদার আসতে পারে, এই ভয়েই নেতিবাচক উত্তর দিলাম। খানিক বাদেই আরো একজন সাইকেল আরোহী ব্যাগ হারানোর কথা বলে গেল। ঘড়িলাল বাজারের মাঝির সততা দেখে অবাক হলাম। যে-ই এদিকে এসেছে, তাকেই ব্যাগ হারানোর কথা বলেছে। খুলনা অঞ্চলের লোকজনকে এইজন্যই আমার দারুণ পছন্দ।
রাবাত ভাই খানিক বাদেই এলেন কাদায় মাখামাখি হয়ে। কিলোমিটার খানেক পথ পাড়ি দিতে গিয়ে বারদুয়েক কাদায় আছাড় খেয়ে পড়েছেন ইতিমধ্যে! অবশ্য এর ফাঁকে মাঝি মারফত ব্যাগ ও হেলমেট হস্তগত করেছেন। এসেই বলতে শুরু করলেন, ‘এসেছিলাম আপনাদের একটু সাহায্য-সহযোগিতা করতে। উল্টো আমিই প্যারায় ফেলে দিলাম আপনাদের।’ আমরা এইসব বিনয়ী কথাবার্তা এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে আবার চলতে শুরু করলাম। গাবুরা নামক এই ইউনিয়নের রাস্তা ভালোই পরীক্ষা নিচ্ছে। অতিমাত্রায় সরু একটা ইটের সলিনের রাস্তা ধরে কিছুদূর বাদেই আবার মাটির রাস্তা। প্রশস্ততায় সরু রাস্তাটার দ্বিগুণ। আর কাদার পরিমাণ আগের রাস্তার দশগুণ বেশি। আবারো সাইকেল আমাদের কাঁধে। এত বছর ধরে সাইকেলের কাঁধে চাপার মোক্ষম প্রতিশোধ নিচ্ছে সাইকেলগুলো। কে জানে বিমলানন্দে হাসছেও কিনা ব্যাটারা! আমরা না হয় সাইকেল ঠেলে আর কাঁধে চাপিয়ে ভয়াবহ কাদার অংশটুকু পেরিয়ে এলাম। মোটরসাইকেল আরোহী রাবাত ভাইয়ের সেই সুযোগ নেই। বেচারা দেখলাম আকাশ পানে তাকিয়ে নালিশ করছে। আসমানে করা নালিশের বল ড্রপ খেতে খেতে পাতালে আমাদের কোর্টে এসে পড়লো। প্রথমে আধ্যাত্মিক গুরুদের মতো তার দিকে কৃপাদৃষ্টি হানলাম বারকয়েক। তাতেও কোন লাভ না হওয়াতে মোটরসাইকেলসমেত ভাইকে উদ্ধারে নেমে পড়লাম আমরা! ভাবসাবে একেকজন সাইকেল আরোহী তো নয়, যেন একেকটা উদ্ধারকারী জাহাজ হামযা! অবশ্য মোটরসাইকেলের চাকা তিন-চার গড়ান দিতেই ভাবের বেলুন ফুঁস করে চুপসে গেল! মাডগার্ড আর চাকার মাঝের অংশটুকু কাদা জমে আর ঘুরছে না। অগত্যা কাঠি করতে হলো। বাঙালি হিসেবে ‘কাঠি করা’র স্বভাব আমাদের মজ্জাগত! সবাই মিলে সমানে কাঠি করে মোটরসাইকেলকে প্রস্তুত করা হচ্ছে চাকার পরের তিন-চার গড়ানের জন্যে। এরপরেই আবার কাঠি হাতে কসরত! আধা কিলোমিটারের মতো এইটুকুন রাস্তা সবার ধৈর্যশক্তির চরম পরীক্ষা নিচ্ছিল। এর মাঝেই এক বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় এক পিচ্চি আগন্তুক দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। খানিক বাদেই ভেতর বাড়িতে থাকা বোনকে আগন্তুক দেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলল, ‘ও মণি, একটাবার তাকায়া দ্যাখ, কারা আসিছে!’

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা
পরবর্তী নিবন্ধনিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের বার্ষিক সাধারণ সভা