কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১৭ মার্চ, ২০২২ at ৬:৪৩ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধু : এখনো অনেক জানার বাকি

‘দুপুরে খেয়ে-দেয়ে বৈঠকখানায় বসে দৈনিকের পাতায় চোখ বুলাচ্ছিলাম। তখন বাইরের দিকে দরজায় হঠাৎ প্রচণ্ড ধাক্কার শব্দ শুনে ছুটে গিয়ে দরজা খুলতে দেখি একজন অপরিচিত লোক। সে হাঁফাতে হাঁফাতে বললো –
আমি বিমান অফিস থেকে আসছি। শিগগির আসুন, বঙ্গবন্ধু আপনার সঙ্গে ফোনে আলাপ করবেন, তিনি ফোন ধরে আছেন।
লুঙ্গির উপর পাঞ্জাবিটা চড়িয়ে ছুটে গেলাম বাংলাদেশ বিমান অফিসে। আমার বাসা থেকে বেশি দূরে নয়। বড়জোর তিন মিনিটের পথ। বলাবাহুল্য আমার বাড়িতে তখন কোনো ফোন ছিল না। ফোনে সংযোগ হতেই শেখসাহেব সর্বাগ্রে জানতে চাইলেন, আমার শরীর কেমন আছে।
বললাম- এ বয়সে যেমন থাকার সে রকমই আছে। খুব ভালোও না, আবার তেমন মন্দও না। বয়সানুসারে মোটামুটি ভালো আছি বলতে পারি।
শেখ সাহেব বললেন- চট্টগ্রামে আপনাকে একটা দায়িত্ব দিতে চাই, আপনি নিতে রাজি তো?
বললাম- যেসব ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা আছে, যেমন শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি – এসব ক্ষেত্রে কোনা দায়িত্ব দেওয়া হলে আমি তা যথাসাধ্য পালনের চেষ্টা করবো।
আরও কিছু ঘরোয়া আলাপের পর ফোন রেখে দেওয়ার সময় তিনি বললেন- আমি আপনাকে আগামীকাল খবর দেবো।
আগামীকাল দেশের প্রধানমন্ত্রী কী খবর দেবেন? মনে বেশ কিছুটা দ্বিধাদ্বন্‌দ্ব নিয়ে আগামী দিনের প্রতিক্ষায় রইলাম। বাসায় কাউকে কিছু জানালাম না।
পরদিন ভোরে নিয়মমাফিক অভ্যস্ত প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছি পথে সহপ্রাতভ্রমণকারীদের সাথে দেখা হতেই তাঁরা সবাই প্রায় সমস্বরে আমাকে অভিনন্দন জানাতে শুরু করলেন।
কী ব্যাপার! আমি তো অবাক!
তাঁরা জানালেন, গত সন্ধ্যায় ঢাকা বেতারের আটটার নিউজে ঘোষণা করা হয়েছে, আপনাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ করা হয়েছে।…
তখন আমাদের বাসায় রেডিও বা ট্রানজিস্টর ছিল না। তাই গতরাতের রেডিওর খবর বাড়িতে আমরা কেউ শুনিনি।
সরকারি আদেশপত্র পেলাম ১৮ এপ্রিল।’
আবুল ফজল ‘শেখ মুজিব; তাঁকে যেমন দেখেছি’ গ্রন্থে তাঁর ডাইরি থেকে ৫ এপ্রিল ১৯৭৩ সালের এই অংশটি উদ্ধৃত করেছেন।
এই সময়ের জন্য ঘটনাটি অবিশ্বাস্য শোনাবে কয়েকটি কারণে। প্রথমত, দেশের প্রধানমন্ত্রীই নন শুধু তিনি, জাতির পিতাও তখন। তিনি ফোন করেছেন নিজে একজন শিক্ষকের কাছে দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব নিয়ে। তিনি তা শিক্ষামন্ত্রী, সচিব বা স্থানীয় এমপির মাধ্যমে বলাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। কারণ এই মহান মানুষটি জানতেন একজন যোগ্য মানুষ অথবা একজন শিক্ষকের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে।
স্টেডিয়াম মার্কেটের পূর্বে ইয়াসমিন পালেসের সর্বদক্ষিণে ছিল তখন বাংলাদেশ বিমানে অফিস। সেখান থেকে উত্তরে আবুল ফজলের মতে, ‘তিন মিনিটের পথের’ পর আবুল ফজলের বাড়ি। ফোন পেয়ে বাহকের আসা, তার কাছে সংবাদ পেয়ে পাঞ্জাবি পরা থেকে শুরু করে তিন মিনিটের পথ বেয়ে বিমান অফিসে এসে ফোন রিসিভ করা এটা অন্তত দশ মিনিটের ব্যাপার। সদ্য স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য দশ মিনিট খুব মূলবান সময়। এটি একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকার কথা হলেও এ পর্যন্ত কোথাও তেমন আলোচনা হয়েছে বলে শুনিনি। বঙ্গবন্ধু কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন তা বাঙালিদের পক্ষে অনুধাবন করা কঠিন শুধু এই কারণে যে কারো মহত্ত্ব বুঝতে হলে নিজের মধ্যেও সামান্য মহত্ত্ব থাকতে হয়।
শুধু বিনয়ের কথাও যদি ধরি সেখানেও বঙ্গবন্ধু অনন্য-অসাধারণ। তাঁর ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধের অজস্র উদাহরণের মধ্যে আরেকটির উল্লেখ করি-
সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের সময়টি ছিল অত্যন্ত উত্তেজনাকর। তিন তারিখে নির্ধারিত অ্যাসেম্বলির অধিবেশন ইয়াহিয়া খান পহেলা মার্চ স্থগিত ঘোষণা করে। এসব ষড়যন্ত্রের পেছনে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ভূমিকা সর্বজ্ঞাত। বঙ্গবন্ধুকে শাসনভার না দেওয়ার জন্য ভুট্টো প্রতিদিন পাক প্রসিডেন্টকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। এরই মধ্যে সাতই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা।’ পাকিস্তানিদের প্রতি বিতশ্রদ্ধ বঙ্গবন্ধু তুমুল উত্তেজনায়ও তাঁর স্বভাবজাত সৌজনবোধ হারাননি। সেসময় বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারকে নিয়ে অপপ্রচারের শেষ নেই। শেখ কামালকে টার্গেট করে ভয়ঙ্কর সব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। তখনকার একটি দিনের কথা আবুল ফজল লিখেছেন, ৭-৫-৭৩ আজ সন্ধ্যা ৬টায় গণভবনে শেখসাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎকার। সেদিন বঙ্গবন্ধু তাঁকে যা বলেছিলেন তা তুলে ধরেছেন তিনি, ‘গত পনেরো মাস ধরে তিনি কোনো মাইনে নিচ্ছেন না। কেউই এখনও জানে না। প্রচার করেননি কথাটি। স্ত্রীর কিছু আয় আছে, তাতেই সংসার চলে। নাস্তা করে সকাল নয়টায় গণভবনে আসেন, আর রাত দশটা এগারোটায় ফেরেন। দুপুরে খাবার পাঠিয়ে দেন বেগমসাহেবা বাড়ি থেকে।’
পনেরো মাস ধরে বেতন নেন না একজন প্রধানমন্ত্রী। সংসায় চলছে স্ত্রীর টাকায়, সে স্ত্রী কোনো চাকরি করেন না। গ্রামে উৎপাদিত ধান ও অন্যান্য পণ্য বিক্রি করে সে টাকায় ঢাকার সংসার চালান। এসব কথা কেউ প্রচার করেনি কখনো। বরং বলা হতো শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাতি করেন। সোনা-চাঁদিতে ভরপুর বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ি।
বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার নিয়ে আবুল ফজলের লেখার উদ্ধৃতি দিচ্ছি, ‘শেখসাহেবের নিজের ছেলেদের নিন্দার কথাও আমাদের কানে আসতো। সঙ্গত কি অসঙ্গত জানি না, তবে স্বভাবতই দুঃখবোধ করতাম। তাই অপ্রাসঙ্গিক হলেও বললাম-(বঙ্গবন্ধুকে)
ছেলেদের বিদেশ পাঠিয়ে দিয়ে ভালো শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন না কেন?
উত্তরে তিনি বললেন, দেখুন আমার ছেলেদের যদি আমি বিদেশে পাঠাই অন্যেরা কী করবে? দেশের সবার ছেলেমেয়েকে তো আর আমি বিদেশ পাঠাতে পারবো না।’ আবুল ফজল লিখেছেন, ‘কথাটা সত্য। এ সেন্টিমেন্ট প্রশংসারও যোগ্য। ‘
বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ তখনও রাজনীতি করেন না। শেখ কামাল ব্যস্ত লেখাপড়া এবং সে সঙ্গে ক্রীড়া ও সংস্কৃতিচর্চা নিয়ে। নিজেই গড়িয়ে তুলেছেন সঙ্গীতদল। গড়ে তুলেছেন আবাহনী ক্রীড়াচক্র। শেখ জামাল ছিলেন অত্যন্ত নিভৃতচারী। প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হিসেবে তাঁর কোনোধরনের বাড়াবাড়ি থাকা তো দূরের কথা কোনো অনুষ্ঠানেই তাঁকে খুব একটা দেখা যেত না।’ সে বৈঠকেই একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু আবুল ফজলকে বলেছিলেন, ‘কী করি, কোথাও তো ভালো লোক পাচ্ছি না। যাকে যেখানে বসাই সে-ই চুরি করে অবস্থাপন্ন ঘরের শিক্ষিত ছেলেদের বেছে বেছে নানা কল-কারখানায় প্রশাসক বানালাম, দুদিন যেতে না যেতে তারাও চুরি করতে শুরু করলো। যাকে পাই বলি, আমি কিছু সৎ লোক খুঁজে বেড়াচ্ছি।’ (সূত্র- শেখ মুজিব : তাঁকে যেমন দেখেছি, আবুল ফজল।)
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখতে গিয়ে কেন আবুল ফজল সাহেবের লেখার এত বড় উদ্ধৃতি দিলাম তা খুলে বলি। গত কয়েকবছরে বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে সম্ভবত কয়েক হাজার বই বেরিয়েছে যার অধিকাংশই অযথা স্তুতিতে ভরা এবং নকল বা কাটিং-পেস্টিং ধরনের, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। আবুল ফজলের লেখার উদ্ধৃতি দেওয়ার আরও কারণ হলো তিনি কখনো আওয়ামী লীগ করেননি। এমনকি উপাচার্য থাকা অবস্থায় তিনি বঙ্গবন্ধুর সম্মুখে বঙ্গবন্ধুকে অনেক কঠিন কথা শুনিয়েছেন যার প্রতিউত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ আপনাকে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি। আপনাকে অপমান করার কথা আমি ভাবতেই পারি না।’ সেই আবুল ফজল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অযথা প্রশংসা করবেন না।
পরে আবুল ফজল সাহেব জিয়ার শিক্ষা উপদেষ্টা হয়েছিলেন স্বল্প সময়ের জন্য। পদত্যাগের পর তিনি লিখেছিলেন ‘মৃতের আত্মহত্যা’ নামে বই। আর ‘শেখ মুজিব তাঁকে যেমন দেখেছি’ বইটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৭৮ সালে জিয়া যখন ক্ষমতায়। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়াকালীন আবুল ফজলের অনেক প্রশংসা শুনে শুনে তাঁর প্রতি আলাদা সম্মানবোধ তৈরি হয়েছিল; ফলে এই বইটি আমি সে সময় পড়ে ফেলি। আমার বেড়ে ওঠার প্রাক্কালে আবুল ফজলের এই বইটির প্রভাব অনেকখানি। কারণ ওই সময়টা ছিল বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার সময়। এই বইটি পড়ে বঙ্গবন্ধু, শেখ কামাল তথা পুরো পরিবারের সত্যটি জানার সুযোগ হয়েছিল।
২. আমাদের কৈশোর-তারুণ্য-যৌবনকাল কেটেছে প্রবল বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগবিরোধী পরিবেশে। চারিদিকে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর অবদানকে মুছে ফেলার চেষ্টা। এ কাজে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানসহ পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র জড়িত। অবশ্য স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে ২৮ বছর মোশতাক, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়ারা আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করতে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেছে। এমনকি একাত্তরের ২৫ মার্চে কালরাতে পাকিস্তানিদের হাতে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার হওয়া নিয়েও অনেক মিথ্যা প্রচার করা হয়েছে। সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের। সিডনি শনবার্গকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বিযয়টি স্পষ্ট করেন। সিডনি শনবার্গ লিখেছেন, ‘তিনি বললেন, তাঁকে হত্যা করে বাঙালিদের ওপর দোষ চাপানোর পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের একটা চক্রান্তের কথা তিনি জানতে পেরেছিলেন। ‘ আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলেই আমার গাড়িতে গ্রেনেড মারা হতো, আমাকে হত্যা করা হতো। তারপর বলত বাঙালি চরমপন্থীরা এটা করেছে, আর এজন্যই আর্মিকে আসতে হয়েছে এবং আমার লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। ঠিক করলাম, নিজের বাড়িতেই থাকব। আমার বাড়িতেই তারা আমাকে মারুক। তাহলেই সবাই জানবে, তারাই আমাকে হত্যা করেছে, আমার রক্তে শুদ্ধ হবে আমার জনগণ।’ একজন নেতা কতটা অকুতোভয় হলে, জনগণকে কতটা ভালোবাসলে এমন বিশ্বাস করতে পারেন, এমন কথা বলতে পারেন। ওই রাতের কথা বলতে গিয়ে একই সাক্ষাৎকারে সিডনি লিখেছেন, ‘অচিরেই জোরজবরদস্তি বাড়িতে ঢুকে পড়ে সৈন্যরা, চলে যেতে অস্বীকৃতি জানানোয় এক পাহারাদারকে হত্যা করে ঝড়োগতিতে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যায়। শেখ মুজিব জানালেন, ড্রেসিংরুমের দরজা খুলে তাদের মুখোমুখি হলেন, বললেন, ‘গুলি বন্ধ করো! গুলি বন্ধ করো! গুলি করছ কেন? আমাকে গুলি করতে চাইলে, আমাকে করো; এই তো আমি। আমার লোক আমার বাচ্চাকাচ্চাদের কেন গুলি করছ?’
সে রাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হতে পারতেন। পাকিস্তানিরা তাঁকে তাঁর বাসভবনেই হত্যা করতে পারতো। কিংবা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে যেকোনো একটি গুলি তাঁর বুক বিদীর্ণ করতে পারতো। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা হবে এ গ্যারান্টি তো তাঁকে কেউ দেয়নি। তিনি তো তখন ইয়াহিয়ার দৃষ্টিতে ‘বিট্রেয়ার’। কারণ হলো ভীরুরা প্রতিমুহূর্তে মরে আর বীরেরা একবারই মরে। বঙ্গবন্ধু তো বীরশ্রেষ্ঠোত্তম।
লেখক : কবি-সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধযতই পড়ি, প্রতিদিন নতুন করে আবিষ্কার করি বঙ্গবন্ধুকে
পরবর্তী নিবন্ধমহাশিশুর জন্মদিনে হৃদয়ের অর্ঘ্য