লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণের কষ্ট সয়ে উঠতে না উঠতেই প্রয়াত হলেন আরেক কিংবদন্তি বাংলা সংগীতের মহাগায়িকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ এর সন্ধ্যায় সন্ধ্যা চলে গেলেন বাংলা সংগীত জগতকে আরো অভিভাবকহীন করে। সার্থকনামা শিল্পী এসেও ছিলেন ১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় কলকাতার ঢাকুরিয়ায়।
শাস্ত্রীয় সংগীতে পারদর্শী সন্ধ্যা শিষ্য ছিলেন উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের। শিখেছেন তৎপুত্র উস্তাদ মুনাওয়ার আলি খাঁ সাহেবের কাছেও। গুরুদের প্রতি এতই শ্রদ্ধাশীল ও কৃতজ্ঞতাবোধে আবদ্ধ ছিলেন তিনি দুজনকে ডাকতেন বাবা ও ভাইয়া বলে। গুরুদ্বয়ের প্রধান নির্দেশ নিয়মিত দীর্ঘ রেওয়াজ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করে গেছেন জীবনের শেষ সুস্থ দিনটি পর্যন্ত। আদ্যোপান্ত গানের মানুষ সন্ধ্যার জীবনাবসানও হয়েছে হাসপাতালের বিছানায় প্রিয় শিল্পী মান্নাদে’র গান শুনতে শুনতে। জীবনে শেষবারের মতো সংগীত পরিবেশন করেছিলেন ২০১৯ সালের পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত বাংলা সংস্কৃতি মেলায়। অমলিন কণ্ঠে গঙ্গাস্তোত্র ও সরস্বতী বন্দনার পর তাঁর শেষ পরিবেশনা ছিল কমললতা ছবির অবিস্মরণীয় সেই গান, ‘ও মন কখন শুরু কখন যে শেষ কে জানে?’ বয়স তখন তাঁর ৮৮! উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছেও অল্পদিন শিখেছিলেন। উস্তাদজি তাঁর শিষ্যকে বলেছিলেন, ‘কোনোদিন সংগীতকে ছাড়বে না। শিখবে ও রেওয়াজ করে যাবে সমানে। অভ্যাসটা চিরদিন রেখে যাবে।’ গুরুবাক্য শিরোধার্য করার এই সুফল কণ্ঠের অমালিন্য।
তবে যোগ্য সম্মান পাননি তিনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। একবার মাত্র শ্রেষ্ঠ গায়িকার জাতীয় পুরস্কার পান ১৯৭১ সালে জয়জয়ন্তী ও নিশিপদ্ম ছবিতে প্লে ব্যাকের জন্য। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মান বঙ্গবিভূষণসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত করেছেন। তবে সবচেয়ে বড় যে সম্মান ও পুরস্কার-জনগণের অকুণ্ঠ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা তা তিনি পেয়ে গেছেন সারা বিশ্বের কোটি কোটি বাঙালির কাছ থেকে। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সংবর্ধিত করেছেন ১৯৭২ ও ২০১২ সালে এবং তাঁর প্রয়াণের পর রাষ্ট্রীয়ভাবে শোকতর্পণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর কয়েকদিন আগে ৯১ বছর বয়সে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে যে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারটি যাচনা করেন, সেটি ভারতের সর্বনিম্ন রাষ্ট্রীয় পদক। তিনি ঠিকই এই অবজ্ঞা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন। তিনি তাই পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন এবং কৈফিয়তের জবাবে অবলীলায় বলতে পেরেছেন, ‘মেরা দিল নেহি চাহতা হ্যায়, ম্যায় নেহি লুঙ্গি।’
ব্যারিটোনাল কণ্ঠ অর্থাৎ উচ্চগ্রামে বাঁধা স্বর যেটা প্রধানত পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতে পাওয়া যায়, আমাদের উপমহাদেশের সংগীত জগতে যে কয়েকজন শিল্পীর সে-কণ্ঠ সহজাত ও অধীত ছিল সন্ধ্যা ছিলেন তাঁদের অন্যতম। একেবারে তার সপ্তকে তাঁর কণ্ঠ অনন্য এক দ্যোতনা সৃষ্টিতে সক্ষম ছিল। তাঁর গায়কীর আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ মুখ খুলে উদাত্ত স্বরে গাওয়া এবং স্বরক্ষেপণ ও উচ্চারণে সুস্পষ্টতা। তাঁর কণ্ঠটিও ছিল ব্যতিক্রমধর্মী।
কণ্ঠসংগীতে বিশেষ করে লঘুসংগীতে কণ্ঠাভিনয়ের একটি মুখ্য ভূমিকা থাকে। সন্ধ্যার এই অভিনয় ক্ষমতা ছিল সহজাত। ফলে যে কোনো বয়সের, যে কোনো চরিত্রের অভিনয় শিল্পীর ঠোঁটে তাঁর গাওয়া গান স্বতঃস্ফূর্তভাবে খাপ খেয়ে যেত। প্রায় সব অভিনেত্রীর লিপে গাইলেও সুচিত্রা সেনের লিপে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কেমিস্ট্রিটা ছিল পরিপূরক। দুজনের কণ্ঠস্বরের সাদৃশ্য এর অন্যতম কারণ হলেও অভিনয় আঙ্গিক এবং গায়কী সম্পর্কে পারস্পরিক সচেতনতাও একটি বড় কারণ ছিল। সেকালের মূলধারার বাংলা সিনেমার বাণিজ্যিক সাফল্যেরও একটা বড় কারণ এই জুটির সম্মিলন।
শাস্ত্রীয় সংগীতে দক্ষ সন্ধ্যা সমান পারদর্শী ছিলেন লঘু সংগীতেও। কিন্তু দু’য়ের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজনে ছিলেন সচেতন। লঘু সংগীতে শুদ্ধ স্বর ও রাগের যথার্থ প্রয়োগে সজাগ থাকলেও কখনো শাস্ত্রীয় প্রয়োগের প্রভাব ঘটাতেন না। মার্গ সংগীতে দক্ষতার কারণেই তাঁর লঘু সংগীত এতটা পরিপক্বতা পেত। তিনি বলতেন, ‘লঘু সংগীত এক পশলা বৃষ্টি আর শাস্ত্রীয় সংগীত বরষার অঝোর বারিধারা’। তবে দুটোকেই সমান গুরুত্ব দিতেন। আর ভালোবাসতেন রবীন্দ্র সংগীত। আত্মজীবনী ‘ওগো মোর গীতিময়’-এ রেওয়াজ সম্পর্কে বলেছেন, ‘আজও লঘু সংগীতের রেওয়াজ করতে বসার সময় প্রতিবারই আমি রবীন্দ্র সংগীত দিয়ে শুরু করি।….এরপর আমি আরও কয়েকটি রবীন্দ্র সংগীত পরপর গাই। এভাবে খানিকক্ষণ গাইবার পর লঘু সংগীতের রেওয়াজ শুরু করি।’ সব ধরনের গানে পারদর্শী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় উচ্চাঙ্গ সংগীত, আধুনিক, চলচ্চিত্র, ভজন, ভক্তিগীতি, গীতিনাট্য, লোকগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল সংগীত, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রগীতি সব মিলিয়ে প্রায় ছয় হাজারের মতো গান গেয়েছেন। বাংলা ছাড়া হিন্দি এবং আরো বেশ কয়েকটি ভাষায় গান করেছেন। ১৭টি হিন্দি ছবিতে প্লেব্যাকের সফল ক্যারিয়ার রয়েছে তাঁর। ১৯৫০ সালে শচীন দেববর্মনের ডাকে মুম্বাই যান। ডাকসাইটে সব সংগীত পরিচালকের সুরে গেয়েছেন সেখানে। হিন্দিতে প্রথম গান করেন অনিল বিশ্বাসের সুরে তারানা ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ১৯৫০ সালে। লতার সঙ্গে বন্ধুত্ব সেই থেকে যা সারাজীবন অটুট ছিল। হিন্দিতে অত্যন্ত সড়গড় ছিলেন সন্ধ্যা। হিন্দি রপ্ত করেছিলেন মা হেমপ্রভা দেবীর কাছে। মা ছিলেন পাটনার অভিবাসী বাঙালি। সন্ধ্যার সংগীতের প্রাথমিক হাতেখড়ি মায়ের কাছে। তিনভাই তিন বোনের সর্বকনিষ্ঠ সন্ধ্যার ডাকনাম দুলদুল। পরিবারের সকলের আগ্রহে ও পরিচর্যায় তাঁর সংগীত জীবনের সূচনা। বাবা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ভক্তি সংগীতে পারদর্শী ছিলেন। প্রথম গুরুও ছিলেন তিনি তাঁর কন্যার। এরপর শেখেন সন্তোষ বসুমল্লিক, সুখেন্দু গোস্বামী, যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়, পণ্ডিত গণপৎ রাও প্রমুখ সংগীতগুরুর কাছে। এরপর সে শিক্ষা পূর্ণতা পায় উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের সান্নিধ্যে। সন্ধ্যা উস্তাদজির পাতিয়ালা ঘরানার শিষ্যা ছিলেন।
১২ বছর বয়সে বেতারে প্রথম সংগীত পরিবেশন করেন সন্ধ্যা। প্রথম রেকর্ড বের হয় ১৪ বছর বয়সে। ১৫ বছর বয়সে গীতশ্রী পরীক্ষায় প্রথম হয়ে গীতশ্রী উপাধি অর্জন করেন। প্রথম প্লে ব্যাক বিমল রায়ের দ্বিভাষিক অঞ্জনগড় ছবিতে রাইচাঁদ বড়ালের সংগীত পরিচালনায়। তবে প্রথম মুক্তি পায় সমাপিকা। এটাও রাইচাঁদ বড়ালের সংগীত পরিচালনায়। দুটোই ১৯৪৮ সালে। রাইচাঁদ বড়ালই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে প্লে ব্যাকে নিয়ে যান এবং প্লে ব্যাকের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন। তাঁকেও তিনি গুরু মনে করতেন।
সংগীতজীবন ও ব্যক্তিজীবন উভয় ক্ষেত্রেই চরম বিশুদ্ধতা এবং পরিশীলতা বজায় রেখে গেছেন তিনি। ১৯৬৬ সালে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন প্রখ্যাত গীতিকবি শ্যামল গুপ্তের সঙ্গে। একমাত্র কন্যা সৌমি সেনগুপ্তও মেধাবী কণ্ঠশিল্পী, যদিও তিনি শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত।
সুরকার হিসেবেও সার্থকতার স্বাক্ষর রেখেছেন সন্ধ্যা। ১৯৭৫ সালে প্রথম আত্মপ্রকাশ। তবে এক্ষেত্রেও পরিমিতি বজায় রেখেছিলেন। স্বামী শ্যামল গুপ্তের লেখায় ১৯৭৫, ৭৬ ও ৭৭ সালে মোট তিনটি ইপি রেকর্ডে তাঁর সুর করা এবং স্বকণ্ঠে গাওয়া গান মাত্র ১২টি। তবে ১২টি গানই স্মরণীয়। ঝরাপাতা ঝড়কে ডাকে, আমি তার ছলনায় ভুলবো না, খোলা আকাশ কী এত ভলো লাগতো, চন্দন পালঙ্কে শুয়ে, কাগজের এই নৌকো আমার, কোজাগরী এই জোৎস্না, চন্দ্রলেখা যদি লেখনী হয়, এসব গান সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রাণবন্ত সুরারোপের অমর নিদর্শন।
বাংলাদেশের প্রতি এই মহাশিল্পীর ছিল অপরিসীম ভালোবাসা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধের স্বপক্ষে, স্বাধীন বাংলা সরকারের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারতীয় শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। স্বাধীন বাংলা সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের সহায়তায় আয়োজিত সংগীতানুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন এবং রাস্তায় গণচাঁদা সংগ্রহের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে একাত্ম হয়েছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ঢাকার পল্টন ময়দানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে গিয়েছিলেন হামিদুর রহমানের লেখা এবং সুধীন দাশগুপ্তের সুরে অবিস্মরণীয় সেই গান, ‘বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে তোমার স্বপ্নে র স্বাধীন বাংলায়।’ বাংলাদেশের তিনটি চলচ্চিত্রে তিনি প্লে ব্যাক করেছেন, আকাশ আর মাটি, ধীরে বহে মেঘনা ও সূর্যকন্যা ছবিতে যথাক্রমে সুবল দাস, সমর দাস ও সত্য সাহার সংগীত পরিচালনায়। স্বাধীনতা মৈত্রী সম্মাননায় বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সম্মানিত করেছেন ২০১২ সালে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতিও (বাবসাস) তাকে ১৯৭৪ ও ১৯৭৬ সালে সম্মানিত করেছেন শ্রেষ্ঠ গায়িকার পুরস্কারে ধীরে বহে মেঘনা ও সূর্যকন্যা ছবির গানের জন্য।
৯১ বছরের জীবনে ৮০ বছরের সংগীত ক্যারিয়ার এই মহাগায়িকার। বাঙালির প্রাণজুড়েই তাঁর অধিষ্ঠান। পরিণত বয়সেই তাঁর চলে যাওয়া। তবুও মেনে নিতে কষ্ট হয়। তাই তাঁর গানের কথাতেই বলতে ইচ্ছে করে, কিছুক্ষণ আরো না হয় রহিতে কাছে….
স্বামী শ্যামল গুপ্তের লেখায় ১৯৭৫, ৭৬ ও ৭৭ সালে মোট তিনটি ইপি রেকর্ডে তাঁর সুর করা এবং স্বকণ্ঠে গাওয়া গান মাত্র ১২টি। তবে ১২টি গানই স্মরণীয়। ঝরাপাতা ঝড়কে ডাকে, আমি তার ছলনায় ভুলবো না, খোলা আকাশ কী এত ভলো লাগতো, চন্দন পালঙ্কে শুয়ে, কাগজের এই নৌকো আমার, কোজাগরী এই জোৎস্না, চন্দ্রলেখা যদি লেখনী হয়, এসব গান সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রাণবন্ত সুরারোপের অমর নিদর্শন।