দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৩ মার্চ, ২০২২ at ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ

ড্রাগনসম্রাটের ড্রাগনমুখা বালা

প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ সূচক জবাব পেতেই ফের প্রমাণিত হল যে পুত্রদের জন্য তাদের মায়ের ভাড়ার আসলে কখনই শূন্য থাকে না। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে তাই বললাম লাজুকে যে, যাদুঘরের এই প্রাচীন চায়না অংশটা দ্রুত দেখা শেষ করে, যখন হল ঘরের ঐ পাশের অংশে ঘুরতে যাওয়ার আগে মাঝে থাকা হল ঘরেরই কোন একটা যুৎমত জায়গায় দাঁড়িয়ে, পুত্রদের যাতে খাইয়ে নেয় ও। বলেই মনে হল , আরে নাহ! তা’তো করা যাবে না। হয়তো দেখা যাবে হল ঘরে খাওয়া দাওয়া করা এক্কেবারেই নিষিদ্ধ। তা করতে গেলে হয়তো পড়তে হবে পুলিশি ঝামেলায়। তাতে যে শুধু সময় নষ্ট হবে, আর গুনতে হবে জরিমানা সেটাই সব তো নয়! সবচেয়ে বড় কথা হলো ওরকম কিছু ঘটলে, যাবে এক্কেবারে দেশের মান ইজ্জত! নাহ সে ঝুঁকি নেয়া যাবে না মোটেও। বরং খুঁজে দেখতে হবে, এই মিউজিয়মে কোন রেস্টুরেন্ট বা ক্যান্টিন আছে কী না। যদি থাকে তবে লাজুর ভাড়ারের খাবারে হাত না বাড়িয়ে, প্রয়োজনে ওখানেই লাঞ্চ করে নেয়া যেতে পারে সবাই মিলে। তাতে বাইরে গিয়ে রেস্টুরেন্ট খোঁজাখুঁজির হাঙ্গামা থেকেও বাঁচা যাবে।
এদিকে মনে মনে একটু আগেই যদিও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে এই ঘরটার আর থামব না কোথাও, দেখবো যা কিছু তা সব হাঁটার উপরে, কিন্তু এ মুহূর্তে বদলাতে হল মত। চোখে পড়ল সামনের মিটার দশেক দূরে দেয়ালের পাশের একটা শো কেসের দিকে বেশ গভীর মনোযোগে কয়েকজন মিলে কোন একটা কিছু নিরীক্ষণ করছে। এ দৃশ্য দেখে মনে হল নিশ্চয় কোন বিশেষ আকর্ষণীয় বস্তু আছে ওখানে। সুতরাং বাকীদের নিয়ে লাজুকে এগুতে বলে, হাঁটা ধরলাম নিজে সেই দিকে ।
শো কেসের কাছে গিয়ে ঐটিকে ঘিরে থাকা পাঁচজনের ছোট্ট এই দলটির ভেতর এতক্ষণের মধ্যে এই প্রথম একজন ইউরোপিয়ান বা আমেরিকানও আছেন দেখলাম ওখানে। তাকে ঘিরে থাকা চার চায়নিজের মধ্যে এ মুহূর্তে কথা বলছে শুধু তার পাশে দাঁড়ানো এক চায়নিজ সুন্দরী। হাত পা নেড়ে চেড়ে বেশ কিছুটা উচ্চস্বরের চিংলিশেই কিছু একটা বোঝাতে চেষ্টা করতে গিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছে সেই কন্যা। কি বলছে সে অত গলদঘর্ম হয়ে? তা বোঝার জন্য সেদিকে কান খাড়া করে, উঁকিঝুকি মেরে শোকেসটি ঘিরে থাকা বাকী তিনজনের ফাঁকফোঁকড় দিয়ে শোকেসের ভেতরে নজর ফেলতেই দেখি, সেটির ভেতরে চুড়ি বা বালা জাতীয় একটা জিনিষ রাখা আছে। তবে গোলাকার এই বালাটার একটা অংশ ফাঁকা।
এদিকে ঐ চায়নিজ কন্যার চিংলিশ বয়ান থেকে যতোটুকু এসে ঢুকেছে খাড়া করে রাখা কানে আর তা থেকে যতোটা বুঝেছি তাতে বুঝলাম যে, এটা হল একটা অত্যন্ত মহার্ঘ পুরাকীর্তি, যার বয়স কমপক্ষে ছয় সাত হাজার বছর! আর ঐ বালা জাতীয় বস্তুটি হল জেড পাথরের তৈরি একটা ড্রাগন। যদিও জায়গাটা ঘিরে রাখা বাকী চায়নাম্যানদের কারণে ঠিক মতো দেখতে পাচ্ছি না ওটা, তারপরও যতোটুকু দেখেছি, তাতে ড্রাগন বলতে যে চেহারা ভেসে উঠে মনে, তার সাথে ঐ বস্তুর কোন মিল পেলাম না।
ইশ! একটু কাছে গিয়ে দেখতে পারলে হতো। তাহলে বোঝা যেত ঐ চুড়ি বা বালা জাতীয় জিনিষ যেটিকে বলা হচ্ছে এটি জেড পাথরের তৈরি ড্রাগন, সেই ড্রাগনের মুখটা ভালমতো। অথচ পারছি না যেতে সামনে। বেশ কিছুক্ষণই তো হল যে এদের পেছনে এসে ঐটি দেখার চেষ্টা করছি উঁকি ঝুকি মারার সাথে সাথে খুক খুক কাশির শব্দ করে। ফলে আমার এই মরিয়া প্রচেষ্টাটি যে অবশ্যই এরা টের পেয়েছে, বলা যায় তা হলফ করেই। কিন্তু তারা এমন ভাব ধরেছে যেন কেউই তারা টের পায়নি কিছুই। এরকম একটা পাবলিক জায়গায় এভাবে অন্যান্য দর্শনার্থীদের জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা তো শোভন কিছু নয়। তার উপর এভাবে কারো উপস্থিতি উপেক্ষা করাটাও তো আরো অশোভন! কিন্তু এ নিয়ে যে তাদের কোনই ভাবান্তর নেই, ওদের দেহভাষায় তা পরিষ্কার । সবারই দেখছি গভীর মনোযোগের লক্ষ হল শুধু সেই বিদেশী মানে পশ্চিমা লোকটি । তাদের সবারই শরীরী ভাষায় একটা জিনিষ পরিষ্কার যে আছে তারা তারই সেবায়।
কিছুটা বিরক্তই লাগলো ওদের এভাবে আমার উপস্থিতিতে কে উপেক্ষা করে শোকেসটিকে ঘিরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে । অবশ্য বিদেশীদের প্রতি মানে আমাদের প্রতি এদের এরকম একটা উদাসিন ভাব তো দেখে আসছি এখানে এসে পা ফেলার পর থেকেই। সে তুলনায় এ মুহূর্তে ঐ সাদা চামড়ার লোকটি যে রকম মনোযোগ পাচ্ছে এই গোটা দলটির কাছে তাতে ধারণা করছি, ঐ লোক হতে পারে পশ্চিমা কোন বড় ব্যবসায়ি বা বড় কোন কোম্পানির হোমরা চোমড়া । এসেছেন উনি চায়নায় হয়তো সেই কারখানা পরিদর্শনে, যেখানে সস্তায় লাখে লাখে কাতারে কাতারে তার পণ্য উৎপাদিত হয়ে ছড়িয়ে পরে বিশ্বব্যাপী। আর চায়নিজ সেই কোম্পানির মালিক হয়তো টের পেয়েছে যে , এই পশ্চিমা ব্যবসায়ীটি ইতিহাস ঐতিহ্য সচেতন একজন সাংস্কৃতিক মননের মানুষ। তাই হয়তো তার এই কর্মচারী কর্মকর্তাদের সঙ্গী করে ভদ্রলোকে পাঠিয়ে দিয়েছে এই মিউজিয়াম ঘুরিয়ে দেখিয়ে পটিয়ে পাটিয়ে রাখার জন্য, যাতে ব্যবসাটা আখেরে হাতছাড়া না হয়। ফলে ওরা সবাই মিলে এমন গভীর মনোযোগে তার সন্তুষ্টি বিধান করার চেষ্টা করছে যে , আশে পাশে অন্য কারো এতে কোন অসুবিধা হচ্ছে কী না, তা নিয়ে কোন ভ্রূক্ষেপই করছে না এরা। নাহ এখানে আর সময় নষ্ট করার মানে নেই।
পরিবারের বাকীদের অবস্থান লক্ষ করে এগুতে এগুতে মনে পড়ল চায়নীজ এ বান্দর বছরে চারিদিকে এতো এতো নানান রকমের বানরের ছবি আর মূর্তি দেখতে, আসলে ভুলেই গিয়েছিলাম যে, চায়নিজদের রাশিচক্রে, বানর ছাড়া ষাড়, ছাগল, সাপ, বাঘ, শুকর, ইঁদুর, মোরগ ইত্যাকার সব বাস্তব প্রাণী থাকলেও একটাই মাত্র পৌরনিক প্রাণী আছে, আর তা হল ড্রাগন। তার উপর চায়নিজ সংস্কৃতিতে এই ড্রাগনকে মনে করা হয়, ক্ষমতা, জ্ঞান, ধনসম্পদ আর সৌভাগ্যের প্রতীক হিসাবে। এমনকি এই যে প্রাচীন চায়নার অংশে ঘুরে বেরাচ্ছি এখানে এখন, ঐসব আদ্দিকালে চায়নিজরা বিশ্বাস করতো যে তাদের রাজারা সব ড্রাগনের বংশধর! ফলে ড্রাগন ছিল রাজকীয় ক্ষমতার প্রতীক!
অন্যদিকে আমাদের উপমহাদেশে হীরা, চুনি, পান্না, মণি, মানিক্যকে যে রকম মূল্যবান মনে করা হয়, সেরকমি চায়নিজ সংস্কৃতিতে জেড পাথরকে মনে করা হয় স্বর্গীয় মুল্যবান পাথর হিসাবে। অতএব ঐ যে পাঁচ নাকি ছয় হাজার বছরের পুরানো জেড পাথরের তৈরি বালাটি উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখে আসলাম, ঐটি নিশ্চয় হতে পারে প্রাচীন কোন চায়নিজ রাজার বালা। একে তো ঐ চায়নাকন্যার বয়ান মতে সেটি হচ্ছে ড্রাগনের প্রতিমূর্তি, অন্যদিকে তা আবার স্বর্গীয় পাথর বলে বিবেচিত জেড পাথরের তৈরি। ফলে যে চায়নিজ সম্রাট ঐটি পড়তেন হাতে, তিনি নিশ্চয় প্রজাদের কাছে একজন মহাপরাক্রমশালী সম্রাট হিসাবেই পরিচিত ছিলেন। যার কারনেই হয়তোবা ঐ চার চায়নিজ মিলে, তাদের সেই পশ্চিমা অতিথিকে তুমুল চেষ্টা করে যাচ্ছিল সেই ড্রাগনসম্রাট কতোটা জ্ঞানী, পরাক্রমশালী আর ভাল ছিলেন তা বোঝাতে। এদিকে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে তো যতোটা জানি ড্রাগনকে মনে করা হয় দুষ্ট, অভিশপ্ত বা অশুভের প্রতীক হিসাবে। অতএব ওটা বোঝাতে গিয়ে নিশ্চয় তাদের গলদঘর্ম হতে হচ্ছিল । ঠিক এরকম পরস্পরবিরোধী ব্যাপারকে বোঝানোর জন্যই তো বাংলায় , “এক দেশের গালি আরেক দেশের বুলি”র মতো একটা চমৎকার প্রবাদ আছে !
এসব ভাবতে ভাবতে এই ঘরের নানান দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চমৎকারভাবে সাজিয়ে রাখা নানা পুরাকীর্তির গুলোর দিকে চোখের ঝলক বোলাতে বোলাতে, দলের পেছনে যোগ দিয়ে লেজ হয়ে হাঁটার গতি কমিয়ে ধীরে সুস্থে এগুবার মনস্থ করেছি যখন, তখনি সামনে থেকে দুপুত্র পিছিয়ে এসে আমার সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দীপ্র জিজ্ঞেস করলো
“বাবা কি দেখলে ওখানে?”
ওটা একটা পাঁচ নাকি ছয় হাজার বছর পুরানো একটা ড্রাগন । সেটাই দেখতে গিয়েছিলাম-আমার এই উত্তরের পিঠে “ঐ যে দেখো আরেকটা ড্রাগন?” বলে আমাদের কিছুটা সামনের দিকে এই ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় একটা বড়সড় কাঁচের শোকেসে সাজিয়ে রাখা আরেকটা ড্রাগনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো অভ্র।
ওর কথায় সেইদিকে চোখ যেতেই দূর থেকেই সেটা যে ড্রাগন তা বুঝতে কোনই বেগ পেতে হলো না। ঐ বালারূপি ড্রাগনের তো বড় বড় নখরের আঙুলসজ্জিত কোন হাত বা পা ছিল না, যা নাকি আছে বেশ বড় আকারেরই এই ড্রাগনের। ঠিক তখনি মনে হল, আচ্ছা ঐ বালাটা কি তাহলে আমাদের সংস্কৃতিতে যেমন নারীরা মকরমুখি বালা ব্যবহার করে, দেখেছি যা আম্মারও হাতে, ওইরকম কোন ড্রাগনমুখ বালা ছিল নাকি , পড়তেন যা কোন প্রাচীন ড্রাগন সম্রাট?
“ঐ যে বাবা আরেকটা ড্রাগন” সামনের দিকে এগুতে এগুতে এবার দীপ্র দেখাল আরেকটা ড্রাগনের পুরাকীর্তি। ওরা কথার সূত্র ধরে এবার ডানে তাকাতেই চোখে পড়লো ভিন্ন চেহারা আরা আকারের আরেকটা প্রাচীন ড্রাগন। আগেরটার রং সবুজ না বলা ভাল শ্যাওলা রঙয়ের হওয়াতে ওটা আসলে কোন ধাতুতে তৈরি তা সঠিক ঠাহর করতে না পারলেও, এটা যে পাথর খুদে বানানো হয়েছে, তা বুঝতে পারছি পরিষ্কার!
“বাবা ঐ যে আরেকটা” সোজাসুজি সামনের দিকে থাকা আরেকটা তামাটে রঙয়ের ড্রাগনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল ফের অভ্র। হাসি পেল মনে এতে! ভাবলাম যে দুই ভাই মিলে চায়নার রাস্তায় যেমন নানান সৈয়দ বংশীয় গাড়ী দেখার প্রতিযোগিতা করে আসছিল এ ক’দিন, এ মুহূর্তে তা পরিণত হয়েছে বাবাকে কে কতো ড্রাগন দেখাতে পারে আগে সেই প্রতিযোগিতায়!
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারীর আত্মবিশ্বাস
পরবর্তী নিবন্ধস্মৃতিতে অমর আমাদের আব্বা এডভোকেট বদিউল আলম