‘বৃক্ষ’। এবার বইমেলায় প্রকাশিত সাংবাদিক ওসমান গনি মনসুরের পাঠকনন্দিত গ্রন্থ। যেখানে তিনি তার দেখা বিশ্বকে পাঠকের সামনে ভিন্ন মাত্রায় হাজির করেছেন। পাঁচটি ছোট-বড় অধ্যায়ে বিভক্ত ৫০ টির অধিক রচনায় লেখক তার অর্ধশত বছরের সাংবাদিকতা জীবনের নানা অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। একইসঙ্গে দেশে এবং আন্তর্জাতিক সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহগুলো উপস্থাপন করেছেন চমৎকারভাবে। ৭০ দশক থেকে শুরু করে করোনাকালীন সময়কালের নানা ঘটনাপঞ্জি স্থান পেয়েছে ‘বৃক্ষ’ এ।
গতকাল নগরে জিমনেশিয়াম মাঠে বইমেলায় ওসমান গনি মনসুরের সঙ্গে কথা হয় দৈনিক আজাদীর। তিনি বলেন, ‘বৃক্ষ’ একক কোনো গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস বা প্রবন্ধ সংকলনও না। আবার সবটুকুই আছে। প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প, ঘটনা প্রবাহ, ভ্রমণকাহিনি সবকিছুর টাচ করেছি। বইটা পড়ে পাঠক যেন নতুনত্বের ছোঁয়া পায় সে চেষ্টা করেছি। প্রতিটি অধ্যায়ে ভিন্ন কিছু ঘটনা প্রবাহ সম্পৃক্ত করেছি। আমার বিশ্বাস পাঠকদের ভিন্ন মাত্রা তৃপ্তিবোধ জাগাবে ‘বৃক্ষ’।
তিনি বলেন, ‘বৃক্ষ’ মূলত কঠিন কোভিড সময়ে একাকীত্বের ফসল। প্রারম্ভিক অধ্যায়ের নিবন্ধগুলোতে আমার অর্ধশতবর্ষ সাংবাদিকতা জীবনের অন্তরালের কিছু কথা তুলে আনার চেষ্টা আছে। এর অনেক বিষয় দৃশ্যমান আলোচিত হলেও অনেক অজানা চিত্র পাঠকরা ভিন্নতর আস্বাদন পাবে বলে আমার বিশ্বাস। পাশাপাশি আমি সামপ্রতিক কিছু আখ্যান-উপাখ্যান দেশভ্রমণ নিয়ে কথামালা সাজানোরও চেষ্টা করেছি।
বইয়ের নামকরণ প্রসঙ্গে বলেন, বৃক্ষ সকল প্রাণীরই আশ্রয়স্থল। সে ভাবনাটা আমার মধ্যে কাজ করেছে। যেহেতু আমার বইটি একক বিষয়ভিত্তিক নয়। এখানে সবকিছু আছে। বৃক্ষে যেমন শাখা-প্রশাখা আছে, আমার বইয়েও সবকিছুর সংমিশ্রণ আছে। বৃক্ষে আমার রচনাগুলো ভিন্ন ভিন্ন দিকে ডালপালা ছড়িয়েছে। শুধু নিবন্ধ প্রবন্ধ নয় কিংবা গল্প কাব্য ভিনদেশি লেখনীর অনুবাদ ভাবানুবাদও নয়, তবে সবকিছুরই মিশেল ছোঁয়ার চেষ্টা করেছি।
গ্রন্থভুক্ত ‘আমি দেখেছি এক অভিমানী বঙ্গবন্ধুকে’ নিবন্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নানা গবেষণা হচ্ছে, অনেক লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার স্মৃতিগুলো তুলে ধরেছি। তরুণ বয়সে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে এসে যে ছোট ছোট ঘটনাগুলো আমাকে র্স্পশ করেছিল তার কয়েকটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তরুণ বয়সে আমি বঙ্গবন্ধুর ছবিও তুলেছি, সেটা ১৯৭৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে প্রথম কলেজের ছাত্রবস্থায় দেখেছি। ‘৬৯-‘৭০ এর গণআন্দোলন পরবর্তী সময়কালে বঙ্গবন্ধু একটি অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম কলেজের সম্মুখ পথ দিয়ে খোলা জিপে রাউজান যাচ্ছিলেন। আমরা কলেজের ছাত্ররা তাঁর পথ আটকিয়ে কিছু বলতে আবদার জানাই। তখন তিঁনি রবী ঠাকুরের কবিতার কয়েক চরণ বলে ছাত্রদের মন রক্ষা করেন। তাঁর মুখে সে কবিতাটির অনুরণন এখনও কানে বাজে।
ওসমান গনি মনসুর বলেন, তারুণ্যের স্পৃহা আমার নানামুখী সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতে সহায়ক হয়েছে। স্বল্প সময়ের হলেও নাট্যাঙ্গনে, স্কাউটিংয়ে এবং দীর্ঘসময় ধরে রোটারি মুভমেন্টে সক্রিয় এবং উজ্জ্বল অবস্থান আমাকে যথেষ্ট তৃপ্ত রেখেছে। যার কিছু চুম্বক অংশ বিস্তৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারিনি ‘বৃক্ষ’ এ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমার পদচারণা ছিল। তা তুলে ধরেছি। আমার জীবনে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা আছে। যেমন নিমাই ভট্টচার্য (‘মেমসাহেব’ এর রচয়িতা, ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক) আমাকে বই উৎসর্গ করেছেন। এসবও তুলে ধরেছি ‘বৃক্ষ’ এ।
তিনি বলেন, যখন নাটক করেছি তখন দলপতি ছিলাম। রোটারীর শীর্ষ পর্যায়ে ছিলাম। যেখানে বিচরণ করেছি সেখানে নিজেকে দর্পিতভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা ছিল। এটা সম্ভব হয়েছে কাজের প্রতি আমার একাগ্রতা ও আন্তরিকতার কারণে। আসলে মানুষ যে কাজটা করবে, সেটা ছোট বা বড় যাই হোক তার মধ্যে আন্তরিকতা থাকতে হবে। যখন সাংবাদিকতা করেছি মনপ্রাণ ঢেলে করেছি। যখন নাটক করেছি সেখানে আন্তরিকভাবে করেছি। চট্টগ্রামে প্রথম যে নাটক প্রযোজনা তা আমার হাত ধরে এসেছে।
তিনি বলেন, আমার দেখা প্রায় ৮৭ দেশের মধ্যে ১৫ দেশের কিছু কথা এসেছে ‘বৃক্ষ’ এ। তবে অরো কিছু বলা- লেখা অধরা থেকে যায়। মনে হচ্ছিল অন্তত ত্রিনিদাদ-টোবাগো, বারবোডাস, জর্দান, মরক্কো, মিশর, সাউথ আফ্রিকা ভিয়েতনাম, লাউস, অজি-কিউই, জার্মান, ফ্রান্স, ইতালিসহ ইউরোপীয় দেশগুলো এবং পাশের দেশ ভারতের আরো কিছু অসাধারণ এলাকা যেমন আন্দামান-নিকোবর, গোয়া, দিও-দমন, বিশাখাপখম, কর্ণাটক, কন্যাকুমারী, রাজস্থানের বিভিন্ন ঐতিহাসিক অঞ্চল ও ইম্ফল নিয়ে লিখলে এই অস্বস্তির বড় অংশ কেটে যেত। হয়তো কখনো ভ্রমণ কাহিনি প্রকাশের সুযোগ পেলে তা পুষিয়ে নেব।
গ্রন্থে পাঠকের জন্য কোনো বিশেষ বার্তা আছে কীনা জানতে চাইলে বলেন, আমি চেয়েছি মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা থাক। এ দুটো আমার জীবনের মূলমন্ত্র। সবার সঙ্গে ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের বন্ধনে জড়িয়ে থাকি। সাথে আমি এটাও বিশ্বাস করি, কেউ জন্মগতভাবে মেধাবী না। মেধাটা অর্জনের। যাদের পিতা-মাতা অনেক মেধাবী ছিল তাদের সন্তানরা মেধাবী হয়নি এমন অনেককে দেখেছি। আবার গ্রামের কৃষকের অনেক ছেলে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে এমন দৃষ্টান্ত আছে। তাই সবক্ষেত্রে অর্জনের জন্য প্রয়োজন একাগ্রতা এবং নিষ্টা। সে বিষয়টাই আমার বইয়ে এসেছে।
প্রসঙ্গত, ওসমান গনি মনসুর বর্তমানে চট্টগ্রামের প্রাচীনতম ইংরেজি দৈনিক ‘দি পিপলস ভিউ’ এর সম্পাদক। তিনি ফটো রির্পোটার থেকে রির্পোটার এবং সম্পাদক হয়েছেন। বর্তমানে কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন এর আর্ন্তজাতিক নির্বাহী কমিটির সদস্য।