বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যত বই

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ২ মার্চ, ২০২২ at ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক স্মৃতি বিজড়িত স্থান চট্টগ্রাম। ১৯৪৩ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে চট্টগ্রামের গভীর সম্পর্ক। তিনি ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন চট্টগ্রাম থেকে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। শেখ মুজিবের ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির প্রস্তাবক ছিলেন চট্টগ্রামের সন্তান। সব মিলিয়ে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে চট্টগ্রামের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। তাই জাতির জনককে নিয়ে আলাদা আবেগ কাজ করে চট্টগ্রামবাসীর। এদের মধ্যে যারা লেখক ও গবেষক আছেন তারা তাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাদের রচনায়।
নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে চলছে অমর একুশে বইমেলা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চট্টগ্রামের অনেক লেখকের বই বেরিয়েছে মেলাকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবন্ধুপ্রেমীরাও কিনছেন সেইসব গ্রন্থ। অবশ্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশিত সব গ্রন্থ মানোত্তীর্ণ বলা যাবে না। কিছু কিছু লেখক কেবল সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়েছেন। তবে কোনো কোনো লেখক বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে আবেগের সঙ্গে তাদের জানার সম্মিলন ঘটিয়েছেন। ফলে কালের আবর্তে তাদের লেখা গ্রন্থগুলো হয়ে উঠতে পারে ইতিহাসের অংশ।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চট্টগ্রামের লেখকদের প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শিরীণ আখতারের ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’, নাসিরুদ্দিন চৌধুরীর ‘বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ও চট্টগ্রাম’, মুহাম্মদ শামসুল হকের ‘টুঙ্গিপাড়ার খোকা যেভাবে জাতির পিতা’, রাশেদ রউফের ‘দশদিগন্তে বঙ্গবন্ধু’, আ.ফ.ম মোদাচ্ছের আলীর ‘নেতা থেকে বঙ্গবন্ধু’, কালাম চৌধুরীর ‘চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু’ ও আখতারুল ইসলামের ‘মুক্তির সুর শেখ মুজিব’।
এছাড়া পাঠকের পছন্দের তালিকায় রয়েছে মুনতাসীর মামুনের ‘গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বঙ্গবন্ধু’, মুস্তাফিজ শফির ‘বঙ্গবন্ধুর অন্তর্লোক’, ড. রবিউল হোসেনের ‘লেখক বঙ্গবন্ধু’, আলীম মাহমুদের ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে শত গীতে অর্ঘ্য’, রফিকুর রশীদের ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের গল্প’, রেজানুর রহমানের ‘বঙ্গবন্ধুর বাড়ি’, সেলিনা হোসেনের ‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু’, সুমন্ত গুপ্তের ‘একজন বঙ্গবন্ধু’ ও জামিল বিন সিদ্দিক সম্পাদিত ‘মুখোমুখি বঙ্গবন্ধু’।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত ধারাবাহিক প্রবন্ধগুলো নিয়ে প্রকাশিত রাশেদ রউফের ‘দশদিগন্তে বঙ্গবন্ধু’ নিয়ে পাঠকের ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা করা গেছে। প্রবন্ধগুলোতে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর নানা ভাবনা। বঙ্গবন্ধুর প্রতি লেখকের ভালোবাসার উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে ‘দশদিগন্তে বঙ্গবন্ধু’-তে।
পাঠকের আগ্রহ দেখা গেছে চট্টগ্রামের তরুণ সাংবাদিক আহমেদ কুতুবের ‘পত্রিকার পাতায় অজানা ইতাহাস মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থ নিয়ে। ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ২৪টি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন স্থান পেয়েছে এ গ্রন্থে। প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে গুরুত্ব সহকারে এসেছেন বঙ্গবন্ধুও। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে রাঙামাটির ফারোয়ায় সম্মুখযুদ্ধে গুলি খেয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ। ১৯৭২ সালে সীতাকুণ্ডের যুদ্ধাহত এ মুক্তিযোদ্ধাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। যে চিঠি এ মুক্তিযোদ্ধাকে আট গুলির ক্ষত ও পঙ্গুত্বের যন্ত্রণা ভুলিয়ে রেখেছে। বিরল সেই চিঠি ও মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদের তথ্য এই গ্রন্থে তুলে ধরেছেন আহমেদ কুতুব।
বঙ্গবন্ধু চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘প্রিয় ভাই, আপনি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে আহত হয়েছেন। এ দুঃসাহসিক ঝুঁকি নেওয়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আপনার মতো নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক বীর সন্তানের স্বাধীনতা উত্তরকালে এ ত্যাগ মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শ হিসেবে প্রেরণা যোগাবে’।
আহমেদ কুতুব আজাদীকে বলেন, বাবা রণাঙ্গনের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় অন্যরকম একটি ভালোলাগা কাজ করত ছোটবেলা থেকে। তাই কর্মক্ষেত্রেও চেষ্টা ছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করার।
‘পাড়াগাঁয়ের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া খোকা (বঙ্গবন্ধু) নামের অনেকটা দুরন্ত ও রোগা টাইপের ছেলেটি কোন যোগ্যতায় বা যাদুর পরশে গ্রাম থেকে শহরে এসে বাঘা বাঘা নেতৃত্বকে পেছনে ফেলে একটা জাতির জন্মদাতা হয়ে উঠলেন তার ধারাবাহিক গল্প’ জানা যাবে মুহাম্মদ শামসুল হকের ‘টুঙ্গিপাড়ার খোকা যেভাবে জাতির পিতা’ গন্থে। গ্রন্থটি রচনার কারণ হিসেবে ভূমিকায় মুহাম্মদ শামসুল হক লিখেছেন, পাঠক-শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকে এমন একটা বই লেখার তাগিদ দিয়েছেন- যেখানে বঙ্গবন্ধুর জন্ম থেকে শৈশবকালে তাঁর বেড়ে ওঠাকালীন স্থানীয় আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশের কথা থাকবে, তাঁর সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক বুদ্ধির বিকাশের পটভূমির কথা থাকবে এবং মিলবে তাঁর সাহসী, প্রতিবাদী ও বিপ্লবী চেতনার উৎসের সন্ধান। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার দীর্ঘদিনের গবেষণার নির্যাস দিয়ে সাজানো এ বই পাঠকের প্রত্যাশা পূরণে সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস।
আ.ফ.ম মোদাচ্ছের আলীা ‘নেতা থেকে বঙ্গবন্ধু’ও পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। বাঙালির বাঁচার দাবি ৬ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর জবানবন্দিসহ নেতা মুজিব কীভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠেছিলেন, ইতিহাসের আলোকে তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেছেন এ গ্রন্থে। ১৯৭২ সালে নিউইয়র্কে টেলিভিশনে ডেভিড ফ্রস্টের নেওয়া বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারটির বেশ কিছু অংশ গ্রন্থটিতে তুলে ধরেছেন, যেখানে উঠে এসেছে পাকিস্তানিদের বর্বরতার ইতিহাস।
আ.ফ.ম মোদাচ্ছের আলী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যত লেখালেখি, বই রচিত হয়েছে বিশ্বের আর কোনো জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার নামে এত লেখা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। ৭৫-এর অবরুদ্ধ সময়েও তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে। তবে গত ১০/১২ বছরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, যা আশার কথা। বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি বলা হয়। তাঁকে অপশক্তিরা আড়াল করে রাখতে চেয়েছিল, কিন্ত পারেনি, পারবেও না। তিনি ইতিহাসের মহানায়ক।
বঙ্গবন্ধুর চট্টগ্রাম অধ্যায় নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ও চট্টগ্রাম’ লিখেছেন নাসিরুদ্দিন চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ঊষাকাল থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের বন্ধনে বাঁধা পড়েন এবং আজীবন এই বন্ধুত্ব অটুট ও অমলিন ছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহের সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে চট্টগ্রামের নাম জড়িয়ে আছে। তিনি ৬ দফা ঘোষণা করেন চট্টগ্রাম থেকে। স্বাধীনতার জন্য গোপন সশস্ত্র বৈপ্লবিক তৎপরতার ক্ষেত্র হিসেবে চট্টগ্রামকেই বেছে নিয়েছিলেন। এসব তথ্য উঠে এসছে ‘বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ও চট্টগ্রাম’-এ।

নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে চলছে বইমেলা। মেলার আয়োজক সিটি কর্পোরেশন। চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য শিল্প-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা সম্মিলিতভাবে এ মেলা বাস্তবায়ন করছেন। মেলা চলবে ১০ মার্চ পর্যন্ত।
আলোচনা সভা : গতকাল বইমেলা মঞ্চে দুটো আলোচনা সভা হয়েছে। সকালে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। বীর মুক্তিযোদ্ধা নঈম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও মুক্তিযোদ্ধা ফাহিম উদ্দিনের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন মুক্তিযোদ্ধা গবেষণা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান, বইমেলা কমিটির আহ্বায়ক কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হারিছ, নূর আলম মন্টু, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রথম কণ্ঠদাতা রাখাল চন্দ্র বণিক, আ জ ম সাদেক, ইদ্রিস আলী, আবুল কাশেম, দেওয়ান মাকসুদ আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম রাজু, সিদ্দিক আহমেদ, ফারুক আহমেদ, বইমেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মহিউদ্দিন শাহ আলম নিপু ও রাজা মিয়া। মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের পক্ষে মশিউর রহমান খান, দিলরুবা খানম, আশেক রসুল চৌধুরী টিপু, ডা. আর কে রুবেল, জসিম উদ্দিন, হাসিনা আকতার, ডা. আয়াজ, মহিউদ্দিন, সিঞ্চন ভৌমিক, হাসান রুমি প্রমুখ।
বিকেলে অনষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। কাউন্সিলর নাজমুল হক ডিউকের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু, ডা. সেলিম জাহাঙ্গীর, চট্টগ্রাম জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু হানিফ, কাউন্সিলর আবুল হাসনাত বেলাল, ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী ও ড. মাসুম চৌধুরী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতারেকের অতি লোভে টাটার ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ বঞ্চিত হয় দেশ : জয়
পরবর্তী নিবন্ধ৮ মাসে সাড়ে ৩৭ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়