আমার অহংকারের একুশ

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৮:২৭ পূর্বাহ্ণ

যখন ফাগুন আসে পলাশের লালিমায়, কৃষ্ণচূড়া ফুল পাপড়ি মেলে দেয়; যখন গ্রেগরিয়ান হিসেবে বছরের চাকা ঘুরে খুলে যায় ফেব্রুয়ারির গৌরবদীপ্ত পাতা, তখন এ শোষিত লাঞ্ছিত বাঙালির হৃদয়ের নিভৃতে কী এক অনুভব, অনুভূতি ভিড় করে। কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, পলাশের লালিমায় কিংবা ন্যায় সত্য সুন্দরের প্রতিষ্ঠায় যখন খুন ঝরে, বাঙালি চেতনায় একুশ জাগ্রত হয় তখনই। আমার সেই অহংকারের একুশ আজ; শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’, ‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা’। বাংলা ভাষায় কথা বলার এই অধিকার দিয়েছে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। বিশ্বজুড়ে মানুষের নিজ নিজ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার অঙ্গীকারের নাম। একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বের মাতৃভাষার জন্য নির্ভয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দেয়ার প্রথম ইতিহাস সৃষ্টির দিন। বাঙালির ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় শোকের দিন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি?’ ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির জন্য শুধু একটি ঐতিহাসিক দিন নয়, আত্মপ্রকাশের মহাবিস্ফোরণ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাঙালির যেকোনো ইতিবাচক আন্দোলন সংগ্রামের ভিত্তিভূমি হলো ২১ ফেব্রুয়ারি। আমরা সবাই জানি, মহান একুশের চেতনার অগ্নিপথে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আসামের বাঙালিরা ১৯৬৬ সালে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছে, পুলিশের গুলিতে সেই আন্দোলনে ১১ জন বাঙালি শহীদ হন। কাজেই যেকোনো বিচারে মাতৃভাষার প্রতি বাঙালিদের আত্মত্যাগ অনেক বেশি।
২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৯০টি রাষ্ট্রে মাতৃভাষার দাবিতে সংগ্রামরত পূর্ব বাংলার দামাল ছেলেদের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে রফিক, বরকত, জব্বার, সালাম, শফিউর, ওয়ালিউল্লাহসহ নাম না জানা আরো অনেক ভাইয়ের আত্মদানের কথা। শহীদ মিনার এখন শুধু এদেশের নয়, হয়ে উঠেছে সারা বিশ্বের নতুন নতুন সংগ্রামের আত্মদানের স্মারক, বিজয়ের প্রতীক, অনুপ্রেরণার উৎস। এই শহীদ মিনার এখন কম্পিত হচ্ছে দেশ-বিদেশের লাখো মানুষের পদচারণায়। আজো যারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নিজের ভাষাকে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সংগ্রামরত, তারা বারবার স্মরণ করবে পূর্ব বাংলার ছাত্র জনতার সংগ্রামী চেতনাকে। উদ্বুদ্ধ হবেন রক্তদানের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে। তাই রফিক, সালাম, বরকতেরা আজ শুধু বাংলার সন্তান নন, তারা আজ বিশ্ববাসীর মনে অবস্থানকারী শ্রেষ্ঠ সন্তান।
১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগোর হে মার্কেটে ৮ ঘণ্টা শ্রমের ন্যায্য মজুরির দাবিতে আত্মদানকারী শ্রমিকরা যেমন বিশ্বময় শ্রমজীবীদের প্রতিনিধিতে পরিণত হয়েছেন, তেমন ভাষা শহীদেরা আজ ভাষার অধিকার আদায়ে বিশ্বময় শ্রদ্ধাবনত এক একটি নাম। একুশ কেবল স্বজন হারানোর বেদনায় সিক্ত অশ্রুবিন্দুর জন্মদিন নয়, এটি আমাদের স্বতন্ত্র জাতি গঠনের অনুপ্রেরণায় বিপ্লবী চেতনার উদ্বোধনেরও দিন।
‘একুশ’ আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে মায়ের মুখের ভাষার জন্য সিনা টান করে কামানের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। ‘একুশ’ আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে বুকের রক্ত দিয়ে মা ও মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে হয়। ‘একুশ’ আমাদের শিখিয়েছে মাতৃভাষার আন্দোলনের অন্তরালে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কীভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়। ‘একুশ’ আমাদের শিখিয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবোধের চেতনা অস্থিমজ্জায় ধারণ করে কীভাবে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হয়। তাই তো একুশের সিঁড়ি বেয়ে বাঙালি ৫৪’র নির্বাচনে, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানে, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে, ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে প্রাণিত হয়েছে। তাই ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’ কেবল আর দশটি স্লোগানের মতো গড়পড়তা রাজনৈতিক বুলি নয়। এটি আমাদের বাঙালি চেতনার স্মারক, আমাদের জাতীয়তাবাদের প্রেরণা এবং আমাদের জাতি চরিত্রের দৃঢ়তার প্রতীক।
একুশ আমাদের আত্মপরিচয়ের ঠিকানা আর ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’। ‘একুশ’ আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের পাটাতন আর মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্গত শক্তি। ‘একুশ’ আমাদের জাতীয়তাবোধের প্রেরণা, স্বাধীনতার প্রণোদনা। একুশ কেবল একটি সংখ্যা নয়, কিংবা ক্যালেন্ডারের সুনির্দিষ্ট কোনো দিন নয়, ‘একুশ’ বাঙালির শৌর্যবীর্যের প্রতীক; বাঙালির বিপ্লবী চেতনার প্রতীক।
একুশের প্রথম প্রহরে অর্থাৎ রাত ১২টা ১ মিনিটে কালো ব্যাজ ধারণ করে এবার চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুল প্রাঙ্গণে নির্মিত অস্থায়ী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। শহীদদের স্মরণে দিনটিতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা ও শোকের কালো পতাকা ওড়ানো হবে আজ। সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও বেতারে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ ছাড়াও প্রচারিত হবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম নগর জুড়ে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানানো হয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) পক্ষ থেকে। এরই মধ্যে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চিহ্নিত স্পটগুলোতে তল্লাশি চালানোর কথা জানিয়েছে পুলিশ।
গতকাল রোববার সিএমপির পক্ষ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, নগরীর নিরাপত্তা জোরদারে একুশে ফেব্রুয়ারি ঘিরে কাজ করবে পুলিশের সাতটি ইউনিট। এরই মধ্যে নগরীর ১৬ থানার পুলিশের পাশাপাশি মাঠে সক্রিয় থাকবে স্পেশাল আর্মড ফোর্স, স্পেশাল উইপন্স অ্যান্ড টেকটিকস (সোয়াট), বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, ক্রাইম সিন ইউনিট, ডিবি ও সাদা পোশাকের পুলিশ। তাছাড়া নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, হোটেল-মোটেল, হাসপাতাল, আবাসিক ভবন, শপিং মল, হাই রাইজ বিল্ডিংয়ে তল্লাশি চালাবে পুলিশের বিশেষ বাহিনী। পাশাপাশি নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে বসানো হবে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। এদিকে ২১ ফেব্রুয়ারির দিন শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে আসা লোজজনকে সার্চ করা হবে আর্চওয়ে গেট ও মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে। ম্যানুয়েল ও অটোমেটিক স্ক্যানিং করা হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকুশে পদক নিলেন এম এ মালেক
পরবর্তী নিবন্ধপারিবারিক কলহের জেরে গার্মেন্টস কর্মীর আত্মহত্যা