ভাষার টানে

সরোজ আহমেদ | বুধবার , ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ১০:১৭ পূর্বাহ্ণ

অসম্ভব সুন্দর একটি দিন আজ! আঁধার কেটে রক্তলাল সূর্য উঠেছে পূর্ব আকাশে। সূর্যের ওই লাল আবীরে মিশে আছে অগণিত ভাষাশহীদের রক্ত। তাঁরা পরম মমতায় চেয়ে দেখছেন আজ জনতার মিছিল। মায়ের ভাষার টানে যখন মানুষ নেমে আসে রাজপথে, তাঁরা কি আর চুপচাপ বসে থাকতে পারেন? রক্ত ও ভালবাসার দামে কেনা মাতৃভাষার জন্য ভালবাসার মিছিলে তাঁরাও নেমে আসেন। মিশে যান জনতার সাথে।
বাড়ির উঠানে বড় আম গাছটাতে হেলান দিয়ে ভোরের রক্তলাল সূর্যের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন অবসরপ্রাপ্ত বীমা কর্মকর্তা শফিকুর রহমান। অন্যমনস্ক হতেই অনেক স্মৃতির ডালা ভিড় করে মনে।
২০ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তানি সরকার সন্ধ্যা থেকে কারফিউ জারি করে। তখনও কেউ বুঝতে পারেনি পরদিন ২১ তারিখে কী ঘটতে যাচ্ছে! শফিকুর রহমান তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকতেন ফজলুল হক হলে। সহপাঠী বরকত হঠাৎ রুমে এসে উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে থাকে। তা দেখে শফিকুর পড়ার টেবিল থেকে উঠে আসেন। ‘কি হয়েছে রে দোস্ত! বাহিরের এখন কী অবস্থা?
‘ওরা নাকি বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করবে। আমরা যে ভাষায় মনের কথা বলি ও লিখি, সে ভাষার উপরে উর্দুভাষা চাপিয়ে দিতে চায়। রাগে আমার রক্ত জ্বলে যাচ্ছে!’
বরকতের কথা শোনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন শফিকুর। বরকতও চুপ হয়ে যান কয়েক মূহূর্ত। হঠাৎ রাগ-অভিমান মিশ্রিত গলায় বলে ওঠলেন, তুই পড়ালেখা করে আখের গোছাতে থাক। পরে দেখবি ভাষাও যাবে, শিক্ষাও যাবে। আর শিক্ষিতরা হবে পাকিস্তানিদের কলুর বলদ। আমি এভাবে বসে থাকতে পারবো না। যদি সঙ্গ দিতে ইচ্ছে হয়, তাহলে চল।
বরকতের কথায় শফিকুরের মনেও মাতৃভাষা ফিরিয়ে আনার স্পৃহা জাগে। সোনালি একটা আলো দেখতে বন্ধু বরকতের হাতে হাত রেখে শপথ নেন তিনি।
চারদিকে হরতালের স্লোগান। মিছিলের পর মিছিল। সবার হাতে ছোট বড় প্ল্যাকার্ড। লাল অক্ষরে তাতে লেখা- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’
‘পুলিশের অত্যাচার, মানি না মানব না’
‘পাক পুলিশ নিপাত যাক, বাংলাভাষা জিন্দাবাদ।’
হাইকোর্টের সামনে ছাত্রদের মুষ্টিবদ্ধ অনেকগুলো হাত উঠল। ১৪৪ ধারা ভাঙার আহ্বানে বক্তৃতা দেন বরকত। জড়ো হয় বিভিন্ন কলেজ-ভার্সিটির ছাত্ররা। সময় যতই যাচ্ছে লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে। মিছিলে স্লোগান তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে।
‘পাকিস্তানের অত্যাচার মানি না মানবো না’
‘আমাদের সব দাবি, মানতে হবে মেনে নাও’
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা, করতে হবে করে দাও।’
সব মিছিল-মিটিং লন্ডভন্ড দিতে সরকার থেকে নির্দেশ আসে। পুলিশ টিয়ারসেল ছুড়ে মঞ্চের দিকে। বিক্ষিপ্তভাবে ছুটোছুটি করতে শুরু করে ছাত্র-জনতা। কাঁদানে গ্যাসের আক্রমণ, অসহ্য যন্ত্রণা সবার চোখে মুখে। রাস্তায় তুমুলভাবে জনতার উত্তেজনতা বেড়ে যায়। একটু পর মিছিল লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে পুলিশ। গুলি খেয়ে রাস্তায় লাশ হয়ে পড়ে থাকে অনেকে।
হঠাৎ একটা গুলি এসে লাগে শফিকুরের বাঁ পায়ে। রক্তে ভেসে যায় রাজপথ। শফিকুরকে বুকে জড়িয়ে উত্তপ্ত রাজপথ থেকে আড়াল হওয়ার চেষ্টা করে বরকত। কিন্তু তার আগেই বুকে বুলেট বিদ্ধ হন বরকত নিজেই। সবকিছু আচানক নিস্তব্ধ হয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ বরকত হাত বাড়িয়ে দেন শফিকুরের দিকে। বরকতকে বাঁচাতে এক পায়ে ভর করে কাঁধে তুলে নেন শফিকুর। কিন্তু কয়েক কদম গিয়ে আর এগোতে পারেন না। গুলিবিদ্ধ পা’টা অবশ হয়ে আসে। বরকতকে নিয়ে রাস্তার উপর বসে পড়েন শফিকুর। এরপর ছটফট করতে করতেই শফিকুরের কোলে মারা যান ভাষা সৈনিক বরকত। তবে মারা যাবার আগে হাতের রক্তাক্ত আঙুলে লিখে যান, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।
‘নানাভাই। ও নানাভাই।’ ডাকতে ডাকতে ঘর থেকে এক দৌড়ে নানাভাইয়ের কাছে আসে তানজিম। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই শফিকুরের। ভোরের রক্তলাল সূর্যটার দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছেন। তানজিম হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘নানাভাই, কি হলো তোমার! প্রভাতফেরিতে যাবে না?’ হঠাৎ চমকে ওঠেন শফিকুর। ভাবনার রাজ্য থেকে ফিরে আসেন বাস্তবে। ‘বাহ, আমার নানাভাইকে তো পাঞ্জাবিতে সেইরকম লাগছে!’
‘তোমাকেও সুন্দর লাগছে নানাভাই।’
‘তাই নাকি? তাহলে আর দেরি কেন। চলো রওনা দেয়া যাক।’
নানাভাইয়ের হাত ধরে প্রভাতফেরিতে যোগ দেয় প্রথম শ্রেণির ছাত্র তানজিম। জীবনে এই প্রথম শহীদ মিনারে এসেছে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। শুধু তাই নয়, তানজিম প্রভাতফেরি শব্দটার সঙ্গেও পরিচিত হয়েছে গতকাল। রাতে নানা শফিকুর রহমান যখন বললেন, ‘তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাও নানাভাই। কাল ভোরে প্রভাতফেরি আছে।’
‘প্রভাতফেরি আবার কি?’ জানতে চাইল তানজিম।
‘ভোরে কালো পোশাকে খালি পায়ে দেশাত্মবোধক বা প্রেরণামূলক সম্মেলক গান গেয়ে পথ পরিক্রম করাকে প্রভাতফেরি বলে।’ শাফিকুর রহমান ঢুক গিলে আবার বললেন, ‘যদি আরও সহজ করে বলি- ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ভোরবেলা খালি পায়ে হেঁটে শহীদ বেদিতে গিয়ে পুষ্পার্ঘ্য অপর্ণ করার নামই প্রভাতফেরি।’
ভোরের মৃদু হিমেল হাওয়ায় রাজপথ থেকে সরে যাচ্ছে ঝরাপাতা। এর মাঝে খালি পায়ে নেমে আসছে নানা বয়সের অজস্র নারী-পুরুষ। সবাই ভাষাশহীদদের স্মরণে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় দলে দলে এগিয়ে যাচ্ছে শহীদ মিনারের দিকে। যেই রাজপথে বায়ান্নে বাংলার দামাল ছেলেরা রক্ত দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে, আজ সেখানে কী ভীষণ সুন্দর মুক্তির আবাহন! এ অন্যরকম অনুভূতি, অন্যরকম ভালো লাগা।
বাতাসে ভেসে আসছে সুমধুর কণ্ঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি….।’
শফিকুর রহমান নাতীর হাত ধরে শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে গলা মিলায় গানের সঙ্গে। হঠাৎ অনুভব করে তার গলার ভেতর দলা পাকিয়ে হু হু করে কান্না আসছে।
‘নানাভাই তোমার চোখে পানি কেন?’ নিরুত্তর নানা শফিকুর। অশ্রু ছলছল চোখে গভীর শ্রদ্ধায় শহীদ মিনারে অর্পণ করেন পুষ্পস্তক। এসময় গাল বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে ফুলের ওপর। একুশের প্রথম প্রভাতের সূর্যের আলোয় চিকচিক করে ওঠে সে অশ্রুকণা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধক্লাশ ও লায়ন্স ক্লাব অব পারিজাত এলিটের ক্যান্সার দিবস পালিত
পরবর্তী নিবন্ধরক্তধূলো মেখে