দিন দিন বিদেশে পাড়ি দেয়ার ছেলেমেয়ে ভাইবোনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। শূন্য হচ্ছে পরিশ্রমলব্ধ অর্থে রঙিন স্বপ্ন দিয়ে সাজিয়ে তোলা বাড়িঘরগুলো খুব অল্পদিনেই। সামর্থবানেরা মাঝে মাঝে ছুটে যাচ্ছে ছেলেমেয়েদের কাছে, কিছুদিন সময় কাটিয়ে ফিরে আসছে দেশে। কেউ কেউ ছেলেমেয়েদের ব্যস্ততার কাছে হার মেনে ফিরে চলে আসেন স্বস্তির শ্বাস ফেলতে। কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে ভুগছে বোবা যন্ত্রণায়। শুধু দেশের বাইরে বলে নয়, একই বাড়িতে মা-বাবা সন্তান বসবাস করলেও, প্রত্যেকেই আমরা ভীষণ একা। এ রুমের খবর অন্য রুম জানে না, মনের খবর তো অনেক দূরের কথা! এ যন্ত্রণা যেমন কারো সাথে শেয়ার করার নয়, ঠিক তেমনি এর জন্য সময় ছাড়া অন্য কাউকে আমরা দায়ী করতে পারি না। ছেলেমেয়ে যখন ছোট তখন ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, ওদের ভবিষ্যৎ সিকিউর করার জন্য বাবা-মা ব্যস্ত থাকেন নিজেদের কর্মক্ষেত্রে বাড়িতে। শত ব্যস্ততার মাঝেও চোখে থাকে সুপ্ত স্বপ্ন। ধীরে ধীরে যে যার সামর্থ অনুযায়ী গড়ে তুলি স্বপ্নের আলয়, সাজিয়ে তুলি রুম ছেলেমেয়ে স্বাচ্ছন্দে বসবাসের জন্য। দিনরাত পরিশ্রম, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এই আলয় গড়তে অর্ধেক বয়স পার হয়ে গেলেও, খালি হতে মোটেও সময় লাগছে না। তখন খালি ঘর পাহারা দেয়া ছাড়া মা-বাবার তেমন কোন কাজ থাকছে না আর, ফিরছে না সন্তান আর দেশে। আমরা বাবামায়েরাও চাইছি সন্তানদের বাইরে সেটেল করতে, কিন্তু কেনো? আমরা আসলে সবাই সন্তানদের নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। প্রথম কারণ হচ্ছে হতাশাব্যঞ্জক শিক্ষাব্যবস্থা। আমরা সত্যিই জানি না আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কোনদিকে হাঁটছে। আমাদের সন্তান মেধা/ আগ্রহ অনুযায়ী বিষয়ে লেখাপড়া করে তাকে যোগ্য করে তোলার সুযোগ পায় না দেশে। কেউ কেউ পরবর্তীতে দেশে ফিরলেও দেশে তেমন সুবিধা না করতে পেরে, সর্বস্তরে অনিয়মের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পেরে আবার ফিরে যায়। এতে করে একদিকে সন্তান যেমন মা-বাবা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে দেশ ও হারাচ্ছে মেধাবী সন্তান। বিত্তবানেরা ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে অর্থের বিনিময়ে লেখাপড়া করাচ্ছে, অন্যদিকে মেধাবী সন্তান বৃত্তি নিয়ে দেশ ত্যাগ করছে। আমরা বাবা মায়েরা ছেলেমেয়ে বাইরে পাঠিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেললেও হয়ে পড়ছি বড্ড একা।
এর জন্য কাউকে কাউকে দায়ী করে সমস্যার সমাধান আসবে না। সময়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। এই পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে চলার জন্য নিজেকে আগে থেকেই প্রস্তুত হতে হবে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে একদিকে যেমন আমাদের কর্মক্ষমতা কমতে থাকে, তেমনি দেখা দেয় বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা। ঘিরে থাকে চিন্তা টেনশন। শুরুতে সন্তানের ভবিষ্যৎ সিকিউর করার জন্য আমরা এতটাই ব্যস্ত থাকি যে পরিবারকে সময় দেয়া বা নিজের জন্য একটু সময় বের করা কারো পক্ষে সম্ভব হয় না। অনেকে সঞ্চিত যা কিছু সব ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ গড়তেই শেষ করে নিজেদের পুরোপুরি ডিপেন্ডেন্ট করে ফেলে। সমস্যা দেখা দেয় তখন, সন্তান যদি এ ভার বহন করার যোগ্য না হয় (আর্থিক কিংবা মানসিক) অথবা আগ্রহ না দেখায়। আবার অনেকে বেঁচে থাকতেই নিজের জায়গা সম্পত্তি ছেলেমেয়ের নামে দিয়ে দেন, এটাও একটা ভুল সিদ্ধান্ত বলে আমার মনে হয়। কেউ নিজের সন্তানকে কম ভালোবাসেন না। মৃত্যুর পর সন্তানই সব ভোগ করবে, কিন্তু আগে সব দিয়ে নিজেকে নিঃস্ব করে, নিজেদের ভার পুরোপুরি সন্তানের ওপর ন্যস্ত করলেই ভালোবাসা প্রকাশিত হয়, তা কিন্তু নয়। এতে বরং নিজেরা দুর্বল হয়ে পড়ে মানসিকভাবে। নিজের হাতে কিছু থাকলে একদিকে যেমন কারো মুখাপেক্ষী না হওয়াতে নিজেদের মনের জোর থাকবে, অন্যদিকে সন্তান-স্বজনের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সাহায্য করে মানসিক তৃপ্তি পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
কালের বিবেচনায় আমাদের নিজেদেরকেই নিজেকে ভালো রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। দিন পাল্টানোর সাথে সাথে নিজেদেরও একটু বদলে ফেলতে হবে। ভালো থাকার প্রথম শর্ত হচ্ছে নিজেকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভালো রাখা। অস্বীকার করার উপায় নেই, যেকোন মানুষ যেকোন সময় অসুস্থ বা অকর্মণ্য হয়ে পড়তেই পারে। কিন্তু নিয়মে চললে অনেক রোগ এবং মানসিক যন্ত্রণা আমরা দূরে ঠেলতে পারি। পরিমিত আহার, সকালে হাঁটার অভ্যাস এর মধ্যে অন্যতম। এর উপকারিতা যারা হাঁটেন তারাই শুধু উপলব্ধি করতে পারেন। বিশেষত আমরা যারা শহরের বাসিন্দা, কায়িক শ্রম খুব কম তাদের জন্য এটা মহৌষধ। এছাড়াও, হাঁটতে গিয়ে অনেক সাথী তৈরি হয়, নিজের অজান্তেই একটা বন্ডিং তৈরি হয়। সকালের এই একটা ঘণ্টা শারীরিক ও মানসিকভাবে আমাদের শক্তিশালী করে তোলে। সমস্যা প্রতিটা পরিবারের সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। একেক জনের সমস্যা একেক রকম। বাসায় বসে টেনশন করলেই সমস্যার সমাধান হয় না। তখনই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, যখন সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করে, মেধা বুদ্ধি অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা যায়। শারীরিক সক্ষমতা বজায় রাখার জন্য বাড়ির ছোটখাটো কাজগুলো যেটুকু পারা যায় নিজেই করা উচিত। নিজের পছন্দের যে কোন ছোটবড় কাজে নিজেকে যতটা সম্ভব ব্যস্ত রাখতে পারলে সময় ভালো কাটবে, যা একাকীত্ব বা হতাশা কাটাতে সাহায্য করবে। বই পড়া, লেখালেখি, রান্না-বান্না, সেলাই, বাগান করা, ঘর গোছানো, অল্পস্বল্প শারীরিক কসরত, হালকা খেলাধুলো ইত্যাদি নানান রকম অনেক কাজ আছে যা করে অনেকেই আনন্দ পায়। পছন্দের কাজ করলে সময় তথা জীবন অনেক ভালো কাটবে। মাঝে মাঝে বেড়াতে গেলেও মন আনন্দিত হয়। সময়ের দাবি-কাজে ব্যস্ত থাকি, হতাশা/একাকীত্ব দূরে রাখি।
হতাশা বা একাকীত্ব নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে সাধারণত দেখা যায় না, কারণ নিম্নবিত্ত পরিবারের প্রতিটা সদস্যকে আজীবন যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়। জীবিকা নির্বাহের জন্য যেখানে প্রতিনিয়ত তাদের সংগ্রাম করতে হয়, সেখানে হতাশা, একাকীত্ব ইত্যাদি শব্দগুলোর সাথে তারা ঠিক পরিচিত নয়।
সময় যা এসেছে আমাদের সবার এব্যাপারটা নিয়ে বিশেষভাবে ভাবা দরকার। বিত্তের আধিক্য থাকা সত্ত্বেও আজ অনেকেই একা হয়ে পড়ছে। ছেলেমেয়েরা বাইরে সেটেল্ড, মা হয়তো তাদেরই প্রয়োজনে স্বামী সংসার ফেলে তাদের কাছে, এটা আবার শেষ বয়সের আরেকটা যুদ্ধ। কেউ হয়তো স্বামী-স্ত্রী একসাথে, অসুস্থ হলে দেখবার কেউ নেই। ঠিকঠাক লোক পাওয়াও সহজ কথা নয়, পয়সা থাকলেই সব পাওয়া যায় না। অসুস্থ, শারীরিক অক্ষম বয়োবৃদ্ধদের সবচাইতে বড় সমস্যা। আমার প্রায় সময় মনে হয়, এমন যদি কোন জায়গা থাকতো, যেখানে যাদের সামর্থ আছে তারা টাকার বিনিময়ে ওখানে থাকতে পারবে, যেখানকার পরিবেশ হবে খুব সুন্দর, পরিচ্ছন্ন সাজানো গোছানো থাকার ব্যবস্থা, অসুস্থদের সেবা ব্যবস্থা, সুন্দর বাগান, ছোট একটা লাইব্রেরি, টিভি দেখার সুব্যবস্থা, কিছু মিউজিকেল ইনস্ট্রুমেন্ট, ইনডোর কিছু গেমস্, বেশ একটু বড় জায়গা জুড়ে কিছু ফুল ও ফলের গাছ যেখানে পাখি প্রজাপতি উড়ে বেড়াবে, হাঁটাহাঁটি করার সুন্দর প্যাসেজ ইত্যাদি ভালো থাকা যায় এমন এক সুন্দর আলয়। এমন ব্যবস্থায় সমবয়সী একাকী মানুষগুলো যদি একসাথে থাকতে পারে, তাহলে পরিবারের সদস্যদের মত বাস করতে পারবে। সমবয়স্ক সমব্যথী মানুষগুলো হবে একে অপরের বন্ধু। যারা সক্ষম তারা তাদের দক্ষতা অনুযায়ী সেখানকার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবে, জীবনের শেষ সময়টা একটু ভালো থাকার প্রচেষ্টা।
আমার বিশ্বাস অনেকেই বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন, হয়তো সহসাই চিঠি আসবে সে ঠিকানা থেকে, আমরা আছি অপেক্ষায়…
বর্তমান বৃদ্ধাশ্রম মানেই চোখে ভেসে ওঠে অবহেলিত, নিগৃহীত, জীবন সংগ্রামে পরাজিত মা-বাবার অনাকাঙ্ক্ষিত, মানবেতর জীবন! পরিবর্তন প্রয়োজন। সরকারও সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে পারে এই বৃদ্ধাশ্রমগুলোর পরিবর্তন পরিবর্ধনে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার