হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী কিছু পেশা

বাসুদেব খাস্তগীর | মঙ্গলবার , ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:১০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বেশ সমৃদ্ধ, আবার নানান বিচিত্রমুখী। বিচিত্রমুখী বলছি এজন্য যে, এক সময় এদেশের গ্রাম বাংলায় এমন সব প্রথা, রীতিনীতি বা বিশ্বাসের কারণে এমন কিছু কার্যকলাপ প্রচলিত ছিলো, যেগুলো কোন রূপকথার কল্পকাহিনী নয়, ছিলো গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে এসবের একসময় রমরমা দিন। কালের আবর্তে সেগুলোর অনেকগুলোই এখন হারিয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে, আর কিছু হয়তো কোনক্রমে একবারে মৃতপ্রায় হয়ে ঠিকে আছে। কিন্তু বলা যায় জীবিকার তাগিদে সেসব কার্যকলাপ এখন আর মোটেও চোখে পড়ে না। গ্রামীণ সমাজে বেড়ে ওঠা একটি প্রজন্ম এসব পেশাগত কার্যকলাপের সাথে মোটেও পরিচিত নয়। আর শহরে বসবাস করা অনেক মানুষের কাছে এসব কার্য যেন রীতিমত গল্পের কাহিনীর মত। সমাজে একসময় বিশ্বাস বলুন বা কুসংস্কারই বলুন এসমস্ত কার্যকলাপকে ঘিরে একশ্রেণির পেশাদার মানুষ গড়ে উঠেছিলো যা গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতো জীবন এবং জীবিকার তাগিদে এবং গ্রাম বাংলার কিছু মানুষ বিশ্বাস বা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে কিংবা কেউ কেউ বিনোদনের খোরাখ হিসাবেও এ সব কার্যকলাপকে সানন্দে গ্রহণ করতো। বর্তমান প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে মানুষের মধ্যে চিন্তা চেতনার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে, শিক্ষা ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে, কূপমণ্ডূকতা ও কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মানুষ বেরিয়ে এসে তথ্য প্রবাহের অবাধ স্রোতধারায় নিজেকে সামিল করেছে। ফলে গ্রামের মানুষের আগের চিন্তা চেতনায় ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে হয়তো সেই সমস্ত পেশাজীবীরা যারা মানুষের অন্ধ বিশ্বাসকে পুঁজি করে গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াতো তারা আজ হারিয়ে যাবারই দলে। গ্রাম- গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ানো তেমন কিছু পেশাজীবী যাদের অস্তিত্ব এখন বিস্মৃতপ্রায়।
গাজীর গান-গাজীর গান গাজী পীরের বন্দনা ও এক ধরনের মাহাত্ম্য গীতি। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় এই গাজীর গান চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, নোয়াখালী ও সিলেট অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিত্র দেখিয়ে গাজীর গান গেয়ে বেড়াত বেদে সমপ্রদায়ের একটি অংশ। তার মধ্যে মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ,কুমিল্লা,চাঁদপুর, ফরিদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে নরসিংদী অঞ্চলেই এমন বেদেদের বিচরণ ছিল বেশি। এ সমপ্রদায়ের মানুষ গ্রামে গ্রামে গিয়ে গাজীর গান গেয়ে ধান অথবা টাকা নিতো, যা দিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো। এভাবে করে এক সময় গাজীর গান বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে যায়। নানা ধরনের উদ্দেশ্য সাধন যেমন সন্তান লাভ, রোগব্যাধি দূর, অধিক ফসল উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতিসহ মনের নানা ইচ্ছে পূরণার্থে গাজীর গানের পালা দেওয়া হতো। আসরে থাকত গাজীর পট, যাতে কারবালার ময়দান, মক্কার কাবাগৃহ, কাশীর মন্দির ইত্যাদি পবিত্র স্থানসমূহ অঙ্কিত হতো। গানের দলে ঢোলক ও বাঁশিবাদক এবং ৪-৫জন দোহার থাকত। দলনেতা গায়ে আলখাল্লা ও মাথায় পাগড়ি পরে একটি আসা দণ্ড অবিরাম দুলিয়ে দুলিয়ে এবং লম্বা পা ফেলে আসরের চারদিকে ঘুরে ঘুরে গান গাইত, আর দোহাররা তা পুনরাবৃত্তি করত এবং বাদ্যের তালে তালে গাজীর গান চলত। প্রখ্যাত গবেষক আশরাফ সিদ্দিকী গাজীর গান সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন ‘মূল গায়েন প্রথমে বন্দনা গাইত ‘পুবেতে বন্দনা করি পূবের ভানুশ্বর। এদিকে উদয় রে ভানু চৌদিকে পশর…তারপরে বন্দনা করি গাজী দয়াবান। উদ্দেশে জানাই ছালাম হেন্দু মোছলমান।’ এরপর গাজীর জন্মবৃত্তান্ত, দৈত্য-রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ, রোগ-মহামারি ও নানা বিপদ-আপদে দুষ্ট আত্মার সঙ্গে যুদ্ধ, অকুল সমুদ্রে ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে পুণ্যবান ভক্ত সওদাগরের নৌকা রক্ষা এসব বর্ণনা করা হতো।’ গাজীর চরিত্রের মধ্যে এক ধরনের অসামপ্রদায়িক চরিত্র ধারণ করার প্রচেষ্টা থাকত। সেজন্য গাজী পীর মুসলমান হলেও হিন্দু-মুসলমান সবাই তাঁর ভক্ত ছিল। গাজীর গানে উঠে আসতো সমাজের বিভিন্ন আচার-বিচার ও সমস্যা। গাজীর গান চলার সময় আসরে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা তাদের মানতের টাকা-পয়সা গাজীর উদ্দেশ্য দান করত। গ্রাম বাংলার বাড়ির বাড়ির উঠোনে এ গাজীর গানের আসর বসতো। গাজীর গান শোনানোর জন্য পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতো সেই গায়ক। কখনও একা বা কখনও দুএকজন সাথি নিয়ে ‘গাজীর গান গাজীর গান’ বলে ডাক দিতো। আগ্রহীরা ডেকে গাজীর গানের আসর বসাতো। আশপাশের অনেক লোক গান শুনতে উঠোনে ভিড় করতো। সেসব স্মৃতি এখন শুধুই ইতিহাস। বর্তমানে এ গানের প্রচলন নেই বললেই চলে।
সাপের খেলা-বেদে সমাজ বেশ কিছু গোত্রে বিভক্ত। বেদে সমাজের মধ্যে সাপুড়িয়া গোষ্ঠীর পুরুষের মূল কাজ হলো সাপ ধরা। নারী-পুরুষ উভয়ই গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে সাপ খেলা দেখিয়ে সংসার চালাতো। এই সাপুড়েদের অনেকে এখনও জনপদে ঘোরে এবং সাপের খেলা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে এদের ঝাঁপিতে করে সাপ নিয়ে একসময় ঘুরতে দেখা যেতো। প্রকৃতপক্ষে সাপ ভালো শুনতে পায় না, তাই মাটিতে সাপুড়ের পা ঠোকা এবং বাঁশি দোলার কসরতে এরা হেলে-দুলে সাড়া দেয়। এটাই সাপের নাচ তথা সাপের খেলা। বেদে সমপ্রদায়ের এটি একটি আদি খেলা। সাপ এমন একটি প্রাণী যাকে সবাই ভয় পায়। সাপ দেখলেই সবার দেহে এক ধরনের ভয়ের শিহরণ জাগে। সেই সাপকে নিয়ে বেদে সমপ্রদায় পাড়ায় পাড়ায় একসময় খেলা দেখাতো। বাঁশির সুরে সুরে সাপুড়ে তাঁর হাঁটু দুলিয়ে সাপকে ফণা তুলে নাচতে সাহায্য করতো। সাপুড়ের কথা শুনে সাপ যেন মানুষের কাছে আনন্দ উপভোগের খোরাক হয়ে উঠতো। বাড়ির উঠোনে এই সাপের নৃত্য চলতো সাপুড়ের তত্ত্বাবধানে। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ সাপুড়েদের নিয়ে এ আনন্দে মেতে উঠতো। বেদে সাপুড়েরা এক ধরনের ছোট খাঁচায় ভরে বিভিন্ন ধরনের সাপ নিয়ে আসতো। অত্যন্ত স্বাভাবিক মেজাজে সাপগুলো যখন বেদে সাপুড়েরা হাত দিয়ে বের করে আনতো তখন অনেকের ভয়ে গা শিরশির করে উঠতো। সাপগুলো হাতে প্যাঁচাতো, গলাতে প্যাঁচাতো। জীবিকা অর্জনের উপায় হিসাবে তাদের এ পেশা অনেকের কাছে ভয়ংকর এক পেশা হিসাবে মনে হতো। এই সাপুড়েদের খেলাও এখন সুদূর অতীত। মানুষ এখন এসব খুব কম বিশ্বাস করে। সেজন্য গ্রামাঞ্চলে এদের আর তেমন দেখা যায় না বললেই চলে। তবে হাটবাজারে কোথাও কোথাও এদের এখনও দেখা মেলে।
বানরের গণনা- স্তন্যপায়ী প্রাণীদের অন্যতম আদি প্রাণী বানর। দুষ্টুমি আর অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ডের জন্য বানর সবার কাছে পরিচিত এক নাম। বুদ্ধিমান শ্রেণির এই প্রাণী বেশির ভাগ প্রজাতির গাছেই বসবাস। বানর হাত-পায়ের সাহায্যে এক গাছ থেকে অন্য গাছে চরে বেড়ায় এবং ঝুলে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে ছয় প্রজাতির বানর আছে। মানুষের সঙ্গে বানরের অনেক মিল রয়েছে, যেমন মানুষ ও বানরের রক্তের গ্রুপ এক। মানুষের যেমন এ, বি, এবি এবং ও গ্রুপের রক্ত রয়েছে, তেমনি বানরদেরও আছে। সেই সঙ্গে মানুষের মতো বানরদেরও পজিটিভ-নেগেটিভ রক্তের গ্রুপ আছে। মানুষের যেমন সর্দি-কাশি হয়, তেমনি বানরেরও হয়। বানর সাংকেতিক চিহ্নের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। এমনকি মানুষের সংকেতও বুঝতে পারে। বানরের এই বুদ্ধিমত্তাকে পুঁজি করে এক শ্রেণির মানুষ বানরকে নিয়ে মানুষের ভাগ্য গণনার কার্যে নিয়োজিত হতে দেখা যেতো। এ শ্রেণির মানুষেরা একসসময় গ্রামাঞ্চলে বাঁশের লাই বা খাঁচাতে করে বানরকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। আর ‘বানরের ভাগ্য গণনা’ ‘বানরের ভাগ্য গণনা’ বলে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতো। কালের আবর্তে অনেক কিছু হারিয়ে যাবার মধ্যে এ শ্রেণির পেশাও যুক্ত হয়েছে। মানুষের মধ্যে বিশ্বাস, কুসংস্কার এগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে এ ধরনের পেশাও আজ ইতিহাসে ঠাঁই নিয়েছে। কিন্তু আবহমান বাংলার এক সময়কার ঐতিহ্য হিসাবে তাকে অস্বীকার করা যায় না।
এমন একটা সময় ছিল যখন গ্রামীণ জনপদে গাজীর গান, সাপের নাচ কিংবা বানরের খেলা দেখার জন্য ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা ছুটে আসতো। এখন আর সে সব খুব একটা চোখে পড়ে না। এসব বিষয় এক সময় আমাদের চলচ্চিত্র ও নাটকেও দারুণভাবে উঠে এসেছে। গাজীর গান, সাপের খেলা, কিংবা বানরের গণনার মত চমৎকার বিষয়গুলো কখনও কখনও চলচ্চিত্র বা নাটকে খণ্ডিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বেদে সাপুড়েদের নিয়ে পুরো চলচ্চিত্র ও নাটকও তৈরি হয়েছে। তবে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এসব সংস্কৃতি। ব্যবসায় মন্দা দেখা দেওয়ায় তারা সমাজের মূলধারার অন্যান্য পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন এ শ্রেণির পেশাজীবীরা। সময়ের স্রোতে স্বাভাবিক জীবন বেছে নিচ্ছে ওরা। পেশাগত এ জীবন ছেড়ে তারা এখন উঠে আসছে শহরে-নগরের অন্যান্য পেশার স্‌্েরাতে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক; অধ্যাপক, বিএম কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধআপনার ব্যাংক হিসাব কে তদন্ত করতে পারবেন ?
পরবর্তী নিবন্ধকমরেড নাসির উদ্দিন ও আজকের বিকৃত রাজনৈতিক সংস্কৃতি