কমরেড নাসির উদ্দিন ও আজকের বিকৃত রাজনৈতিক সংস্কৃতি

কানাই দাশ | মঙ্গলবার , ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

কমরেড নাসির উদ্দিনের অকাল মৃত্যুর ৩১ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৮০ এর দশকে গণতন্ত্রের দাবীতে প্রদীপ্ত প্রত্যয়ে রাজপথ কাঁপানো টগবগে তরুণ ও বিপ্লবী নেতা নাসির দেশে ১৯৯১ সালে ‘ভোটের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার পূর্ব মূহুর্তে নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় সে বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ মৃত্যুবরণ করে। আমার অনুজ নাসিরের এ মৃত্যুতে বোয়ালখালী সমাজ ও রাজনীতির এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়, যে ক্ষতি এখনও আমরা সামলে উঠতে পারিনি। নাসিরের মত ও পথের অনুসারীদের ঐকান্তিক ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় হয়তো আমরা একদিন সেই হারানো অবস্থান ফিরে পাব। তাই প্রতি বছর কমরেড নাসিরের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা সমবেত হই, তার স্মৃতি তর্পণ করি। নতুন করে প্রতিজ্ঞা করি সমস্ত বিভেদ আর মত পার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে মানবমুক্তির সুমহান লক্ষ্যাদর্শকে সামনে রেখে দৃপ্ত পদে এগিয়ে যাবার। তার স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠিত “নাসির উদ্দিন ফাউন্ডেশন” নাসিরের আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য নতুন প্রজন্মের মাঝে দেশপ্রেমের মশাল জ্বালিয়ে রাখার জন্য অনলস কাজ করে যাচ্ছে। এ জন্য তারা ধন্যবাদার্হ।
নাসির উদ্দিন ১৯৬১ সালে বোয়ালখালির আহ্‌লা শেখ চৌধুরী পাড়ায় জন্মগ্রহণ করে। সে ছিল এক মেধাবী ছাত্র। কৃতিত্বের সাথে সে ১৯৮৫ সালে রসায়ন শাস্ত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এসসি ডিগ্রী লাভ করে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার মোহ তাকে পেয়ে বসেনি। লোভনীয় সরকারী চাকুরীর অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরী নিয়েছিল- মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকার জন্য, নির্বিঘ্নে তার রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাবার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষায়। হ্যাঁ নাসির রাজনীতি করত। সে ছিল বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি (সিপিবি)র একজন জেলা সংগঠক। গণমানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিল সেই রাজনীতি। মার্কসীয় প্রতীতি থেকে সে বিশ্বাস করতো সমাজ পরিবর্তনের অনিবার্যতায়। এক বিশ্বজনীন পরিবর্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী ছিল সে। সেই বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গী ছিল বিজ্ঞানমনস্ক, নির্মল, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও কুসংস্কারমুক্ত। এ এমন এক বিপ্লবী চেতনা যা তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করত-অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে। তারুণ্যের এক ক্রুদ্ধ আবেগ সব সময় তার মধ্যে কাজ করত। ১৯৯১ সালে সিপিবি ও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ঐক্যের কারণে সিপিবি বোয়ালখালীতে সেবার নৌকা প্রতীকের পক্ষে কাজ করছিল কিন্তু আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে পরজয়ের আশংকা সেদিন সে অস্থির হয়ে পড়ে। এ নিয়ে মৃত্যুর মাত্র ঘন্টা দুয়েক আগে রাত ১১টার দিকে সে আর আমি এক সাথে বৈঠক করি। এটা যে তার শেষ রাজনৈতিক বৈঠক হবে তা দুজনের কেউ ভাবিনি। যাই হোক পরের দিনের কাজের কর্মসূচী ঠিক করে যে যার বাড়ী চলে যাই। অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব মূহূর্তেও সে নিবেদিত ছিল দেশের কাজে। স্বল্প কয়দিনের রাজনৈতিক জীবনের মধ্যেও এক সময়ের পশ্চাদপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি প্রভাবিত নিজ এলাকায় সে এক ঝাঁক বিপ্লবী চেতনা সমৃদ্ধ তরুণ প্রগতিশীল কর্মী তৈরী করে- যা অনেক বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা সারা জীবন রাজনীতি করেও করতে পারেননি। এখানেই নাসির উদ্দিনের সাথে অন্যান্য অনেক বিপ্লবী নেতার পার্থক্য। আজ তার মৃত্যুর ৩১ বছর পরেও তারই দেখিয়ে যাওয়া আদর্শের লাল পতাকা এই এলাকার কর্মী বন্ধুরা নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বহন করে চলেছে। আলোকিত করে চলেছে এ অঞ্চলের সামাজিক-রাজনৈতিক অঙ্গন। এখানেই তার রাজনৈতিক জীবনের চরম সার্থকতা।
লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি “ভোটের গণতন্ত্র” প্রতিষ্ঠার পূর্ব মূহূর্তে অর্থাৎ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের বিজয়ের পরে অনুষ্ঠিত ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগেই কমরেড নাসির উদ্দিনের মৃত্যু হয়। সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী দীর্ঘ রক্তাক্ত আন্দোলনের সফল সমাপ্তিতে ১৯৯১ সালে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। সেই থেকে নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে মোটামুটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে চারবার রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কালীন নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৪ সাল থেকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নামে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থা এখন প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা অনুপস্থিতিতে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে চলছে দুর্বৃত্তায়ন। সমাজজীবন আজ নানামুখী অনাচার, ধর্মান্ধতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। প্রকৃত গণতন্ত্র আবারও সুদুর পরাহত হয়ে পড়েছে। বিগত ৩০ বছর ধরে বিশ্ব ব্যাংক ও আই.এম.এফ নির্দেশিত সামরিক স্বৈরাচারের অর্থনৈতিক দর্শনে চলছে নির্বাচিত সরকার সমূহ। মানুষের মৌলিক অধিকার তথা “ভাতের গণতন্ত্র” প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কঠিন হয়ে পড়েছে। এই কারণে বার বার ভোটের গণতন্ত্র ও হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। লোটেরা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা মানুষের নির্বাচনী ভোটাধিকারকে ও ধ্বংস করে দেয়। প্রাইভেটাইজেশন ও অবাধ লুটপাটের সুযোগে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি আজ মাত্র গুটিকয় মানুষের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে গেছে। কিছু দুর্বৃত্ত অকল্পনীয় সম্পদের মালিক হয়ে বসেছে। জাতীয় সংসদে শতকরা ৮০ ভাগ সদস্য এখন লুটেরা ব্যবসায়ী। ফলে রাজনীতি এক লাভ জনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এখন নষ্ট রাজনীতি ও লুটেরা ব্যবসার এই মিলিত দুষ্ঠু চক্রই দেশের প্রকৃত শাসক গোষ্ঠী। এই রাজনৈতিক ব্যবসায়ীরা এখন দুই বড় দলেই প্রভাবশালী। ক্ষমতার খেলায় সম্প্রতি বিএনপি রাজনীতিতে ব্যাকফুটে চলে গেলেও দুই বৃহৎ দলই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চাইছে না বা পারছে না উল্লেখিত শাসক গোষ্ঠীর স্বার্থে। এই লুটেরারাই এখন সমাজ ও রাজনীতির “রোল মডেল”। এখানেই দেশের অগ্রগতির মূল সংকট নিহিত। দুই বড় দলের মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক তথা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থাকলেও অর্থনৈতিক দর্শন তাদের এক-তথাকথিত মুক্ত বাজার অর্থনীতি। দেশের সম্পদ লুটপাটের ক্ষেত্রে এদের কোন বিরোধ নেই। ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দেয়নি দু’দলে এমন নেতার অভাব নেই। ব্যাপক দুর্নীতির কারণে প্রতি বছর দেশে অনধিক ৫০ হাজার কোটি কালো টাকার সৃষ্টি হচ্ছে। এই টাকাকে নানা ভাবে বৈধ বা সাদা করার চেষ্টা চলছে। এই নিয়ে দু’দলের কোন আপত্তি নেই। গত ১০ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা। তীব্রতর হচ্ছে সামাজিক বৈষম্য।
বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে চলে আশা বিচারহীন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখে মনে হয় সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দর্শনেও দুই বৃহৎ দল এখন কাছাকাছি চলে এসেছে। আবার উভয়দলের সাংসদরা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পদ্ধতি, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার তীব্র বিরোধী। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদকে স্বশাসিত ও শক্তিশালী করে তৃণমূলে গণতন্ত্রকে দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে উভয়দলের অনীহা লক্ষ করা যায়। ফলে বর্তমানে দুই তৃতীয়াংশ উপজেলা চেয়ারম্যান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লোক হলেও ক্ষমতাহীন অবস্থায় তারা তিন বছর পার করে দিয়েছে। নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য দু-দলেই সমানে চলে। দুই দলেই দীর্ঘদিনের ত্যাগী, পরীক্ষিত ও গণসম্পৃক্ত নেতারা কোন ঠাসা। ফলে স্বৈরাচার পরাভূত হলেও তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার দেশে শুধু অব্যাহত আছে তা নয় দিনে দিনে তা আরো শক্তিশালী হয়েছে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী ধর্ম ব্যবসায়ী খুনীরা দুই দলের সাংঘর্ষিক রাজনীতির সুযোগে নিজেদের দ্রুত সংগঠিত করে ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছে। জনমতের চাপে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতার করে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের না মুখী ব্যর্থতাও দ্রুত হ্রাস পেতে থাকা জনপ্রিয়তার সুযোগ শাসকদলও বিএনপির ঘাড়ে চেপে তারা পার পেয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কেননা গণতন্ত্রহীনতার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বিকশিত হয়। সামগ্রিকভাবে বলা যায় এই সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক অর্থনীতি, বড় দল দুটোর নীতিহীন রাজনীতি, সরকার ও দলসমূহের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত জবাবদিহিতার অভাব, দুই বড় দলের চরম পরমত অসহিষ্ণুতা, নিজেদের দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিলোপ, ব্যক্তি ও পরিবার কেন্দ্রিক রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, সর্বগ্রাসী দুনীতি, লুটেরা অর্থনীতি ও তার অনুষঙ্গ চরম দুর্নীতিবাজ গণবিরোধী আমলাতন্ত্রের শাসন সব মিলিয়ে গত দীর্ঘদিন ধরে দেশে এক বিকৃত রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সংস্কৃতির চর্চা ও প্রতিষ্ঠা চলেছে। এদেশের মানুষ বার বার স্বপ্ন দেখে, সংগ্রাম করে, ভোট দেয় কিন্তু বার বার সে প্রবঞ্চিত হয়। কোন বিকল্প না পেয়ে মানুষ আজ অসহায়ভাবে এই দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক অর্থনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। ধর্মচর্চার নামে সাম্প্রদায়িক সামাজিক মনস্তত্ব আজ প্রধান সামাজিক উপাদানে পরিণত হয়েছে এই কারণে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যলঘুরা হিংস্র সাম্প্রাদায়িক সন্ত্রাসের শিকার হলেও এই অসুস্থ রাজনীতির জন্য তা সামাজিক আলোড়ন সৃষ্টি করে না। শুধু বাম পন্থীরা নৈতিক অবস্থান থেকে সীমিত শক্তি নিয়ে তার প্রতিবাদ করে থাকে। অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন রাজনৈতিক সংস্কৃতির আপোষহীন কর্মী ছিলেন কমরেড নাসির উদ্দিন।
আপাত অপ্রতিহত এই লুটেরা আর্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে, ধর্মান্ধ দক্ষিণ পন্থী প্রতিক্রিয়ার প্রভাব থেকে দেশকে বের করে আনার পথ কি? সহজ উত্তর হলো কমরেড নাসির উদ্দিনের প্রদর্শিত পথে শ্রমজীবী জনগণকে সংগঠিত করা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে তীব্র শ্রেণি সংগ্রাম গড়ে তোলা, মানুষের প্রতিদিনের জীবনের নানা সমস্যার সাথে নিজেদের নিয়ত সম্পৃক্ত রাখা, প্রতি এলাকায় কমরেড নাসিরের মত অসাম্প্রদায়িক নিবেদিত কর্মিষ্ঠ দেশ প্রেমিক তৈরি করা, একটি সুস্থ স্বচ্ছ কল্যাণকামী রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা। এই কঠিন সংগ্রামের নিশ্চিত বিজয়ের জন্য কমরেড নাসির উদ্দিনের পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে। বিকল্প বাম গণতান্ত্রিক ধর্ম নিরপেক্ষ প্রগতিশীল ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটাতে হবে। এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া মনে হলেও বিরাজমান অন্ধকার থেকে উত্তরণের, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত লক্ষ্যাভিসারী উন্নত বৈষম্যহীন রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আর অন্য কোন পথ খোলা নেই। কমরেড নাসিরের স্মৃতি চির জাগরুক থাকুক।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ

পূর্ববর্তী নিবন্ধহারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী কিছু পেশা
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে মাটি কাটার দায়ে জরিমানা