দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

চায়নিজ বুদ্ধা, লাফিং বুদ্ধা

তিন তলায় উঠার সিঁড়ি দুদ্দাড় ভেঙ্গে উপরে উঠে দু’পুত্র সিঁড়ির গোড়ায় অপেক্ষায় ছিল এতোক্ষণ। এই মাত্র আমাদের দেখা মিলতেই দু’জনে দিল দৌড় বাঁ দিকে। দেখে তা সাথে সাথেই মনে পড়ল মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সেই কথা, মানে ‘ইন্স্যানিটি ইজ ডুয়িং সেইম থিং ওভার এন্ড ওভার এগেইন এন্ড এক্সপেক্টিং ডিফারেন্ট রেজাল্টস’ !
বোঝা গেল একটু আগে দোতালায় উঠে ডান দিকে গিয়ে হতাশ হওয়াতে পুত্ররা এবার দিক বদলেছে, তা দেখে হৃষ্টচিত্তে কিছুটা দ্রুত পায়ে ওদের অনুসরণ করে গিয়ে প্রথম খোলা দরজাটি, যেটি দিয়ে একটু আগেই ভেতরে ঢুকে পড়েছে ওরা, হাজির হলাম সেই ঘরে।
এ ঘরে পা দিয়েই চারদিকে তাকিয়ে মনে হল আসলাম বুঝি চেনা কোন জায়গায়! বিরাট এই হল ঘরের গোটাটাতেই দেখছি চারিদিকে নানান ভঙ্গিমায় বিরাজ করছেন মহামতি বুদ্ধ! মনে পড়লো পদ্মাসনে আসীন চোখ বন্ধ করা ধ্যানমগ্ন মহামতি বুদ্ধের মূর্তি প্রথম দেখেছিলাম, আব্বার সাথে শৈশবে কুমিল্লার শালবনবিহারসংলগ্ন ময়নামতি যাদুঘরে। তারপর যতোখানেই বুদ্ধের যতো নতুন তৈরি বা পুরাকীর্তির মূর্তি দেখেছি, কেন জানি সেই স্মৃতিটাই ঘাই দিয়ে উঠেছে মনে। এছাড়া এই বছর কয়েক আগেই তো ছিলাম শ্রীলংকায় পেশাগত কারণে। ওখানে তো দিকে দিকেই শান্তির বাণী ছড়ানো বুদ্ধের নিমগ্ন ধ্যানের মূর্তি স্থাপিত। আরো আছে অসংখ্য প্যাগোডা বলা চলে প্রতিটি রাস্তার মোড়ে। অথচ সেই দেশটিই কিনা লিপ্ত ছিল তিরিশবছর ব্যাপী এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে! মানুষের বিশ্বাস আর কর্মের এই এই তুমুল দ্বিচারিতা প্রায়শই সৃষ্টি করে নিজের ভেতরে তুমুল বিবমিষা !
সে যাক, এ চিন্তার লেজ ধরেই স্পষ্ট হল গত কয়েকদিন চায়নার এই বান্দর বছর উপলক্ষে নানান জায়গায় নানান ভঙ্গিমায় স্থাপিত নানান রকম বান্দরের প্রতিকৃতি দেখে দেখে চেতনে অবচেতনে প্রতিমুহূর্তে যখন বিরাজ করছিল অচেনা চায়না ভাব, এখন এই কক্ষে পা দিয়ে এতো এতো বুদ্ধের মূর্তি দেখে তাই বুঝি মনে হয়েছিল চকিতে, এসেছি বুঝি কোনো চেনা জায়গায়!
দ্রুত গোটা ঘরটির দিকে ফের চোখ বুলিয়ে বুজতে চাইলাম শুধুই কি বুদ্ধের মূর্তিই আছে এখানে ? নাকি আছে অন্য কোনো পুরাকীর্তিও ?
নাহ, আসলেই ঢুকে পড়েছি বুদ্ধের সাম্রাজ্যেই। তা কোনদিক থেকে দেখা শুরু করবো? এ ভাব মনে আসতেই তা জোর করে দূরে ঠেলে শুরু করলাম যাকে বলে সামনে যা পাওয়া যায় তাই দেখা। আগেই তো বলেছি মিউজিয়ম তো দেখতে আসিনি এসেছি ঘুরতে, দুই ঘণ্টা হাতে নিয়ে। যার মধ্যে পনের বিশ মিনিট বা তার চেয়ে বেশি এরই মধ্যে খরচা হয়ে গেছে। দেখা যাকে বলে সেরকমভাবে দেখতে গেলে এই ঘরেই তো কাটাতে হবে দু ঘণ্টার চেয়ে বেশী সময়। সে উপায় তো নেই, চলুক তবে এরকম এলোপাথাড়ি দেখাই।
এলোপাথাড়ি এই দেখাদেখির মধ্যে, মাঝে মঝেই পরিবারের বাকীদের দিকে নজর ফেলে বুঝতে চাইছি যে, কী মনোভাব ওদের ? খুব বেশী না হলেও বেশ কিছু দর্শনার্থী দেখছি ঘোরাঘুরি করছে কক্ষ জুড়ে। কোনো কোনো বৌদ্ধ মূর্তির কাছে গিয়ে তাদের কেউ কেউ দেখছি হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে প্রকাশ করছে গভীর শ্রদ্ধা। এরই ফাঁকে ফাঁকে বেশ সন্তর্পণে দৌড় ঝাপ করছে পুত্রদ্বয়। ভাবভঙ্গিতে খুব একটা আগ্রহ না দেখতে পেলেও, দেখলাম লাজু আর হেলেনও দেখছে নানান আকারের নানা কায়দায় দাঁড়িয়ে, বসে বা শুয়ে থাকা বুদ্ধের মূর্তিসমূহ, যেগুলো কাড়ছে তাদের নজর।
একটু জোরে পা ফেলে পুত্রদের দিকে এগিয়ে কাছাকাছি গিয়ে অনুচ্চ স্বরে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ওদেরকে যাদুঘর দেখার পাঠ দেবার উদ্দেশ্যে বললাম বাবারা তোমরা কি জানো এখানে রাখা এই মূর্তি গুলো কার?
‘চিনব না কেন, বুদ্ধা’? সপ্রতিভ জবাব দীপ্রর।
‘বাট দিস ইজ চায়নিজ বুদ্ধা’। বুদ্ধের যে মূর্তিটির কাছে ওরা দাঁড়িয়ে আছে এ মুহূর্তে, সেটির দিকে নির্দেশ করে জবাব এলো অভ্রের কাছ থেকে।
সচকিত হলাম ওরা কথায়। ভাবলাম মানে কী? এখানে কী তাহলে কপিলাবস্তুর আর্য রাজার পুত্র সিদ্ধার্থ শেষ পর্যন্ত মংগোলিয়ান চেহারা নিয়েছে নাকি? সে জন্যই কি অভ্র একে বলছে চায়নিজ বুদ্ধা? সাথে সাথে সেই মূর্তিটির কাছে গিয়ে জরীপ করে দেখি, নাহ চেহারায় সেই আর্য ভাবই আছে মূর্তিটির। তাহলে কেন বললো এ কথা, ছোট পুত্র আমার ?
ফের ভাল করে জরীপ করলাম তাই আগাপাশতলা, নাক বরাবর স্থাপিত একটা প্রাচীন বড় পাথুরে আসনে সমাসীন সেই বুদ্ধমূর্তিটিকে। অতপর ধরতে পারলাম ব্যাপারটা। মাথার শিরস্ত্রাণ থেকে শুরু করে গায়ে কারুকার্যময় যে পোশাক আছে এ মূর্তিটির, তা আমাদের দেখা আর সব বৌদ্ধ মূর্তির থেকে আলাদা। পোশাক আশাক, মাথার শিরস্ত্রাণ সব মিলিয়ে এ মূর্তিটিতে একটা রাজকীয় ভাব আছে। আর বসার ভঙ্গিটিও তার আমাদের চিরচেনা পদ্মাসনের নয়। বুঝলাম আর্ট কালচার নিয়ে বেহদ্দ বেকুব তা প্রথমে ধরতে না পারলেও পুত্রের শিশুসুলভ কৌতূহলী চোখ তা ধরতে পেরেছে ঠিকই।
তখনই মনে পড়লো আরে আমাদের উপমহাদেশে এমনকি শ্রীলংকায়ও যত বৌদ্ধের মূর্তি দেখেছি, তার সবগুলোতেই বুদ্ধের চেহারায় দেখেছি একটা শান্ত সমাহিত ধ্যানমগ্ন ভাব। যেসব মূর্তির সামনে দাঁড়ালে মনে হয় কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্য তো অবশ্যই, এমনকি জগতের আর সব আনন্দ বেদনা এসবের সকল কিছু থেকেই মুক্ত একজন মানুষের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছি বুঝি। ঐসব মূর্তির শারিরিক গঠনেও আছে একটা মেদহীন সুঠাম ভাব। কিন্তু এই চায়নায় আসার অনেক আগেই, ব্যাংককের ফুটপাতে লালছে পাথরে তৈরি, মেদবহুল আর পেটমোটা মঙ্গোলিয়ান থ্যাবড়া নাকের হাসি মুখের বুদ্ধের মূর্তিও তো দেখেছি, যেটির নাম হল লাফিং বুদ্ধা। সেই লাফিং বুদ্ধার উৎপত্তি কি তাহলে এই চায়না ? নাকি থাইল্যান্ড?
দেখা যাক তবে এ মিউজিয়ম ঘুরে, পাই কি না এখানে ওরকম কোন প্রাচীন হাসিখুশি মেদবহুল পেটমোটা চায়নিজ বুদ্ধার মূর্তি, তাহলেই এ ব্যাপারে চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করা যাবে কিছুটা হলেও। তবে বিষয়টি সঠিকভাবে জানতে হলে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের লেখা পড়তে হবে। কিন্তু সে সময় আর আছে কোথায় হাতে?
দ্রুত পরবর্তী বুদ্ধের মূর্তিটির দিকে এগিয়ে গিয়ে ওটির সামনে দাঁড়াতেই, দেখা মিলল ফের সেই উপমাহদেশিয় চেহারার আর ভঙ্গিমার বুদ্ধের? এবার এরই হাত ধরে ভাবনা এলো মনে যে, প্রাচীন ভারত থেকে নানান বৌদ্ধভিক্ষু এমনকি আমাদের বিক্রমপুরী অতিশ দীপঙ্কর এখানে এসে, বুদ্ধের শিক্ষার প্রচলন করে গেলেও, তার আগে থেকেই এখানে তো ছিল কুনফুসিয়াসিজম আর তাওইজমের জয়জয়াকার। জানি না ঐ সব দর্শনের সাথে মিলেমিশে যে নতুন বৌদ্ধদর্শন তৈরি হয়েছিল, এখানে তার কোনো ধারনা মিলবে কি না এই যাদুঘরের মূর্তি গুলো দেখে। আচ্ছা কতগুলো মূর্তি আছে সব মিলিয়ে এখানে? চোখ বুলিয়ে দেখতে দ্রুত গুনতে শুরু করতেই অভ্র জিজ্ঞেস করল : ‘বাবা চায়নিজরা সব বুড্ডীস্ট নাকি’? হুম একদম সবাই না হলেও অনেকেই একসময় বৌদ্ধ ছিল। তবে এখন তারা বেশীর ভাগই কোনো ধর্মই পালন করে না।আচ্ছা তোমরা কি জান আমাদের বাংলাদেশ থেকে অতিশ দীপঙ্কর নামের একজন বৌদ্ধভিক্ষু অনেক আগে এই চায়নায় এসেছিলেন এদের কে বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা দিতে?
‘না জানি না। উনি কি এখানে মানে এই বেইজিং এ এসেছিলেন’।
দীপ্রর এই প্রশ্নে পড়ে গেলাম ফাঁপরে। আসলে তো জানি না, যে চায়নার ঠিক কোন জায়গায় এসেছিলেন অতিশ দীপঙ্কর। যতোটা মনে হচ্ছে উনি হয়তো গিয়েছিলেন তিব্বতে। মাওয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবোত্তর চীনে ধর্ম কর্ম পালনের ব্যাপারে কড়াকড়ি থাকায় এখানে এখন আর তেমন একনিষ্ঠ বৌদ্ধ না থাকলেও, ওখানে তো এখনও তার কমতি নেই। কোথায় যেন পড়েছিলাম, তিব্বতে প্রতি ছয়জন পুরুষের মধ্যে একজন নাকি বৌদ্ধ ভিক্ষু। তিব্বতে অবশ্য ভিক্ষুদের ডাকা হয় লামা নামে। ঐদেশে কোনো রাজা, মহারাজা, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর শাসন চলে না। সে দেশ চলে দালাইলামার ইচ্ছা অনিচ্ছায়। তবে মাওয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ঢেউ চায়না থেকে তিব্বতের দিকে আছড়ে পড়তেই, তৎকালীন দালাইলামার সাথে মাওয়ের লেগে গিয়েছিল টক্কর। সেই থেকেই তো দালাইলামা চলেন গেছেন বুদ্ধের আদিভূমি ভারতে, নির্বাসনে। পৃথিবীর সম্ভবত উচ্চতম মালভূমিতে বসবাসরত এই তিব্বতীদের বাসভূমি দখল করে মাওয়ের চায়না যে কাজ করছে, সেটিকে তো দালাইলামা বলছেন সাংস্কৃতিক গণহত্যা। হায় এভাবেই কি না সমাজতান্ত্রিক মাও ১৯৫১ তে যে সাংস্কৃতিক গণহত্যা শুরু করেছিলেন নিজহাতে তিব্বতে, সেটির নগ্নরূপ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭১ এর বাংলাদেশে!
এসব ভাবতে ভাবতে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে মনে হল আরে পুত্রের প্রশ্নের জবাব তো দেয়া হয়নি। যদিও উত্তরে বলবো, জানি না। তারপরও তো দিতে হবে সেই উত্তরই। কিন্তু দেখছি না তো তাদের আশে পাশে। অতএব ওদের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করার জন্য দাঁড়িয়ে ডানে বাঁয়ে পেছনে সামনে, তাকাতেই দেখি পুত্রদ্বয় চলে গেছে ফুপ্পি আর মায়ের কাছে। তুলছে ওরা ছবি বেশ কিছুটা সামনের দিকে আরেকটা বড় বৌদ্ধমূর্তিকে ঘিরে। ঠিক আছে, তুলুক ওরা ছবি। যতোটা পারি এই ফাঁকে বরং দ্রুত দেখে নেই এখানকার নানান সময়কালের বৌদ্ধমূর্তিগুলো।
আচ্ছা আজ কি এই ঘরে বিশেষ কোনো কারণে শুধুই প্রাচীনকালের বৌদ্ধমূর্তিরই প্রদর্শনী হচ্ছে নাকি? সে কারণেই কি এই ঘরটা শুধুই বৌদ্ধমূর্তিতে ঠাসা? বিশ্বের নানান মিউজিয়ামেই তো অনেক সময় এমন প্রদর্শনী হয়ে থাকে। ফলে চারদিকে ফের চোখ বুলিয়ে বুঝতে চাইলাম যে দেখা যায় কি না সেরকম কোনো পোস্টার টোস্টার বা ব্যানার। অবশ্য পোস্টার বা ব্যানার থাকলেও ওতে কী লেখা আছে তা তো পড়তে পারবো না, তবে ওরকম কিছু থাকলে অনুমান তো করা যাবে। কিন্তু না তেমন কিছু দেখলাম না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিলুপ্তপ্রায় প্রকৃতির সৌন্দর্যবর্ধক ধূসর পাখি কাঠময়ূর
পরবর্তী নিবন্ধড. ছানাউল্লাহ ব্যারিস্টার: এক অনন্য মনীষী