আলোকিত মানুষ তৈরির সফল কারিগর

শেখ-ই-চট্টগ্রাম কাজেম আলী মাস্টার

ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন | শনিবার , ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

বন্দর নগরী চট্টগ্রাম শহরের শিক্ষা-জোন খ্যাত চন্দনপুরা এলাকার প্রায় ২ একর জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছে সবুজে ঘেরা মেধাবিকাশের তীর্থভূমি কাজেম আলী স্কুল এন্ড কলেজ। এই প্রতিষ্ঠানের পাশেই রয়েছে ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম কলেজ ও হাজী মোহাম্মদ মোহসিন কলেজ। কালপরম্পরায় প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম, সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান, সবিহ উল আলম, অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান, শিল্পী নকীব খান, ডা. মোহাম্মদ আরিফের মত বহু জ্ঞানী-গুণি কীর্তমান মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটির ক্যাম্পাস জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হয়ে শিক্ষার্থীদের দিয়েছে শুদ্ধ পথের সন্ধান। তবে যে মনীষীর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল এই স্কুল, তিনি হলেন ত্যাগী ও ন্যায়নিষ্ঠ সংগঠক, শিক্ষা, সমাজসেবা ও রাজনৈতিক আন্দোলনের কালোত্তীর্ণ মহাপুরুষ, কাজেম আলী।
কাজেম আলী ১৮৫২ সনের ১১ ই আগস্ট চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট এলাকার উত্তরে ফরিদের পাড়ায় একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের প্রথিতযশা উকিল মুনশি কাসিম আলী। মাত্র নয় মাস বয়সে তিনি মাতৃহারা হলে চাচা উজির আলীর স্নেহে পালিত হন। বাল্যবয়সে মক্তব ও পাঠশালায় অধ্যয়ন শেষ করে কাজেম আলী হুগলী গমন করেন। সেখান থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে সাতকানিয়া হাই স্কুলে (বর্তমানে সাতকানিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়) শিক্ষকতা শুরু করেন। ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি স্কুলটিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। একজন সফল শিক্ষক হিসাবে তাই তিনি সবার কাছে কাজেম আলী মাস্টার নামেই সমধিক পরিচিত।
বৃটিশ-ভারত থেকে শুরু করে স্বাধীন-বাংলাদেশ আন্দোলনের অন্যতম পিঠস্থান ও সূতিকাঘর হল বীর-প্রসবিনী এই চট্টগ্রাম। সেই ধারাবাহিকতায় তারুণ্যের সময় থেকেই তিনি স্বদেশী, অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন সহ নানাবিধ সাংস্কৃতিক ও সমাজ সেবামূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যাত্রামোহন সেন, এইচ.এম. পার্সিভ্যাল, শশাঙ্কমোহন সেন, মৌলভি আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী মতো কিংবদন্তিদের সহযোদ্ধা হয়ে কাজেম আলী মাস্টার রেখেছিলেন অসাধারণ ভূমিকা।
কাজেম আলী মাস্টারের জীবন কাহিনী আলোচনা করতে গেলে ওই সময়ের রাজনৈতিক বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠির আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করা আবশ্যক। ভারতে ব্রিটিশ শাষণ শুরু হবার পর মুসলিমরা ইংরেজি শিক্ষার প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিল। ১৮৩৬ সালে দেশে আরবি ফার্সির স্থলে ইংরেজি চালু হবার পর শিক্ষা-দীক্ষায় তারা অনেক পিছিয়ে পড়ে।
তিনি লক্ষ্য করলেন, পিছিয়ে থাকা বাঙালি জাতিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে আধুনিক শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নাই। তাই বাঙালি সমাজকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে দেশকে জাগিয়ে তোলার জন্য ১৮৮৫ সালে চাকমা রাজার কাছ থেকে কেনা জমিতে নিজেই গড়ে তুললেন চিটাগাং মিডল ইংলিশ স্কুল।
ইংরেজি শিক্ষা বিদ্বেষী স্থানীয়রা তিনবার এই স্কুলটি পুড়িয়ে দেয়। কিন্তু এতে তিনি দমে যান নি। প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করে, অনেক চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে তিনি স্কুলটি পুনর্গঠন করেন। পরবর্তীতে কাজেম আলী মাস্টার পিতার সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে ১৮৮৫ সালে চিটাগাং হাই ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
কাজেম আলী মাস্টার ছিলেন একজন সত্যিকারের জনদরদী ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ সংস্কারক। তিনি আত্মপ্রচারের চেয়ে কিভাবে জনগণের মঙ্গল করা যায় সে জন্য নিরন্তর সচেষ্ট ছিলেন। তাই জীবদ্দশায় তাঁর নামে স্কুলের নামকরণ করতে চাইলে তিনি রাজি হননি। অবশেষে তাঁর মৃত্যুর পর ১৯২৮ সালে এই স্কুলকে চট্টগ্রাম কাজেম আলী হাই স্কুল নামকরণ করা হয়। আমাদের সমাজে এমন দৃষ্টান্ত মেলা ভার।
কাজেম আলী মাস্টার ছিলেন হিন্দু মুসলিম ঐক্যের প্রতীক। রাজনৈতিক আদর্শ ও গণমানুষের স্বার্থ রক্ষায় তিনি ছিলেন আপসহীন। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে চট্টগ্রামে পরিচালিত হয়েছিল কংগ্রেস-খেলাফত কমিটির আন্দোলন। তিনি অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি, মুসলিম লীগ, চট্টগ্রাম কংগ্রেস কমিটি, খাদেমুল ইসলাম সোসাইটি, খিলাফত কমিটিসহ নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমৃত্যু চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন।
শিক্ষা বিস্তার ও নিঃস্বার্থ জনসেবার জন্য কাজেম আলী মাস্টার দুইবার “কায়সার -ই-হিন্দ গোল্ড মেডেল” এবং “সার্টিফিকেট অব অনার” এ ভূষিত হন। কিন্তু ১৯১৯ সালে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালা বাগে নির্মম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে শুধু ইংরেজ প্রদত্ত উপাধি ‘কায়সার-ই-হিন্দ্‌’ ই পরিত্যাগ করেন নি,বরং ইংরেজ প্রদত্ত ডবল ‘গোল্ড মেডেল’ এবং ‘ সার্টিফিকেট’ বৃটিশ-সরকারকে ঘৃণাভরে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধি দিতে চাইলে তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর অনন্য আত্মত্যাগ ও দেশ প্রেমের জন্য ওই বছরই ব্রিটিশবিরোধী আন্দেলন গড়ে তোলার সময় চট্টগ্রামের এক বিশাল জনসভায় জনগনের পক্ষ থেকে তাঁকে ‘শেখ-ই-চাটগাম’ উপাধি দেওয়া হয়।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষ জুড়ে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে কাজেম আলী মাস্টার বিপ্লবের মশাল হাতে তুলে নিয়ে কান্ডারীর ভূমিকায় অবতীর্ন হন। চট্টগ্রামে বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতা ও ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের আন্দোলনে মূল উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন তিনি। ১৯২১ সালের বৃটিশ-বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের নেতা হিসেবে যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, ত্রিপুরা চরণ চৌধুরী, স্বামী দীনানন্দ, নৃপেন ব্যানার্জী সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে তিনিও কারাবরণ করেন। ওই বছরই সাধারণ নির্বাচনে কাজেম আলী মাষ্টার কংগ্রেসের টিকেটে ভারতীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বক্তব্য উস্তাপন করার সময় অকস্মাৎ হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দিল্লী জামে মসজিদে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
কাজেম আলী মাস্টারের ৯৬তম মহাপ্রয়ান দিবসে আজ প্রশ্ন জাগে, চট্টগাম তথা বাংলাদেশ এবং এই উপমহাদেশের একজন বরেণ্য ব্যক্তিত্বের অমরকীর্তির কথা কি আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি? তারা কি জানে? দেশ ও জনগণের অধিকারের কথা ভেবে বৃটিশের দেয়া দুর্লভ উপাধিগুলো কিভাবে একে একে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এই মহাপুরুষ? তারা কি জানে? চরম বাধা-বিপত্তি ও ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে কাজেম আলী স্কুলকে টিকিয়ে রাখার ইতহাস? সত্যি বলতে কি, এই চট্টল সন্তানের জীবন গাঁথা ইতিহাসের পাতায় উপেক্ষিত রয়ে গেছে। কাজেম আলী মাস্টারের জীবন সংগ্রামের ইতিহাস উপেক্ষিত বলেই আজ আমাদের নতুন প্রজন্ন লক্ষ্যভ্রষ্ট, পাচ্ছে না সঠিক পথের সন্ধান।
দুঃখজনক হল, কিছু স্বার্থান্বেষী মহল উন্নয়নের কথা বলে স্কুল দখলের পাঁয়তারা করছে। ২০১০ সালের পর তৎকালীন স্কুল কমিটি স্কুলের মাঠের অংশেও কয়েকটি ক্লাসরুম ভেঙে দুটি মার্কেট নির্মাণ করে স্কুলটির ঐতিহ্য নষ্ট করেন। এভাবে চললে কিছুদিনের মধ্যে এই মহান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।
শেখ-ই-চাটগাম, পারিবারিক কিংবা সরকারি সূত্রে পাওয়া কোনো উপাধি নয়। এ হল দেশে ও জাতির জন্য কাজেম আলী মাস্টারের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ জনগণের দেয়া উপাধি। এ হচ্ছে তাঁর জন্য দেশের মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসারই নিদর্শন। তাইতো ইতিহাসের পাতায় যতই উপেক্ষা করার চেষ্টা করা হোকনা কেন, কাজেম আলী মাস্টার গণমানুষের হৃদয়ের গভীরে বেঁচে থাকবেন চিরদিন।

লেখক : প্রকৌশলী ও জলবায়ু গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধভালোবাসাময় হোক প্রতিটি সম্পর্ক
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে