আবু মহসিন খান প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কিন্তু অসুস্থ। ক্যান্সারে ভুগছিলেন। থাকতেন রাজধানীর ধানমন্ডি ৭ নম্বর সড়কের নিজের বাসায়। বড্ড একলা তিনি। বেশ ক’জন ছেলেমেয়ে আছে। কিন্তু সবাই বিদেশে। যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ায়। এক মেয়ে দেশে থাকলেও বাবার সাথে যোগাযোগ কম। মেয়েজামাই জনপ্রিয় চিত্রনায়ক রিয়াজ। কদিন আগে বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন করেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন-নিপুণ পরিষদ থেকে। কিন্তু জনপ্রিয় হয়েও হেরে গেছেন।
আবু মহসিন ফেস বুক লাইভে এসে বুধবার ২ জানুয়ারি আত্মহত্যা করেছেন। রাত ১০টা নাগাদ তিনি আত্মহত্যা করেন মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে। নিজের লাইসেন্স করা পিস্তলের গুলিতে ৬০ বছর বয়সে চলে যান তিনি। ফেসবুক লাইভে তিনি নিজের একাকীত্ব, অসহায়ত্ব, সন্তান ও বন্ধু বান্ধবের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়েন। তিনি সফল ব্যবসায়ী হয়েও এখন নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন। ব্যবসা, বাণিজ্য সব শেষ। তাঁকে দেখাশোনার কেউ নেই । বন্ধুবান্ধবরা কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে সরে গেছেন। সন্তানদের বড় করেছেন, মানুষ করেছেন কিন্তু ওরা নিজস্ব বলয়ে বন্দি। তাঁর ভয়, তিনি মরে এক সপ্তাহ নিজের ঘরে পড়ে থাকলেও কেউ খোঁজ নেবে না। আত্মহত্যাকালীন তাঁর দেয়া বক্তব্যের সত্যমিথ্যা যাছাই ও অনুসন্ধান করবে আইনি সংস্থা। আত্মহত্যার অন্য কোনও কারণ আছে কিনা, তাও খুঁজে দেখা বা অনুসন্ধানের দায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর।
তাঁর অন্তিম বক্তব্য থেকে আত্মহত্যার কিছু সাধারণ ধারণা শুধু নেয়া যায়। তা হচ্ছে, ক্যান্সারের মত কষ্টকর রোগের যন্ত্রণা, নিঃসঙ্গ জীবন, ব্যবসায়িক বন্ধুদের প্রতারণা, ছেলেমেয়েদের প্রতি ক্ষোভের বিরূপ অনুষঙ্গ হয়তো মহসিন সাহেবকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়েছে। আইনি এজেন্সির অনুসন্ধানে নিশ্চয়ই আসল সত্য প্রকাশ পাবে। প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণে মর্মান্তিক খবরটি প্রকাশের পর ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে বয়সী বেশ কিছু মানুষের জীবন নিয়ে কিছু মন্তব্য দিয়েছেন, বেশকিছু পাঠক। যা মহসিন সাহেবের জীবনের চেয়েও করুণ। ২৪/২৫ বছর ধরে অপত্য মায়া, স্নেহ ও নিজের রোজগারের বড় অংশ সন্তানের লেখাপড়ায় খরচ ও আদর মমতার ওমে বড় করেছেন বাবা-মা। কিন্তু অনেক সন্তান প্রতিষ্ঠিত বা বিদেশে থিতু হয়ে স্লেটের লেখার মতো মুছে ফেলে মা বাপকে। এদের সংখ্যা ও অনুপাত কত, কোনও পরিসংখ্যান এখনো পাওয়া যায়নি। সংখ্যাটা যে আশঙ্কার স্তর ছাড়িয়ে গেছে বা যাচ্ছে আলামত, ইঙ্গিতে তা স্পষ্ট। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক পর্যায়ে বাবা-মা’র নাড়িছেঁড়া ধনটির কাছে নিজের সংসার, বিলাস ও সচ্ছলতাই সব অতীত ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠে। বিদেশে ওল্ডহোম বা বৃদ্ধাশ্রম সংস্কৃতি চালু থাকলেও এদেশে এখনো জনপ্রিয় হয়নি। কিন্তু মহসিন খানের আত্মহত্যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, এদেশে বহু সফল মানুষ সন্তানকে যথাযথ প্রতিপালন ও পছন্দের যোগ্য শিক্ষা, স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েও নিজেরা সন্তানের কাছে বড়ই অবহেলিত ও নিঃসঙ্গ। সন্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দ্রুত তাদের ভুলে যাচ্ছে। আধুনিক গেজেটনির্ভর ব্যয়বহুল জীবন, সাইবার দূষণ, পেশাগত তীব্র প্রতিযোগিতা, কেরিয়ারের পেছনে ভয়ঙ্কর দৌড়সহ ফাস্ট লাইফের তীব্র আকর্ষণ এর জন্য দায়ী। তেমনি নিজের পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্বকে ঝেড়ে ফেলে ব্যক্তি স্বার্থের তীব্র মোহ, অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতা আরও বেশি দায়ী। এই নষ্টচর্চা কিন্তু পূর্ব প্রজন্ম থেকে প্রবাহিত হয়ে ঢুকছে পরবর্তী প্রজন্মের রক্তে। যত নীচে নামছে তত ভয়ঙ্কর ও খরস্রোতা হচ্ছে। আমাদের সামাজিক ও মানবচরিত্র বিশ্লেষকদের এই নিয়ে দ্রুত কাজে নামা উচিত। রোগের কারণ ও অনুষঙ্গ দ্রুত শনাক্ত হলে চিকিৎসা দেয়া এখনও সম্ভব। একইসাথে স্নেহ, মমতা, বন্ধনের হারানো ঐতিহ্যগুলো বিশেষ করে পারিবারিক, সামাজিক মূল্যবোধের ব্যাপক চর্চা, মানবিক ও সামাজিক সেতুবন্ধ পুনঃযোজনা এবং চর্চায় রোগটির কিছু টোটকা চিকিৎসা মিলতেও পারে। নাহলে ভোগবাদের ভয়াল ও নিষ্ঠুর প্লাবনের ঘোলাস্রোতে সামনে আরো অবিশ্বাস্য সব মানবিক পতনের জন্য তৈরি থাকতেই হবে। আবু মহসিনদের মত আত্মহত্যার ঘটনা মাঝে মাঝে আমাদের মগ্ন চৈতন্যে ঘাঁই দিয়ে যাচ্ছে। এসব ঘাঁই থেকে শিক্ষা নিয়ে মানবিকতার মসৃণ পথ তৈরিতে মনোযোগ দেয়া জরুরি। তা না হলে সামনে আরো ভয়াল সামাজিক ভাঙন ও ক্ষতের জন্য তৈরি থাকাই উচিত