‘দূরের টানে বাহির পানে’ : বাংলাদেশের ভ্রমণসাহিত্যে এক অনবদ্য সংযোজন

হানিফ মজুমদার | সোমবার , ১৭ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

লেখক সাংবাদিক হাসান আকবরের ভ্রমণসাহিত্যের বই ‘দূরের টানে বাহির পানে’। ভ্রমণ অভিজ্ঞতা বর্ণনার পাশাপাশি তিনি এ গ্রন্থে হাজির করেছেন ইতিহাসের নানা পর্বের প্রাসঙ্গিক উপস্থাপনা। প্রতিটি পর্বে চমৎকার সব শিরোনাম ও নান্দনিক বর্ণনাভঙ্গি নিঃসন্দেহে লেখকের নিজস্ব মুন্সিয়ানার পরিচয়। সব মিলিয়ে আর দশটা ভ্রমণকাহিনী থেকে এ গ্রন্থ খানিকটা ভিন্নধর্মী। আলোচিত গ্রন্থে লেখকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও যুক্তরাজ্য ভ্রমণের কাহিনী উঠে এসেছে। ভ্রমণের প্রারম্ভিক পর্যায় অর্থাৎ ভিসা নেয়া থেকে শুরু করে ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত ঘটনাবলী, বিমানে উড্ডয়ন থেকে ঘরে ফেরা পর্যন্ত প্রত্যেটি দিকেরই সংক্ষিপ্ত অথচ হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা রয়েছে এতে। যা পাঠককে এক তৃপ্তিদায়ক মানসভ্রমণের অনুভূতি দেয়। নিজের অজান্তেই আটলান্টিকের ওপারে উড়াল মারে মন।
চট্টগ্রামের আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা বিশ্বরত্ন ড. মুহাম্মদ ইউনুসের ‘সোস্যাল বিজনেস’ থিউরি বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের জন্য আশির্বাদ স্বরূপ। সেই স্বপ্ননায়ক ড. মু. ইউনুসের একটি সংবর্ধনায় যোগ দিতে আজাদী’র সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে লেখকের যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা। প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে লস এঞ্জেলস বিমান বন্দরে নেমেই ‘ভিরমি’ খান লেখক। অবাক হন বিমান বন্দর থেকে বের হয়েও। এতো প্রশস্ত কোনো সড়ক হতে পারে! এতো এতো লেন, তবু জ্যাম নেই কোথাও। অবিশ্বাস্য! পরোক্ষণে মনে পড়ে- এ তো স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্র।
সেখান থেকে যান মেক্সিকোতে। মেক্সিকো সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা রয়েছে বিশ্বব্যাপী। বুকটা তাই ধুরুধুরু করছিলো খানিকটা। কিন্তু না। মেক্সিকো পর্বও ভালোভাবে শেষ হয়। একটি ছোট খালকে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলে যেই মেক্সিকো, আয় করে হাজার হাজার ডলার, সেই দেশকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণার হেতু খুঁজে পান না লেখক। পিরমিডের বিশালতায় হাবুডুবু খান শুধু। মেঙিকো সিটি থেকে লস এঞ্জেলস, সেখান থেকে বোস্টন। প্রশান্ত মহাসাগরের তীর থেকে আটলান্টিকের পাড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে শুধু বিমানে উড়তে হয় সাত ঘণ্টারও বেশি সময়। একই দেশের দুটি শহর হলেও সেখানে সময়ের ব্যবধান তিন ঘণ্টা। দূরত্বটা সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার বলেই হয়তো।
লেখকের এক সময়ের সহকর্মী তাপস বড়ুয়ার সাথে বোস্টনে ঘুরে বেড়ান লেখক। দেখে আসেন বিশ্বখ্যাত বিদ্যাপীঠ হার্ভাড ও এমআইটি। এ দুটি শিক্ষায়তনের প্রাসঙ্গিক ইতিহাসও উঠে আসে লেখায়। দেশপ্রেমের বুদবুদ হৃদয়ে পোষা লেখকের মনে পড়ে স্বদেশের বিশ্ববিদ্যায়গুলোর কথা। ভাবনায় কূল কিনারা পাওয়া যায় না। তবু দিন শেষে ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে যাওয়া। ঘুম থেকে জাগতেই দু’চোখে বিস্ময় খেলা করে। স্নো-ফল হচ্ছে! এমন বরফ রঙিন সকাল তাই মূল্যবান রত্নপাথর হয়ে জমে থাকে স্মৃতির ডায়েরিতে। স্ট্যাচু অব লিবার্টি ও হোয়াইট হাউস ঘুরে না আসার মতো বোকামি করেন না লেখক। তবুও একসময় শেষ হয় আমেরিকার দিনলিপি। বলতে হয়-গুডবাই আমেরিকা।
এরপর লেখকের গন্তব্য হয় যুক্তরাজ্য। হ্যাঁ, শতাব্দীর পর শতাব্দী বিশ্ব দাপিয়ে বেড়ানো আভিজাত্যে ভরা ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে এবারের উড়াল। সাথে উড়ে চলে পাঠকের মনও।
বন্ধুভাগ্যে অগ্রগামী লেখককে অভ্যর্থনা জানাতে লন্ডন বিমানবন্দরে ছুটে আসেন স্বজনরা। বিপুল ঐশ্বর্যের লন্ডন শহরও চোখ ধাঁধানো। হবেই বা না কেন। ধুরন্ধর ব্রিটিশরা সারা দুনিয়া ছেঁকে সমস্ত প্রাচুর্য এনে জমা করেছে এই লন্ডনে। আজ থেকে দেড়শো বছর আগে যারা পাতাল রেলে ভ্রমণ শুরু করেছিলো তাদের সাথে আমরা কি তুলনায়ও আসতে পারি? আমাদের দেশে পাতাল রেল এখনো স্বপ্ন! আমরা কি পারবো মাটির নিচে আরেকটি ঢাকা বা চট্টগ্রাম গড়ে তুলতে? ভাবেন লেখক। এ ভাবনার শেষ কবে কে জানে।
টেমস পাড়ের শহরটিতে প্রচুর বাঙালিও বাস করে। আভিজাত্যের শহরে বসেও প্রিয় মাতৃভূমিকে ভুলতে পারে না তারা। স্বদেশের প্রতি অমোঘ এ প্রেম লন্ডনের বুকে গড়ে তোলে শহীদ মিনার। দেশের কথা মনে হলে সেখানে ছুটে যান বাংলাদেশীরা।
একে একে লেখক ঘুরে দেখেন মাদাম তুসো মিউজিয়াম, ক্রিকেট তীর্থ লর্ডস, বাকিংহাম প্যালেস, ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট হয়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। ১২০৯ সালে ক্যাম নদীর তীরে স্থাপিত ক্যামব্রিজে কি বিজ্ঞানী নিউটনের সেই আপেল গাছটি এখনো আছে? খুঁজতে থাকেন লেখক। তিলবুরি বন্দরে গিয়ে দাঁড়াতেই মনে পড়ে চট্টগ্রাম বন্দরের কথা। আমরা কেন পারি না? এই আত্মশ্লাঘার কি উপশম নেই কোনো?
চালকবিহীন ট্রেনে চড়তে চড়তে এক সময় ফুরিয়ে আসে লন্ডনের দিনগুলো। এবার ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে ফেরার পালা। ফেরার কথা উঠতেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে লেখকের। এ দীর্ঘ ভ্রমণে এতোদিন যারা নাওয়া খাওয়া ভুলে সঙ্গ দিয়েছিলো প্রিয় ভাই, বন্ধু, সহকর্মী, কিম্বা নিজ দেশের একজন স্বজনকে, তাদের ছেড়ে যাওয়ার বেদনাও কম নয়। মনটা ভারী হয়ে আসে ক্রমে। আত্মার এ আত্মীয়রা দেশ থেকে দূরে থাকেন ঠিকই, দেশকে তারা ভুলতে পারেন না একটি মুহূর্তের জন্যও। এ জন্যই হয়তো লস এঞ্জেলসের রাস্তায় ধাবমান কোনো গাড়িতে বেজে ওঠে রবীন্দ্রসংগীত, কয়েকজন বাঙালি একত্রিত হলেই আবৃত্তি হয় সিকান্দার আবু জাফরের কবিতা। এজন্যই লন্ডন শহরে রেস্টুরেন্ট চালিয়ে দেশে কলেজ স্থাপন করেন সাফা সাহেব। এ মায়ার, এ প্রেমের উপমা দেয়ার মতো কোনো শব্দ তাই খুঁজে পান না লেখক।
এক সময় লেখক ফিরে আসেন স্বদেশে। প্রিয় চট্টগ্রামে। মায়ের কাছে। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের স্মৃতি জীবনের মূল্যবান সম্পদ হিসেবে জমা হয় জীবনের ডায়েরিতে। লেখক যেন নতুন করে প্রেমে পড়েন লাল-সবুজের। সে প্রেম থেকেই লেখা হয় ‘দূরের টানে বাহির পানে’ কলাম। যা পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। অতুলনীয় এ দেশপ্রেমের কাছে গ্রন্থের দু-দশটা মুদ্রণপ্রমাদ হয়তো নস্যি, কিন্তু হাজার পাঠকের মাঝে সে প্রেম ছড়িয়ে দেয়ার এ প্রয়াস অমূল্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিজেকে বদলান জীবন বদলে যাবে
পরবর্তী নিবন্ধঝরা পাতায় নাম না লেখাক আর কোনো শিশু কিশোর