জামদানি: আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্য, বুননে অকৃত্রিম প্রেম

ববি বড়ুয়া | সোমবার , ৩ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

বাঙালি নারী এবং শাড়ি কাউকে বাদ কাউকে নিয়ে কথা বলাটা অনেকটা অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক বললেও বলাটা ভুল হবে না। ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় একে অপরের সম্পূরক সম্পর্ক যা বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত ও সমাদৃত বলা যায়। আমার বেলাতেও তার ভিন্ন নয়। তবে একটু বেশি বড় হওয়ার পর থেকে অর্থাৎ শাড়ি সম্পর্কে অল্প বিস্তর ধারনা লাভের পর থেকে জামদানির প্রেমে পড়ি। যার ঘোর এখনোও চোখে মুখে অব্যাহত প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান। জামদানী গুলো যতোটা গভীর আর সযত্নে কাছে টানে একই সাথে তাকে দেখলেই কাছে পাওয়ার লোভ সংবরণ করা ততোটাই ভয়ঙ্কর রকম কঠিন বলে মনে হয়।

যেকোন সৃষ্টিকর্ম আর তার সৃষ্টিকর্তা বা যদি এভাবে বলি শিল্পকর্ম না তার শিল্পী কার প্রেমে মানুষ আগে পড়ে তা বলাও কঠিন। কারণ দেখা যায় ভালোবাসার মানুষের সৃষ্টিও তার মতো প্রিয় হয়। আবার শিল্পকর্মের শিল্পবোধের মোহে পড়েও শিল্পের সাথে সাথে শিল্পীর মোহেও মানুষ পড়ে । তাই বিষয়টা অনেকটা আপেক্ষিক বলা যায়। এই জামদানীর প্রতি টান বা মোহ এতোটাই গভীর যে মাঝে মাঝে মনে হয় আরো কম বয়সে জামদানীর প্রেমে পড়লে হয়তো পিতাকে বলতাম, আমাকে জামদানী শিল্পীর সাথে বিয়েটা দাও।
মাঝে মাঝে এ নিয়ে স্বপ্ন বুনে ফেলা হয় মনের গহিন কোঠায়। হয়তো শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে কোন এক ছোট কুঠিরে আমাদের সুখ বোনার চাষ। আমি আর সে বা পরিবারের আর প্রিয় ক’জন মিলে সেখানেই উৎপাদিত কার্পাস তুলার মিহি সুতা সংগ্রহ, সুতায় রং করা, নাটাইয়ে তা প্যাঁচানো, মাকু করা কিংবা তার সাথে হাতাহাতি করে সেই সুতাকে তাঁতের সাজানিতে বসাতাম। তার নিপুণ হাতে শুরু হতো টানামাটির গর্তে খটাখট তাঁত চালানোর শব্দ। আর আমার প্রিয়তম ওস্তাদের পাশে শাগরেদের মতো সানার টানে মাকু চালিয়ে জামদানি শাড়ির নকশা ফুটে উঠতো একের পর এক নকশা আর কারুকাজে। একটি সময় তা আর জামদানী থাকতো না। হতো আমার প্রেমের ক্যানভাসে আঁকা এক একটি শিল্পকর্ম। আর এর বুননে বুননে জড়িয়ে থাকতো আমাদের প্রেম, হাসিঠাট্টা বা কান্না বেদনার লাল নীল সুখ দুঃখের স্মৃতি। এটা বানাতে বানাতে পরিশ্রান্ত আমার কারিগরের ঘর্মাক্ত শরীর কখনো মুছেছি হয়তো আমার পরনের নেহায়েতই সস্তা তাঁতের শাড়ির আঁচলে বা কখনো ন্যায্য মূল্যে বেচা থেকে বঞ্চিত হওয়ার চাপা কষ্ট অশ্রু হয়ে ঝরে পড়া বৃষ্টিকে ছাতা টেনে দিয়েছি নিজের বুকের উষ্ণ মমতা আর আশ্বাসে। এমনই হয়তো কতো ছোটছোট গল্পে বোনা হতো সেই এক একটি জামদানী নামক সুখদুঃখ বোনা স্মৃতি।
আর এভাবেই আমার শিল্পীর হাতের ছোঁয়ার তৈরি হবে জনপ্রিয় করলা পাড়ের জামদানি , ময়ূর প্যাঁচ, কলমিলতা, পুঁইলতা, কচুলতা, গোলাপচর, কাটিহার, কলকা পাড়, কাঠপাড়, আঙুরলতা ইত্যাদি। শাড়ির জমিনে গোলাপফুল, জুঁইফুল, পদ্মফুল, তেছরী, কলার ফানা, আদার ফানা, সাবুদানা, মালা ইত্যাদি নকশা বোনা জামদানি। কিন্তু যখনি মনে পড়ে প্রিয়জনের হাতে বোনা এক একটি শিল্প যার ওপর আমার কোন অধিকারই থাকবে না বা সকাল হতেই তা চলে যাবে পাইকারি হাটে বা মধ্যস্থকারী কোন অসাধু ব্যবসায়ীর কাছে মুহূর্তেই শিল্পীর সহচরী হওয়ার সাধ উবে যায়। মনে হতে থাকে এতো কষ্টে বোনা আমাদের শিল্প যাতে আমার নিজেকে সাজানোর বিন্দু মাত্র উপায় নেই। বরং তা হাটে না বেচলে পেটের ভাত জোটার জো নেই ভেবেই কষ্টে বুকের ভেতরটা হুহু করে ওঠে আর গড়িয়ে পড়া অশ্রুতে ভিজে যেতে চায় আমার পরনে জামদানীর জমিন। আর এভাবেই হয়তো নিভে যেতে থাকে একজন তরুণীর এই কারিগরের সহচরী হওয়ার ইচ্ছে আর সন্তানদের পিতৃ সূত্রে পাওয়া বংশগত কারিগরি পেশার ধারাবাহিতা রক্ষার আগ্রহ।
একটু ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে, প্রাচীন ইতিহাস বলে, বিশ্বজয়ী ঢাকাই শাড়ি বলতে প্রথমেই আসে মসলিনের নাম। কিন্তু মসলিনের খ্যাতি তার সূক্ষ্মতা আর মিহি বুনটের মাঝে। আর এই যে নকশাদার মসলিনের ওপর এই জ্যামিতিক বুটিদার কারুকাজ- সাধারণভাবে একে আমরা জামদানি বলি, যা আজ আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মূলত মসলিনের একটি ধরন হলো জামদানি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি শাড়িকে বোঝালেও প্রকৃতপক্ষে ঐতিহ্যবাহী নকশাসমৃদ্ধ ওড়না, কুর্তা, পাগড়ি, রুমাল, পর্দা সবই জামদানির আওতায় পড়ে। যদিও বর্তমানে জামদানি নানা স্থানে তৈরি করা হয়, কিন্তু ঢাকা-ই এর আদি জন্মস্থান বলে গণ্য করা হয়। কারণ শীতলক্ষ্যার পানি থেকে উঠে আসা বাষ্প সুতার প্রস্তুতি ও কাপড় বোনার জন্য খুবই উপযোগী।
আজকাল আমরা জামদানি বলতে যা বুঝি তার প্রাথমিক বিকাশ হয়েছিল সেই খ্রিস্টপূর্বে। জামদানি আর মসলিনের সম্পর্ক যেমন ঘনিষ্ঠ আর মসলিনের ইতিহাস সেরকমই পুরনো।
প্রাচীন ভারতের চিন্তাবিদ কৌটিল্য ‘অর্থশাস্ত্র’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। অনুমামিক ৩০০ খ্রিস্টাব্দে লিখিত সেই বইয়ে প্রাচীন বঙ্গ ও পুন্ড্রে (বর্তমান বগুড়া) এক ধরনের মিহিন কাপড়ের কারখানার কথা উল্লেখ করেছেন কৌটিল্য। পেরিপ্লাস শব্দটি গ্রিক। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রচিত হয়েছিল: ‘পেরিপ্লাস অভ দ্য ইরিথ্রিয়ান সি’ নামে একটি গ্রন্থ। সে গ্রন্থেও বঙ্গের মিহিনবস্ত্রের কথা রয়েছে। তা ছাড়া আরব, চীন ও ইটালীয় পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের বৃত্তান্তেও বঙ্গের সূক্ষ্ম কাপড়ের কথা বারবার উল্লেখিত হয়েছে। যা থেকে বোঝা যায় প্রাচীন কাল থেকেই বাংলার সূক্ষ্ম মিহিবস্ত্র সমাদৃত হয়ে আসছিল।
নবম শতাব্দীতে আরব ভূগোলবিদ সোলায়মান তাঁর গ্রন্থে রুমি নামে রাজ্যের সুক্ষ সুতার কাপড়ের কথা উল্লেখ আছে। বর্ণনায় বোঝা যায়, রুমি রাজ্যটি আসলে বর্তমানের বাংলাদেশ। চতুর্দশ শতাব্দীতে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলাদেশ পরিভ্রমণ করেন এবং সোনারগাঁও এলাকাস্থিত সুতিবস্ত্রের প্রশংসা করেছেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে ইংরেজ পর্যটক র‌্যালফ ফিচ ও ঐতিহাসিক আবুল ফজলও ঢাকার মসলিনের প্রশংসা করেছেন।
আরেক ঐতিহাসিক টেলরের জামদানির বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর বর্ণনানুসারে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ১০ বাই ২ হাত মাপের ও ৫ পয়সা ওজনের দাম ছিল ৪০০ টাকা। সম্রাট আওরঙ্গজেবের জন্য তৈরি জামদানির দাম ছিল ২৫০ টাকা। কিন্তু উনিশ শতকের প্রথমদিক থেকে উচ্চমূল্যের জামদানি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে।
সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সাবেক সচিব মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান মহোদয়-এর লেখায় দেশের মসলিনের ইতিহাস, বর্তমান ও আগামী সম্ভাবনা নিয়ে একটি আর্টিকেলে অনেক তথ্য উল্লেখিত আছে। যাতে বলা আছে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া সোনালি ঐতিহ্য বিশ্বখ্যাত ‘ঢাকাই মসলিন’ পুনরুদ্ধারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে মন্ত্রণালয়ে পরিদর্শনে এসে বিভিন্ন দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যে আমাদের হারানো গৌরব মসলিন শিল্পের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ এবং মসলিন উদ্ধারে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরামর্শ ও নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন ।
আর এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে সচিব মহোদয় জুন ২০২০-এ নারায়ণগঞ্জ জেলার তারাব পৌরসভার আওতায় শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর সংযোগস্থলে অসাধারণ নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশে ছায়াঘেরা, দেয়াল-সুরক্ষিত অব্যবহৃত তিন একর জায়গা পরিদর্শনে যান এবং শুরু করেন ‘ঢাকাই মসলিন হাউস’ গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জিং কাজ। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মসলিনের কার্যক্রমকে কেন্দ্রীয়ভাবে এক জায়গাতেই সমন্বিত উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আনা। যেখানে কর্মজীবী নারী শ্রমিকদের শিশুদের সুরক্ষার জন্য নির্মিত হয়েছে ডে-কেয়ার সেন্টার, প্রার্থনা ঘর, মসজিদসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড। উল্লেখ্য, একই রাস্তায় পাশের ও সংলগ্ন অপর একটি বিজেএমসির অব্যবহৃত দুই একর জায়গায় তাঁত বোডের প্রস্তাবিত ‘ জামদানি ভিলেজ ‘ তৈরির কাজও শুরু করেছেন। তিনি বলেন, ‘এতে ঐতিহ্যবাহী মসলিন এবং জামদানি দুই বোন পাশাপাশি বসবাস করবে।’ ঢাকার অদূরে শীতলক্ষ্যার তীরে ছায়া শীতল এই স্থানে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটির তিনি নাম দিয়েছেন ‘ঢাকাই মসলিন হাউস’, ‘হারানো ঐতিহ্যের সন্ধানে দেশ’। তৎকালীন সচিব আব্দুল মান্নান মহোদয় তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন, ‘আমি একবুক আশা নিয়ে আছি, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক শুভ উদ্বোধনের ভেতর দিয়ে অচিরেই দীর্ঘ প্রত্যাশিত আমাদের ইতিহাসের সোনালি অধ্যায়, আমাদের জাতিসত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ ও গৌরবগাথা সেই মসলিন আবার ফিরে আসবে।’ মসলিন বয়নে যেমন ন্যূনপক্ষে ২৫০- ৩০০ কাউন্টের সুতো ব্যবহার করা হয়, জামদানি বয়নে সাধারণত ৭০-৮০ বা আরো বেশি কাউন্টের সুতো ব্যবহৃত হয়।আর এই কাউন্টের এবং সুতার গাঁথুনির উপর দাম নির্ধারিত হয় ।কাউন্ট বেশি হলে দামও বেশি হবে ।
মিহির সুতায় শিল্পী তার শিল্পসত্তা থেকে ছোট ছোট নকশায় ফুটিয়ে তোলা জামদানি মুগ্ধ ও বিমোহিত করেছে কালে- কালে, যুগে-যুগে বাঙালি নারীরকে। এক একটি ভালো জামদানি সংগ্রহ যেন প্রতিটি নারীর হৃদয়ে লুকায়িত সুপ্ত বাসনা। আর বাঙালি নারীর জামদানির বুননে বুননে প্রেম যতোদিন গুঁজে থাকবে নারীর অন্তরে ততোদিন এই শিল্প কখনো আমাদের দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে বিলীন হবে না। তাজা, অক্ষত, অমলিন ও মায়াময় হয়ে থাকবে আমাদের এই শিল্প সংস্কৃতির গৌরবপূর্ণ ইতিহাস।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ,
ওমরগনি এমইএস কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধউচ্চ পদস্থ তদন্ত কমিটি
পরবর্তী নিবন্ধনাট্যকার চৌধুরী জহুরুল হক এবং স্মরণসন্ধ্যা ২০২২