পিতা দিয়েছেন স্বাধীন স্বদেশ কন্যা দিয়েছেন আলো

সোমা ধর | মঙ্গলবার , ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ

‘সাবাস বাংলাদেশ’ স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতি দেখে একটি উপমাই যেন উপযুক্ত। সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রাক্কালে স্বল্প উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ -এ যে অভূতপূর্ব অর্জন তা বলা বাহুল্য। কেননা একসময় টেস্ট কেস, বাস্কেট কেস হিসেবে যে দেশ পরিচিতি পেয়েছিল, আজ স্বীকৃতি পেয়েছে ‘উদীয়মান এগার’ তে। গোল্ডেন সাচ ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক একবিংশ শতাব্দীতে ১১ টি দেশ কে ‘নেক্সট ইলেভেন’ বা উদীয়মান এগার বলে স্বীকৃতি দিয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে (বাংলাদেশ, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, সাউথ কোরিয়া, তুর্কি, এবং ভিয়েতনাম) যাদের বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এ অর্জন উন্নয়নশীলতার বিশাল প্রাপ্তি। স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও দেশটির উন্নয়ন নিয়ে অনেকের মাঝেই শঙ্কা ছিল। নতুন দেশটির উন্নতি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ঢাকা এসেছিলেন বিশ্ব ব্যাংকের দুই অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড এবং জে আর পারকিনসন। সার্বিক পরিস্থিতি বিচার বিবেচনা পূর্বক তাঁরা একটি রিপোর্ট তৈরি করেন যা ১৯৭৬ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশঃ দি টেস্ট কেস অফ ডেভেলপমেন্ট’ এই শিরোনামে। রিপোর্টে দুই অর্থনীতিবিদ অত্যন্ত উপহাস আর তাচ্ছিল্যের ছলে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলেন, ‘উন্নয়নের প্রশ্নে বাংলাদেশ হল পৃথিবীর কঠিনতম সমস্যার মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব মানে দুনিয়ার সকল দেশের উন্নয়ন সম্ভব। যদি বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়ও, তাহলেও কমপক্ষে দুইশত বছর সময় লাগবে। তাদের সেই টিপ্পনিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ৫০ বছরেই বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে নিজেদের অস্তিত্ব রাখতে পেরেছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হেনস্থা করতেই বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে স্বাধীনতা বিরোধীরা অপপ্রচার চালাতে থাকে। বাস্কেট কেস মানে তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। বাংলাদেশ কে বাস্কেট কেস বলা অর্থ দেশটি একটি ব্যর্থ দেশ। আজ সেই দেশ অনেক ব্যর্থতা কাটিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে। কোনো অর্জন রাতারাতি সম্ভব নয়। সংস্কৃতিতে একটি প্রচলিত বাক্য আছে ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলেন পরিচয়তে’। আজ বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ উন্নয়নের ‘শো কেস’ হিসেবেই বেশি পরিচিত। ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচন দিবস পালন উপলক্ষে বাংলাদেশ সফরে এলে বাংলাদেশকে ‘শোকেস’ হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি বাংলাদেশের সাফল্যে এতই বিমোহিত হয়ে ছিলেন যে তিনি বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণেও সকলকে অনুপ্রাণিত করেন।
আমরা মানছি আমরা পিছিয়ে ছিলাম, এখনও আছি, তাই বলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে আমরা অকুতোভয়। জাপান, জার্মানি এসব উন্নত দেশগুলো ও আমাদের মতই ছিল।একদিনে ওইসব দেশে মিরাকেল বা চমৎকার হয়নি। বিভিন্ন চড়াই উৎরায় পেরিয়ে ওইসব দেশ আজ উন্নত, শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তবে একথাও অস্বীকার করা যাবেনা, এই ৫০ বছরে যতটুকু উন্নয়ন হতে পারতো তা হয়নি। উন্নয়নের গতি বড়ই ধীর। উন্নয়নের বিভিন্ন মানদণ্ড রয়েছে। যেমনঃ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এবং পরিবেশগত। সব মানদণ্ডে অগ্রগতি যেমন আছে, দুর্বলতা ও আছে।
ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক্স এন্ড বিজনেস রিসার্চ তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে বলেছে বাংলাদেশ এখন যে ধরণের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি। কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্য, ধনী, দরিদ্রের ব্যবধান ও অপরিমেয়। তাছাড়া রয়েছে লিঙ্গ বৈষম্য। যদিও বর্তমান সরকার নারীর ক্ষমতায়নে দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা রাখছে, তবুও দেশের দুঃখের বিষয়, দেশের নারী শ্রমশক্তির হার এখনও ৩৬ শতাংশ। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তা কিছুতেই পর্যাপ্ত নয়। পাশাপাশি রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ব্যাপক দুর্নীতি এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন রাজনৈতিক সামাজিক বিশ্লেষকরা।
স্বাধীনতার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল বাকস্বাধীনতা, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও নেতিবাচক রাজনীতির কারণেই স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও জনগণ এসব অধিকারের নিশ্চয়তা পায়নি। বৈশ্বিক সুশাসকের সূচকে দেশ এখনো নিম্নমুখী। এমতাবস্থায় গণমানুষের হারানো অধিকার ফিরিয়ে আনতে যুব সমাজকে অগ্রসৈনিকের ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্যথায় আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নগুলো কখনোই পূরণ হবে না। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি এতটাই বেড়েছে কাজের বাস্তবতার চাইতে শুভেচ্ছা, স্বাগতম, অভিনন্দনে শুধু পোস্টারের পর পোস্টারে রাস্তা, দেয়াল সয়লাব হচ্ছে। ছোটবেলার একটি কবিতা আজ যেন ঊল্টো সুরে দেশে রূপ নিচ্ছে।
‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’।
এই দুটো পঙক্তির কতো অভাব আমাদের দেশে। কাজের চেয়েও কথার ফুলঝুরি বেশি পরিলক্ষিত হয়। তাই সত্যিকারের উন্নয়ন এখনও অধরা রয়ে গেছে। সরকারের চেষ্টা আছে কিন্তু সরকারের প্রচেষ্টা গুলো বাস্তবায়নেই রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। কেননা সর্ষের মধ্যে রয়েছে ভূত। সরকার তার বিচক্ষণ দৃষ্টিতে সবই অনুধাবন করতে পারছেন। সুধী সমাজ সরকারের সুদৃষ্টি ও সুশাসনের ওপর আস্থাশীল। প্রধানমন্ত্রী প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন, এখনো করছেন। কাণ্ডারি হয়ে আলো দেখিয়ে চলেছেন, আমরাই তাঁর আলোকে আলোকিত হতে পারছিনা।
মানব সভ্যতার কৃষি যুগ থেকে শিল্পযুগ হয়ে এখন ডিজিটাল যুগ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অগ্রসরমান বিশ্বের যুগোপযোগী কর্মসূচি ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করে একটা নতুন অর্থনীতি, একটা নতুন জীবনধারা সৃষ্টির অঙ্গীকার বাস্তবায়নে নিবেদিত। যদিও সহজে কোনোকিছু পাওয়া যায় না, কষ্ট করে অর্জন করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে কষ্টসহিষ্ণু মনোভাব বিলুপ্তির পথে। সবকিছু রাতারাতি চাই। একশ্রেণীর মানুষ ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতায় নীতি-নৈতিকতাকে পাশে রেখে ছুটে চলেছে। আর একশ্রেণীর মানুষ জীবনসংগ্রামে পরাজিত হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে নগরমুখী হচ্ছে। বাংলাদেশে নতুন ধনীর মাত্রা এতো বাড়ছে-‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’-বাগধারাটি যথার্থ তাদের জন্য। ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি সততাই সর্ব উৎকৃষ্ট পন্থা- কিন্তু আজ যেন শঠতাই সর্ব সহজ পন্থা উন্নয়নের জন্য। তাই সৎ মানুষেরা সাধারণ জীবনে আর অসৎ লোকেরা বিলাস জীবনের ধারক ও বাহক। ব্যক্তিস্বার্থের প্রাধান্য দেয়া উন্নয়ন ধারার কারণে আয় বৈষম্য বেড়ে চলেছে। বেকারত্ব আর দারিদ্রে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ হারিয়ে ফেলেছে। সাম্প্রতিক প্রকাশিত গ্লোবাল ওয়েলথ রিপোর্ট-২০২১ অনুসারে, বাংলাদেশে ২১,৩৯৯, মিলনিয়ার ধনী লোক রয়েছে। যাদের প্রত্যেকের সম্পদের পরিমাণ ১-৫ মিলিয়ন ডলার। উল্টোদিকে মহামারীর প্রবল প্রভাবে বাংলাদেশে নব দরিদ্রের সংখ্যা ১৪.৭% যা মোট জনসংখ্যার ২৪.৫ মিলিয়ন। এর মধ্যে শহর বস্তিতে রয়েছে ৫৯% এবং গ্রামে রয়েছে ৪৪%। এই চিত্র সত্যি বড়ই কষ্টের, কিন্তু বাস্তব। মাথা পিছু আয় বেড়েছে ঠিক কিন্তু মানুষের অভাব ছাপিয়ে যেতে পারছেনা। যার নেই তার যেমন অভাব, যার আছে তার যেন আরও অভাব। তাই বাড়ছে বৈষম্য।
স্বাধীনতার পরবর্তী প্রতিটি জাতীয় বাজেটে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনকে গুরুত্ব প্রদান করা হলেও পরিস্থিতির অবনতি ছাড়া উন্নতির লক্ষণ দেখা যায়নি। জনসংখ্যা বেড়েছে, বাজেটের আকার বেড়েছে, যেসব খাতের ব্যয় বরাদ্দ বাড়লে জনগণের মুক্তিতে সহায়ক ভুমিকা রাখতে সক্ষম হতো তার প্রতিটি খাতে শতাংশের হারে ব্যয় বৃদ্ধি তো ঘটেইনি বরং দিনে দিনে শতাংশ হারে কমে গিয়েছে। ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে জীবন সংগ্রামে পরাজিতবোধের লক্ষণ ফুটে উঠছে। ১৯৭১ সালের মাথাপিছু আয় ৬৭১ টাকা আজ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০৬৪ ডলার। ১৯৭১ সালের দেশের বার্ষিক রপ্তানিকেও বাড়িয়ে আকাশ ছোঁয়া করেছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা ও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এত অগ্রগতির মধ্যে আর্থিক বৈষম্য প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে।
বাংলাদেশের শিক্ষার মান এখনো বিশ্বের প্রথম ১০০ টি দেশের মধ্যেও নেই। বিষয়টি লজ্জার পাশাপাশি চিন্তারও বটে। গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স এ বাংলাদেশের স্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পর্যাপ্ত কার্যক্রম পরিচালনা অনস্বীকার্য। জাতীয় জীবনে শিক্ষার সুফল দ্রুত পৌঁছে দিতে শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন করা, বৈশ্বিকভাবে বর্তমানের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো, মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ, জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে কর্মদক্ষতা অর্জন ও সামাজিক উৎপাদনে অংশগ্রহণ করার মতো ক্ষমতা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
সর্বোপরি, দেশের ছাত্র সমাজকে ধরে রাখতে হলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মান সম্মত করতে হবে। ৫০ বছরের এই যাত্রাই অনেক উত্থান পতন এসেছে, কিন্তু সব কিছু কাটিয়েও ঊঠেছে। আমরা আমাদের ব্যর্থতাকে আমাদের সফলতার চাবিকাঠি ভেবেই এগিয়ে যাবো, পালিয়ে বেড়ালে বা গোপন করে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ দেশ আমার, আপনার, সকলের। নিজের দেশের মতো শান্তি আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়না। বিশ্বের বুকে লাল সবুজের একটি দেশ, বাংলাদেশ, কতো গৌরবের, যার হাত ধরে আমরা বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পেলাম, সেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ, তিতিক্ষাকে আমাদের চলার পথের পাথেয় করতে হবে, তবেই আমাদের এই দেশ সোনার বাংলা হবে অচিরেই।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, অর্থনীতি বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধজলবায়ু সম্মেলন, বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি এবং করণীয়
পরবর্তী নিবন্ধওই ছাত্রী আত্মহত্যা করলেন কেন