কমছে বিটিসিএল-এর গ্রাহক সংখ্যা, বাড়ছে লোকসান : দায় কার

রেজাউল করিম স্বপন | রবিবার , ১২ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:৫৮ পূর্বাহ্ণ

কয়েকদিন আগে বিটিসিএল (সাবেক টিএন্ডটি) এর একটি নিউজ দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। দেখলাম গত কয়েক বছরে বিটিসিএল-এর গ্রাহক সংখ্যা কমেছে ও লোকসানের পরিমাণ বেড়েছে। অথচ বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) বাংলাদেশের সরকারি টেলিফোন সংস্থা ও দেশের সর্ববৃহৎ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ড (বিটিটিবি) হিসেবে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে ১ জুলাই ২০০৮ সালে বিটিটিবিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি বিটিসিএল এ রূপান্তর করা হয়। বর্তমানে বিটিসিএল এর সম্পদের আনুমানিক মূল্য ১৫,০০০ কোটি টাকা,যা সারাদেশে থানা পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্তমানে বিটিসিএল বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে ল্যান্ড টেলিফোন পরিষেবা দিয়ে থাকে।যার মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক কলিং পরিষেবার পাশাপাশি ইন্টারনেট পরিষেবাও দেয়। ২০০৪ সালে সরকার বেসরকারী সংস্থাগুলিকে বেশ কয়েকটি পিএসটিএন লাইসেন্স দিয়েছিলো। কিন্তু ঢাকার লোভনীয় বাজারে (যেখানে দেশের বাজারের বেশিরভাগ অংশ রয়েছে) তাদের পরিষেবা প্রদান থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। তবে ২০০৭ সাল থেকে যখন বেসরকারি অপারেটররা লাইসেন্স পেতে শুরু করে তখন থেকে বিটিসিএল এর একচেটিয়া ব্যবসার পতন ঘটে এবং বিটিসিএল এর গ্রাহক সংখ্যা কমতে থাকে। তবে গত দশ বছরে এর গ্রাহক সংখ্যা দ্রুত কমেছে ফলে সংস্থাটির আয়ও কমছে বিপরীতে এর লোকসান বেড়েছে।
অথচ ১৯৯০ সালের দিকে বিটিটিবি ছিলো দেশের সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ব্যস্ততম দপ্তর। তখন কারো অফিস বা বাসায় টেলিফোন থাকা একটি প্রেস্টিজিয়াস বিষয় ছিলো।একটি টেলিফোন লাইন পাওয়ার জন্য মানুষ দিনের পর দিন অপেক্ষা করতো। অনেকে এমপি,মন্ত্রীর কাছে ধর্না দিয়ে রিকমেন্ডেশন নিয়ে টেলিফোনের লাইন নিয়েছিলো। আবার অনেকে দালালের খপ্পরে পড়ে টাকা পয়সাও হারিয়েছিলো। তখন টিএন্ডটি অফিস সারাদিন গ্রাহকের পদচারনায় সরগরম থাকতো। যদিও তখন বিটিটিবির সেবা ছিলো এনালগ, নিম্নমানের ও কল চার্জ ছিলো অত্যধিক বেশি। তবু টেলিফোন নেওয়ার জন্য মানুষ বিভিন্ন জায়গায় ধর্না দিয়ে কানেকশন না পেয়ে শেষ পর্যন্ত লাইনম্যান দের সাথে যোগাযোগ করতো। লাইনম্যানেরা মাসের পর মাস ঘুরিয়ে ৩০-৪০হাজার টাকার বিনিময়ে টেলিফোন এর ব্যবস্থা করে দিতো।এর বাহিরে ট্রান্সফার ফিসহ অন্যান্য খরচও বহন করতে হতো।কানেকশান নেওয়ার পর শুরু হতো নতুন বিড়ম্বনা-টেলিফোনে শো শো আওয়াজ, ক্রস কানেকশন,এক নাম্বারে কল করলে আরেক নাম্বারে চলে যাওয়া,কারো সাথে কথা বলার সময় অন্য লাইন ঢুকে যাওয়া ইত্যাদি।এসব বিষয়ে টিএন্ডটিতে কমপ্লিন করলে লাইনম্যানের সহকারীরা আসতো। তবে তাদের চাহিদামত টাকা দিতে হতো।এভাবে চলার পর ১৯৯৩ সালে এলো মোবাইল কোম্পানি সিটিসেল মোবাইল ফোন।যদিও তখন এক একটি কনেকশনের দাম ছিলো লাখ টাকার উপর। আর্থিক সংগতিওয়ালা অনেকেই সেটি নিলেন। পরবর্তীতে গ্রামীণ একেটেল বাংলালিংক সহ আরো অনেক মোবাইল কোম্পানি বাজারে আসায় মোবাইল কোম্পানিগুলোর মধ্যে সার্ভিস দেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়।এতে করে সেবার মান উন্নত হয় ও মোবাইলের কল রেইটসহ সংযোগ ফি কমতে থাকে। বর্তমানে ফ্রিতে মোবাইল সংযোগ পাওয়া যায়, অথচ ১৯৯০ সালের দিকে তা ছিলো অকল্পনীয়। প্রশ্ন হলো এখন কল রেইট ও সংযোগ ফি এতো কম কেন? এর একমাত্র কারণ মোবাইল কোম্পানিগুলোর মধ্যে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা।এরিমধ্যে টিএন্ডটি (বিটিসিএল) তাদের কল রেইট কমানো শুরু করে, যা বর্তমানে মাসিক চার্জ ১৫০/-(আন লিমিটেড) টাকা ও কানেকশন ফি ঢাকা শহরে ১০০০/- ও বিভাগীয় শহরে ৬০০/- এবং অন্যান্য জায়গায় ৩০০/- টাকা।এখন বিটিসিএল ইন্টারনেট সেবাও দিয়ে থাকে। যার প্যাকেজ মূল্য ৫০০/-হতে ১,৬৫০/-। এরপরেও তাদের ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা হাতে গোনা মাত্র ৩০ হাজার, যার বেশির ভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠান। অথচ বিটিসিএলের সেবা ও অফিস সারাদেশে বিস্তৃত। বিপরীতে দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গ্রাহক ১ কোটির বেশী যার সবটুকু বেসরকারী কানেকশন। বর্তমানে বিটিসিএলের জনবল ৭ হাজারের কম। টেলিফোন কনেকশন কমে যাওয়ায় বিটিসিএলের আয়ও ক্রমান্বয়ে কমছে। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে দেওয়া নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯-২০ সালে বিটিসিএলের রাজস্ব আয় প্রায় ৭১৬ কোটি টাকা। অথচ ২০১৭-১৮ সালে ছিেেলা প্রায় ১,১৪০ কোটি টাকা। বিটিসিএল ২০১৭-১৮ সালে টেলিফোন থেকে আয় করে প্রায় ২২৬ কোটি টাকা, যা ২০১৯-২০ কমে প্রায় ১৪৮ কোটিতে দাঁড়ায়। সবচেয়ে বেশি আয় কমেছে ইন্টারনেট গেইটওয়ে সেবা থেকে। এ খাতে ২০১৭-১৮ তে আয় ছিলো প্রায় ৭৬৯ কোটি টাকা ও ২০১৯-২০ এ দাড়ায় ৩৯৭ কোটি টাকায়।তবে ইন্টারনেট ডেটা সেবা খাতে আয় কিছুটা বেড়েছে। তবুও সামগ্রিক ভাবে ২০১৯-২০ সালে বিটিসিএলের লোকসান দাঁড়ায় ৩২৪ কোটি টাকায়। এর আগের ২০১৫-১৬ তে লোকসান ছিলো ৩৩৬ কোটি টাকা,২০১৬-১৭ তে লোকসান ছিলো ১৮৩ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ তে লোকসান ছিলো ৪৩৩ কোটি টাকা,২০১৮-১৯ তে লোকসান ছিলো ৩৬৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে লোকসান বাড়ছে। অন্যদিকে টেলিফোনের গ্রাহক সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমছে। ২০১২-১৩ তে গ্রাহক ছিলো ৯.০৩ লাখ,২০১৪-১৫ তে গ্রাহক ছিলো ৭.৭১ লাখ,২০১৬-১৭ তে গ্রাহক ছিলো ৬.৬২ লাখ,২০১৮-১৯ তে গ্রাহক ছিলো ৫.৩০ লাখ, জানু ২০২০ এ গ্রাহক ছিলো ৫.১৮ লাখ ও সেপ্টেম্বর ২১ এ গ্রাহক সংখ্যা ৪.৮৪ লাখ। অর্থাৎ গ্রাহক সংখ্যা দিনকে দিন কমছে।এখন প্রশ্ন হলো এই যে গ্রাহক সংখ্যা কমছে ও লোকসান ক্রমান্বয়ে বাড়ছে-এটি কেন হচ্ছে? তা কি সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিরা কখনো ভেবে দেখেছেন? এতে তাঁদের কি কোনো দায় নেই? ঐ দিকে বেসরকারি মোবাইল কোম্পানিগুলোর একই ব্যবসা বছর বছর বাড়ছে ও হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করছে।
তাই সময় এসেছে সরকারি খাতে এই সব লোকসান বন্ধ করার। কারণ সাধারণ জনগণের করের টাকায় বছরের পর বছর কোন একটি খাতে লাগাতার লোকসান দেওয়া কোনভাবে কাম্য নয়। তাই এর কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে বিটিসিএলের লাভ লোকসানের ভাগীদার করা সময়ের দাবি। আর এটির মাধ্যমে লোকসান বন্ধ করতে পারলেই আমরা খুব দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে পারবো।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে