শ্রম আইন ও বিধিমালার আলোকে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা

ফজলুল কবির মিন্টু | সোমবার , ৬ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ

কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সেবা এবং নিরাপত্তা সুবিধা প্রতিটি শ্রমিকের বৈধ এবং আইনগত অধিকার। শ্রমিকদেরকে একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্ম পরিবেশ প্রদান করা এবং কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পেশাগত স্বাস্থ্য এবং নিরাপদ পরিবেশের অনুশীলন করা প্রত্যেক মালিকের নৈতিক ও আইনগত কর্তব্য হলেও তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। শ্রম আইন ২০০৬ এর ৫১ হতে ৯৯ ধারা সমূহে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা ও কল্যাণ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অত্র নিবন্ধে শ্রম আইন ও বিধিমালার আলোকে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরপত্তা সংক্রান্ত মূল ধারা ও বিধি সমূহ আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
শ্রম আইনের ৫৭, ৫৮ এবং ৫৯ ধারা অনুসারে পর্যাপ্ত আলো, বিশুদ্ধ পানি, শৌচাগার ও প্রক্ষালন কক্ষের ব্যবস্থা করার কথা উল্লেখ আছে। বিধিমালার তফসিল-২ অনুসারে প্রথম ১০০ জন নারী শ্রমিকের ক্ষেত্রে প্রতি ২৫ জনের জন্য ১টি করে অতঃপর প্রতি ৫০ জনের জন্য ১টি করে শৌচাগার থাকা বাধ্যতামূলক। একইভাবে প্রথম ১০০ জন পুরুষ শ্রমিকের ক্ষেত্রে প্রতি ৪০ জনের জন্য ১টি করে অতঃপর প্রতি ৬০ জনের জন্য ১টি করে শৌচাগার থাকা বাধ্যতামূলক। আবার প্রতি ১০০ জন পুরুষ শ্রমিকের জন্য কমপক্ষে ১টি করে প্রক্ষালন কক্ষের ব্যবস্থা করা বাধ্যতামূলক।
শ্রম আইনের ৬২ এর (১) উপধারা মোতাবেক প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে বিধি দ্বারা নির্ধারিতভাবে অগ্নিকাণ্ডের সময় প্রত্যেক তলার সাথে সংযোগ রক্ষাকারী অন্তত একটি বিকল্প সিঁড়িসহ বহির্গমনের উপায় এবং প্রত্যেক তলায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। বহির্গমনের পথ তালাবদ্ধ বা আটকাইয়া রাখা যাবে না এবং বহির্গমনের পথ বাধাগ্রস্থ কিংবা পথে কোন প্রতিবন্ধকতাও তৈরী করা যাবে না।
উপধারা (৮) অনুসারে পঞ্চাশ বা ততোধিক শ্রমিক/কর্মচারী সম্বলিত কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে প্রতি ছয় মাসে অন্ততঃ একবার অগ্নিনির্বাপণ মহড়ার আয়োজন করতে হবে এবং এ বিষয়ে মালিক কর্তৃক নির্ধারিত পন্থায় একটি রেকর্ড বুক সংরক্ষণ করতে হবে৷
ধারা ৭২ অনুসারে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে-
(ক) সকল মেঝে, সিঁড়ি, চলাচলের পথ মজবুতভাবে নির্মাণ করতে এবং যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে এবং প্রয়োজন হলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মজবুত রেলিং এর ব্যবস্থা করতে হবে এবং কর্মকালীন নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য পথ ও সিঁড়ি উন্মুক্ত রাখতে হবে; এবং
(গ) কর্মস্থলের চলাচলের পথ ও সিঁড়ি পরিচ্ছন্ন, প্রশস্ত ও বাধা-বাধাহীন হতে হবে।
(ঘ) মালিক শ্রমিকদের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে কর্মস্থলের চলাচলের পথ, সিঁড়ি, গেইট, গুদাম ও সাধারণ ব্যবহারিক স্থানসমূহ (Common Utility Area) ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতায় আনতে পারবে।
ধারা ৮২ এর উপধারা (১) অনুসারে যে ক্ষেত্রে দ্বিতীয় তফসিলে উল্লিখিত ব্যাধি দ্বারা কোন প্রতিষ্ঠানে কোন শ্রমিক আক্রান্ত হন, সে ক্ষেত্রে মালিক অথবা সংশ্লিষ্ট শ্রমিক অথবা তৎকর্তৃক নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি, বিধি দ্বারা নির্ধারিত ফরমে ও সময়ের মধ্যে, তৎসম্পর্কে পরিদর্শককে নোটিশ মারফত অবহিত করবেন।
(২) যদি কোন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কোন প্রতিষ্ঠানের বর্তমান বা ভূতপূর্ব কোন শ্রমিককে চিকিৎসাকালে দেখেন বা সন্দেহ করেন যে, তিনি দ্বিতীয় তফসিলে উল্লিখিত কোন ব্যাধিতে ভুগতেছেন তাহলে উক্ত চিকিৎসক অবিলম্বে একটি লিখিত রিপোর্ট মারফত প্রধান পরিদর্শককে অবহিত করবেন।
ধারা ৮৬ এর উপধারা (১) অনুসারে যে ক্ষেত্রে কোন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক দেখতে পান যে, উহার কোন ভবন বা যন্ত্রপাতি, যা শ্রমিকেরা সাধারণতঃ ব্যবহার করেন এমন বিপজ্জনক অবস্থায় আছে যে, উহা যে কোন সময় কোন শ্রমিকের শারীরিক জখম প্রাপ্তির কারণ হতে পারে, সে ক্ষেত্রে তিনি অবিলম্বে তৎসম্পর্কে লিখিতভাবে মালিককে অবহিত করবেন।
উপধারা (২) অনুসারে উক্তরূপ সংবাদ প্রাপ্তির পর মালিক যদি তিন দিনের মধ্যে তৎসম্পর্কে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন এবং উক্ত ভবন বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার কারণে কোন শ্রমিক যদি জখম প্রাপ্ত হন তাহলে মালিক, অনুরূপ জখমপ্রাপ্ত শ্রমিককে, দ্বাদশ অধ্যায়ের অধীন উক্তরূপ জখমের জন্য প্রদেয় ক্ষতিপূরণের দ্বিগুণ হারে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবেন৷ ধারাটিতে কেবল ক্ষতিপূরণ দ্বিগুন দেয়ার কথা বলা হয়েছে কিন্তু মালিকের দায়বদ্ধতার কথা কিছুই উল্লেখ নাই। কাজ করার জন্য ভবন বা যন্ত্রপাতি বিপজ্জনক অবস্থায় আছে মনে হলে শ্রমিক যাতে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে সে অধিকার শ্রমিককে দিতে হবে।
কাজের প্রকৃতিগত কোন সমস্যা থাকলেও শ্রমিকের জীবন হুমকীর সম্মুখীন হয়। যেমন স্বাস্থ্য সেক্টরে কর্মরত এক্সরে ডিপার্টমেন্ট এ কর্মরত শ্রমিকেরা রেডিয়েশনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জাহাজভাঙ্গা শিল্পের শ্রমিকদের এসবেস্টস গ্যাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। উচ্চ শব্দ সৃষ্টি হয় এমন জায়গায় কাজ করলে দীর্ঘ মেয়াদে শ্রমিকের শ্রবণ শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। আবার কম বা বেশি আলোতে কাজ করলে শ্রমিকের দৃষ্টি শক্তি ধীরে ধীরে লোপ পায়। উপরে বর্ণিত বিষয়াদির কোন এক বা একাধিক কারনে যদি কোন শ্রমিক রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে তাকে পেশাগত রোগ বলে। আবার তাজরীন ফ্যাশনে আগুন, রানা প্লাজায় ধস, সম্প্রতি সেজান জুস কারখানায় আগুন মালিকের গাফিলতি এবং অবকাঠামোগত সংকটের কারনে সৃষ্ট দুর্ঘটনা। কোন কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার কারণে কোন শ্রমিক আহত হলে আমরা তাকে পেশাগত দুর্ঘটনা বলি।
কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকেরা পেশাগত রোগে বা দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে এমন কোন কারণ চিহ্নিত হলে নিয়োগ কর্তাকে সর্বপ্রথমে কারণ সমূহ দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে শ্রমিকদেরকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি সরবরাহ করে শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপদ রাখতে হবে। অনেক সময় সচ্‌েতনতার অভাবে কিংবা অনভ্যাসের কারণে শ্রমিকরা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি ব্যবহার করতে অনীহা প্রকাশ করে। তাই শ্রমিকদেরকে ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি ব্যবহারের গুরুত্ব অবহিতকরন পূর্বক নিয়মিত প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়াও মালিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। শ্রম আইনের ১৫০(২) এর দফা ”খ” তে দুর্ঘটনা কারণ শ্রমিকের মদ্যপান, মাদকদ্রব্য সেবন কিংবা নিরাপত্তা সংক্রান্ত নির্দেশনা অমান্যের কারণে সৃষ্ট দুর্ঘটনা হতে মালিক পক্ষের দায় মুক্তির আইন গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা।
পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এমন শ্রমিকদের নিয়মিত মেডিকেল চেকআপের মধ্যে রাখতে হবে। যদি কোন শ্রমিক পেশাগত রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে তাকে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট শ্রমিককে অর্ধ বেতনে ২ বছর পর্যন্ত ছুটি প্রদানের কথা শ্রম আইনে উল্লেখ আছে। তবে পেশাগত রোগে আক্রান্ত হয়ে পরবর্তীতে মারা গেলে তার ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে কোন কিছুরই শ্রম আইনে উল্লেখ নাই।
অন্যদিকে পেশাগত দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কোন শ্রমিক মারা গেলে তার উত্তরাধীকারীরা ২ লক্ষ টাকা, সম্পূর্ণ পঙ্গু হলে ভুক্তভোগী শ্রমিক ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, আংশিক পঙ্গু হলে তফসীল ১ অনুযায়ী পঙ্গুত্বের হার নির্নয় করে ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার আনুপাতিক হারে ভুক্তভোগী শ্রমিক এককালীন ক্ষতিপূরণ পাবে এবং চিকিৎসাধীন শ্রমিকের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করে ১ বছর পর্যন্ত বেতন সহ ছুটি শ্রম আইন অনুযায়ী আহত শ্রমিক পাওয়ার অধিকারী।
কিন্তু শ্রম আইনে বর্ণিত কর্মক্ষেত্রে পেশাগত রোগ বা দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত আইন অত্যন্ত দুর্বল, ত্রুটিযুক্ত এবং আইএলও কনভেশন ১০২ ও ১২১ এর সাথে সাংঘর্ষিক। শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ Year Loss এবং sufferings নির্ণয়পূর্বক হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। বস্তুত আহত বা নিহত হয়ে ক্ষতিপূরণ আদায় করা কোন শ্রমিকেরই কাম্য নয়। তাই দুর্ঘটনা প্রতিরোধের ব্যাপারে আইন ও বিধিমালা প্রণয়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার থাকতে হবে। আহত শ্রমিকের পূর্ণ বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিতে হবে।
প্রায়শঃ সাপ্তাহিক ছুটি না দিয়ে এবং দৈনিক ৮ ঘন্টার অতিরিক্ত কাজ করানো আমাদের শ্রম খাতের একটি সাধারণ চিত্রে পরিণত হয়েছে। যা শ্রমজীবী মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রচন্ডভাবে প্রভাব ফেলে সুতরাং এ বিষয়েও গুরুত্ব সহকারে ভাবনার অবকাশ রয়েছে।

লেখক : প্রোগ্রাম অফিসার, বিলস্‌ এবং সংগঠক,
টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধখুব দ্রুত আমাদের চেনা পৃথিবীটা বদলে যাচ্ছে
পরবর্তী নিবন্ধহারিয়ে গেছে হারানো ঐতিহ্য