ম্যায় আকেলা হি চলা থা জানিব-এ-মঞ্জিল মাগার
লোগ সাথ সাথ আতে গ্যয়ে অউর কারভাঁ বানতা গ্যয়া
(গন্তব্যের দিকে আমি তো একাই ছুটছিলাম/
আমার সঙ্গে পথ মেলালো কতোজন/ আমরা এক কাফেলা হয়ে উঠলাম)
মীর তাকী ‘মীর’ বা মির্জা গালিবের মতো মাস্টার কবিদের বাদ দিয়ে, খুব কমই দেখা যায় যে, একটি উর্দু কাপলেট এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এত বেশীবার উদ্ধৃত হয় যে এটি দৈনন্দিন বক্তব্যের অংশ হয়ে যায় এবং হয়তো কেউ কেউ এর স্রষ্টার নামও মনে জানে না। উপরের উদ্ধৃত কাপলেটটির ক্ষেত্রে এমনটিই হয়েছে।
তাঁর জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশশাসিত ভারতের উত্তর প্রদেশে নিজামাবাদ শহরে। তাঁর বাবা সিরাজুল হক খান ছিলেন একজন পুলিশ কনস্টেবল, ছেলেকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। পরে ইউনানী চিকিৎসাবিদ্যায় লেখাপড়া শেষে হাকিম হিসেবে কাজ শুরু করেন। লেখার ঝোঁক ছিল খুব, তাই কাজের পাশাপাশি গজলও লিখতে শুরু করেন। বিভিন্ন মুশায়ারাতে (কবিতা পাঠের আসর) তখনই বেশ ভাল সমাদৃত হতে থাকেন। এক সময় হাকিম পেশা ছেড়ে দিয়ে পুরোদমে লেখায় মনযোগী হন।
তেমনি এক মুশায়রাতে অংশ নিতেই মুম্বাই যান, সেই অনুষ্ঠানে অন্যান্য অনেক অতিথির মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা, পরিচালক এবং প্রযোজক এ আর কারদার। তাঁর জীবনের চরম বাঁক এখানেই। যদিও সিনেমার গান লেখার কোন আগ্রহ ভদ্রলোকের ছিল না, কিন্তু কারদার সাহেব তাঁকে নিয়ে যান আরেক বিখ্যাত কবি জিগার মোরাদাবাদির কাছে। জিগার সাহেব তাঁকে বুঝাতে সক্ষম হন যে সিনেমায় গান লিখলে প্রচুর অর্থকড়ি পাওয়া যাবে। এরপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় বিখ্যাত কম্পোজার নওশাদ সাহেবের কাছে। নওশাদ সাহেব তাঁকে তৎক্ষণাৎ একটা সুর দিয়ে বলেন এই সুরের জন্য গান লিখতে। সেই শুরু ছয় দশকের ক্যারিয়ারের। ও হ্যাঁ, ভদ্রলোকের নাম হল আসরার উল হাসান খান। চেনা যাচ্ছে না, তাইতো? তাঁর জীবনে ছদ্মনাম একেবারেই নতুন নয়, লেখালেখির সূচনাটাও হয়েছিল ছদ্মনাম দিয়ে, নাম ছিল তখন – নাসেহ (ধর্ম প্রচারক)। তো, এসব নামে তাঁকে চিনতে পারাটা আসলেই সহজ নয়। কোন এক রমনীর মন জয় করতে না পেরে পরে বন্ধুদের পরামর্শে নাম রাখেন মাজরুহ (আহত) সুলতানপুরী। এবার খুব চেনা যাচ্ছে। ১৯৪০ এর দশকের মাঝামঝি যে যাত্রার শুরু, অসাধারণ সব গীতিকবিতা দিয়ে সকলকে মুগ্ধ করে গেছেন মৃত্যু অব্দি। এবং এখনও কি করছেন না! মোহাম্মদ রফি, লতা মুঙ্গেশকর, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখপাধ্যায় থেকে শুরু করে হরিহরণ, অলকা ইয়াগনিকও তাঁর লেখা গান গেয়েছেন।
মাজরুহ সুলতানপুরী এবং জান নিসার আখতার জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন একবার। সেসময় গোটা ভারত জুড়ে জরুরি অবস্থা বিরাজ করছিল। মাজরুহ তাঁর গজলগুলি সুরেলা কিন্তু দৃপ্তকণ্ঠে আবৃত্তি করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে সালে একটি মিল ইউনিয়ন শ্রমিক সভায় কবিতা আবৃত্তির জন্য দুই বছর জেল খেটেছিলেন যা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কঠোর সমালোচনা করে লেখা। তিনি ছিলেন একজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কমিউনিস্ট এবং অল ইন্ডিয়া প্রগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এআইপিডব্লিউএ) সদস্য। ‘ইয়ে আজাদী ঝুটি হ্যায়’ (এই স্বাধীনতা মিথ্যা) কমিনিস্ট পার্টির তখন এটাই ছিল চিন্তাধারা। মহারাষ্ট্র সরকার তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছিল এবং জেল এড়াতে চাইলে ক্ষমা চাইতে বলেছিল।
এতে নত হননি মাজরুহ, বরং আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। পরবর্তীতে রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তানে ফয়েজ আহমেদ ‘ফয়েজ’, সাজ্জাদ জহির এবং অন্যদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে আয়োজিত একটি সভায় যোগ দিতে জনসমক্ষে উপস্থিত হন। বৈঠকশেষে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
তাঁর হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্পে বিরাট অবদান স্বীকৃত হয়েছিল যখন তিনি ১৯৯৩ সালে মর্যাদাপূর্ণ দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত প্রথম গীতিকার হিসেবে। ২০১৩ সালে, একটি স্মারক ডাকটিকিটও জারি করা হয়েছিল তাঁর উপর। ১৯৭৬ সালে ‘হাম কিসিসে কম নেহি’ কিংবা ১৯৮৯ সালের ‘ক্যায়ামত সে ক্যায়ামত তক’ সহ তাঁর মৃত্যু অব্দি অসংখ্য জনপ্রিয় গান লিখবার পরেও তিনি একবার বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালের পরে তিনি গান লিখবার সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বলেছিলেন, ‘আমি এখনও লিখছি, কিন্তু কলমের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে গেছে।’
পেয়িং গেস্ট (১৯৫৭), ন দো গারা (১৯৫৭), সুজাতা (১৯৫৯), কালা পানি (১৯৫৮), তিন দেবিয়া (১৯৬৫), জুয়েল থিফ (১৯৬৭) এই সমস্ত বিখ্যাত সিনেমা রাহুল দেব বর্মনের সঙ্গে জুটি বেঁধে। এছাড়াও বেশ কিছু ড্যান্স নাম্বার, যেমন ও মেরি সোনা রে (তিসরি মঞ্জিল ১৯৬৬), পিয়া তু, আব তু আজা (কারাভান, ১৯৭১), চুরা লিয়া হ্যায় (ইয়াদো কি বারাত, ১৯৭৩) ও তাদের সে সময়কার সৃষ্টি। শচীন দেব বর্মন থেকে শুরু করে অনীল বিশ্বাস, মদন মোহন, নওশাদ, ও পি নাইয়ার, রোশান, লক্ষীকান্ত প্যারেলাল, যতীন ললিত, আনন্দ মিলিন্দসহ আরও অনেকের সাথেই তাঁর দারুণ সব কাজ রয়েছে।
টকিজ চালু হওয়ার পর থেকেই হিন্দি সিনেমা দারুণ সব গীতিকারের আশীর্বাদ পেয়েছে। এই গীতিকাররা সিনেমার গানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, বিশেষ করে ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর স্বর্ণযুগে।
কিন্তু মজরুহ সুলতানপুরী ছিলেন একজন বিরল গীতিকার, যিনি কেবল পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে হিন্দি সিনেমায় কাজ করেননি বরং সবসময় প্রাসঙ্গিক এবং জনপ্রিয় ছিলেন। মাজরুহ কিংবদন্তি অভিনেতা-গায় কেএল সায়ল (শাহজাহান, ১৯৪৬) থেকে শুরু করে ১৯৯০ সালে জো জিতা ওয়হি সিকান্দার (আমির খান, ১৯৯০), শাহরুখ খান (বাজিগর, ১৯৯৩) এবং সালমান খান (জনম সামঝা কর, ১৯৯৯) এর জন্য গান লিখে গেছেন এবং যার বেশীরভাগই তুমুল জনপ্রিয়।
তাঁর কিছু বিখ্যাত গান নিচে উল্লেখ করা হল-
ক্যায়া হুয়া তেরা ওয়াদা, ও কসম, ও ইরাদা
লেকে পেহেলা পেহেলা প্যায়ার
ইয়ে আপনা দিল তো আওয়ারা
অ্যায়সে না মুঝে তুম দেখো
জব দিল-হি টুট গ্যায়া
পেহেলা নেশা
পাপা ক্যাহেতে হ্যায়
বাঁচনা এয় হাসিনো
চান্দ মেরা দিল, চাঁদনী হো তুম
চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে জো দিলকো
দিল দেকে দেখো
বারবার দেখো, হাজার বার দেখো
ছোঁড় দো আঁচল, জামানা ক্যায়া কাহেগা
বাহোকে দাড়মিয়া
আজ ম্যায় উপর