মঙ্গোল বনাম মোগল ধাঁধা
নীল রঙয়ের চিনামাটির চমৎকার ঐ টবগুলোর একটার পাশে দাঁড়ানো হেলেনের ছবি তোলার জন্য মোবাইলের লেন্স তাক করে ফোনের পর্দায় চোখ যেতেই, নজরে এলো ঐ টব সংলগ্ন গোলাকৃতির বিশাল থামটির গোড়ার দিকে খয়েরি রঙয়ের মার্বেল পাথরে করা চমৎকার কারুকাজের দিকে। বেশ লম্বা চওড়া এই করিডোরটার ডান দিকটায় হলো এই হলের বহিরাংশ, বাঁয়ে গ্রেট হলের অন্দরমহল। ডান দিকটা বহিরাংশ হওয়ার কারণে এখানে সূর্যের প্রাকৃতিক আলো আসে সুপ্রচুর, যার কারণে এখানকার এই গোলাকৃতি বিশাল থামগুলোর ফাঁকে ফাঁকে রাখা হয়েছে সবুজ গাছ বুকে ধরে রাখা ঐ বিশাল আর চমৎকার নীল টবগুলো।
এদিকে হেলেনের দেখাদেখি এরই মধ্যে অন্যেরাও যখন যোগ দিল একই পটভূমির ছবি তোলাতুলিতে, সেই সুযোগে সে কাজে নিজে ইস্তফা দিয়ে, করিডোরটা এই ফাঁকে একটু জরিপ করে নেবার মানসে হেলেনকে তার ছোয়াফন ফিরিয়ে দিয়ে, হাঁটতে শুরু করলাম একা করিডোর ধরে। হাঁটতে হাঁটতে খুব ভাল করে দেখে বোঝার চেষ্টা করছি বিশাল এই গোলাকৃতির চমৎকার থামগুলো আসলে কিসের তৈরি। এগুলোর গোড়ার দিকটায় আর মাথার দিকটায় ঐ যে বললাম খয়েরি রঙয়ের মার্বেলের চমৎকার কারুকাজ থাকলেও, এই দুইয়ের মাঝখানের সুদীর্ঘ অংশ সাদাটে রঙয়ের, যার মধ্যে পড়েছে ছাই রঙয়ের আভা, তাতে থামগুলোকে সব আগাগোড়া মার্বেলে পাথরেরই তৈরি মনে হচ্ছে। কিন্তু আর সব বিষয়ের মতো এ বিষয়েও অকাট গোমুর্খ হওয়ায়, এ ব্যাপারে কোন স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম না।
তবে উর্ধ্বমুখে টান টান সটান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই থামগুলোর দিকে তাকিয়ে এর ভেতরের প্রবল শক্তির ব্যাপারটা ঠিকই আন্দাজ করতে পারছি। আর হবেই বা না কেন তা? না হলে কি গ্রেটহলের মতো অতো বিশাল এই স্থাপনার ছাদের ভার দ্বিধাহীনভাবে নিজ কাঁধে নিয়ে কেউ ওরকম অনায়াস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? আচ্ছা, এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে থাকা এই থামগুলোর উচ্চতা কতো হবে? সামনের ডানে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা থামগুলো হাঁটতে হাঁটতে জরিপ করতে করতে উপরের দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করতে চেষ্টা করলাম। নাহ চোখেও আমার যে কোন গজ ফুট মাপার মতো ফিতা বসানো নাই, টের পেলাম তাও। অতএব একবার মনে হচ্ছে, হবে এগুলো আমাদের দেশের প্রমাণ সাইজের দালানের তিন তলার সমান, আবার মনে হচ্ছে না, চার তলা হবে!
এমতাবস্থায় অদূরে সামনের বাঁ দিকে, গ্রেটহলের অন্দরমহলের দিকে দিকনির্দেশ করা সবুজ রঙয়ের একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়লো, দাঁড়িয়ে আছে যা একটা বুক সমান উঁচু একটা পিতলের স্ট্যান্ডে। কপাল ভাল সে সাইনবোর্ডটা দ্বিভাষিক। উপরের দিকে বড় বড় অক্ষরে চায়নিজে যাই লেখা থাকুক, তার নীচে তুলনামূলক অনেক ছোট হরফে, ইংরেজিতে পরিষ্কার লেখা আছে মঙ্গোলিয়া। ঐ লেখার সাথে দেয়া আছে একটা তীর চিহ্নও; যা দিয়ে নির্দেশ করা আছে যেতে হবে কোনদিকে, মঙ্গোলিয়ার হদিস পেতে! যদিও এমন একটা চমৎকার শৈল্পিক আবহের মাঝখানে সবুজরঙয়ের ঐ সাইনবোর্ড মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্ট্যান্ডটির উপস্থিতি বড়ই বেখাপ্পা রকমের বিরক্তিকর মনে হচ্ছে, তবে ঐ সাইনবোর্ডের মঙ্গোলিয়া লেখাটা দেখার সাথে সাথে তড়িৎ প্রবাহের মতো সেই বিরক্তিকে দূরে ঠেলে দিয়ে সে জায়গা দখল করে নিল উত্তেজনা। আর সে উত্তেজনায়, ২৫/৩০ মিটার দূরে যেখানে পরিবারের সবাই এই মুহূর্তে ব্যস্ত ছবি তোলার হুজুগে, ডাকলাম তাদের একটু উঁচু গলাতেই, খাস বাংলায়।
কোন স্থাপত্যশৈলীর শুধু অন্তর্নিহিত নয়, বহিরঙ্গেরও রূপরস আস্বাদন করার ব্যাপারে চরম অশিক্ষিত হওয়ার পরও আমি যখন বেকুবের মতো তুমুল ব্যস্ত ছিলাম গ্রেটহলের এই অংশের স্থাপত্যকলার রূপ আস্বাদনে, সে মুহূর্তে বেমক্কারকম দৃষ্টিকটুভাবে দাঁড়িয়ে থাকা এই সাইনবোর্ড প্রথমে বিরক্তি উদ্রেক করলেও পরবর্তীতে তার বুকের লেখা হঠাৎ আমাকে উত্তেজিত করে তোলার কারণ হলেন, আর কেউ নন, মঙ্গোল বীর চেঙ্গিস খাঁ! গল্প যার শুনেছিলাম ছোটবেলায় আব্বার মুখে।
সেই উত্তেজনার চোটে করা এই চায়না মুল্লুকে করা উঁচুগলার খাস বাংলা ভাষার জয়ধ্বনি, মিটার বিশ তিরিশেক দূরে ছবি তোলাতুলিতে ব্যস্ত পরিবারের সকলের না, কারো কারো কিছুমাত্র কর্ণগোচর হলেও তাতে মঙ্গোলিয়া বিষয়ক নিজ উত্তেজনার ভাপটুকুর কণামাত্রও যে ওখানে পৌঁছুতে পারেনি, বোঝা গেল তা পরিষ্কার, সকলের দেহভঙ্গিতে। ফলে ভেতরের টগবগ উত্তেজনার রাশ টেনে ধরে ফের মন দিলাম চেঙ্গিসেই। কিন্তু হায়! খুব বেশি দূর এগুতে পারলো না সে ভাবনা। কারণ আব্বার মুখে চেঙ্গিস খাঁ বিষয়ক গল্প শোনার পর, তা নিয়ে আর কখনো পাঠ্যবইয়ে পড়িনি যেমন কিছু, তেমনি নেইনি তার ব্যাপারে আলাদা কোন খোঁজ খবরও। অতএব এ ব্যাপারে তথ্যভাণ্ডার খুবই সীমিত, ফলে চুপচাপ জাবর কাটার মতো রসদ তো নেই ভেতরে। অবস্থা এক্কেবারে খালি কলসির ঠন ঠন।
তবে হ্যাঁ, ক্লাস সিঙ সেভেন আর সম্ভবত এইটে পাঠ্য বইয়ে যে বানোয়াট আর মতলবি ইতিহাস পড়তে হয়েছিল, তখন মোগলদের ইতিহাস পড়তে গিয়ে, মনে মনে তাতে খুঁজেছিলাম চেঙ্গিস বিষয়ক খবর। ভেবেছিলাম মঙ্গোলিয়ার, কুবলাই খাঁ, চেঙ্গিস খাঁ বা তইমুর লং এর বংশধরই হতো ছিলেন, ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের পত্তন করা সম্রাট বাবুর। কিন্তু নাহ, পাঠ্য বইয়ে লেখা ঐসব মতলবি ইতিহাসলেখকরা ইতিহাস লিখতে গিয়ে, যতোটা না তাদের নিজেদের মনোজগৎ আকীর্ণ করা থাকা সঙ্কীর্ণ ও মতলবি সামপ্রদায়িকতার চর্চা করেছেন, তার ছিটেফোঁটাও করেনি তারা ঐসব লেখায় শিক্ষার্থীদের; মানে অন্তত এ অধমের মতো বেকুব শিক্ষার্থীদের ইতিহাস বিষয়ে আগ্রহী করে তোলার প্রচেষ্টা। ফলে মঙ্গোলিয়ানরা আর মোগলরা একই বংশ ধারার কিনা তা নিয়ে মনে সৃষ্টি হওয়া ঐ ধাঁধা টি, সমাধানহীন ধাঁধা হিসেবেই রয়ে গিয়েছিল বহুকাল। পরে অবশ্য কোন একসময় ঘাঁটাঘাঁটি করে জানতে পেরেছিলাম, হ্যাঁ মোগল সম্রাট বাবুরের রক্তে, মঙ্গোল চেঙ্গিস খাঁর বংশধারার রক্তের একটা ক্ষীণতম স্রোত আসলেই বহমান ছিল।
তবে বড় কথা হল আব্বার মুখে চেঙ্গিস খাঁ সম্পর্কে শোনা গল্পে, তাকে যতোটা না আমার মনে হয়েছিল কোন বীরযোদ্ধা, তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি মনে হয়েছে তাকে একজন চরম নৃশংস মানুষ। এ কারণে পরে যখন শুনেছিলাম যে মঙ্গোলিয়ানরা, চেঙ্গিস খাঁ কে এখনো তাদের জাতীয় বীর হিসাবে তুমুল শ্রদ্ধা ভক্তি করে, বেশ একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম মনে! ভেবেছি যে কী করে? এইরকম একজন নৃশংস লোক কোন জাতির জাতীয় বীরের মর্যাদা পেতে পারে? আর শুধু আমি কেন? আমাদের প্রচলিত ভাষাতে আর সংস্কৃতিরই মননেই তো চেঙ্গিস খাঁ, হালাকু খাঁ নামগুলো; নৃশংসতার অপর নাম হিসেবেই ব্যবহৃত হয়! আর তাই যদি হয়, তবে হঠাত আমারই বা কেন মঙ্গোলিয়া নাম দেখার সাথে সাথে চেঙ্গিস খাঁরই নাম মনে পড়লো? সাথে সাথে হয়ে উঠলাম নিজেও উত্তেজিত?
তার মানে কি তবে এই যে, নিজেরই মনের কোন গহীন কোন কন্দরে, আমারই দ্বিতীয় আমি চেঙ্গিস খাঁ কে বসিয়ে রেখেছে বীরের আসনে? তা হলে তো এ এক বিরাট স্ববিরোধিতা! আর সেটাই যদি হবে, হলো কেন তা এমন? নিজেকে নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তর খুঁজতে খুঁজতে ফের তাড়া দিলাম পরিবারের বাকী সবাইকে, নিজের ভেতর হঠাতই তৈরি হওয়া মঙ্গোলিয়া অভিযাত্রায় যোগ দেবার জন্য।
যাক এবারের তাড়ায় কাজ হলো মনে হচ্ছে দেখছি। সবাই দেখছি আসছে এদিকেই। এতে আশ্বস্ত হওয়ার পিঠে পিঠে ফের মনে হল, আসলে মানব সভ্যতার ইতিহাসে যাদেরই বিশাল বিশাল বীরের মর্যাদা দিয়ে রচিত হয়েছে যতসব, ইতিহাস, কাব্য, মহাকাব্য কিম্বা নাটক, তাঁদের সকলের হাতেই স্পষ্ট লেগে আছে রক্তের দাগ।এক দুই বা তিন নয়, অসংখ্য মানুষ হননের রক্ত! সেক্ষেত্রে সচেতন আমার চেঙ্গিস খাঁকে যতই নৃশংসই মনে হউক না কেন, অবচেতনে আমি যদি মংগোলিয়ানদের মতোই তাকে বীরের আসনে বসিয়ে থাকে, তাতে সে জাতিটিকে বা আমারই নিজেকে দোষ দেয়ার অবকাশ কোথায়? মানব সভ্যতার ইতিহাসতো, অবশেষে রক্তারক্তিরই ইতিহাস। আর এখানে যে সমাজতান্ত্রিক লাল রঙয়ের ছড়াছড়ি দেখছি চারদিকে, সেটাও তো নিঃশব্দে কানে কানে সারাক্ষণই বলে যাচ্ছে মাওয়ের সেই সুবিখ্যাত উক্তি, “বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস’!
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক